হিমালয় ডেস্ক: চাঁদপুর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের পাশে রূপসা বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে নজর দিলেই চোখে পড়বে জমিদার প্রাসাদ। পাশেই কারুকার্জ খচিত একটি মসজিদ। সাধারণত জমিদার মানেই ভয়ানক অত্যাচারী আর নির্যাতনকারী। কিন্তু রূপসা জমিদারগণ ছিলেন একদম আলাদা। পরোপকারী এই জমিদাররা মানুষের আপদে-বিপদে ছুটে যেতেন। সেই সাথে রূপসার জমিদারগণ ছিলেন ধর্মপরায়ণ।
রূপসা বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে নজর দিলেই চোখে পড়ে যাবে অতি পুরনো ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির দৃষ্টিনন্দিত প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা রয়েছে রূপসা জমিদার বাড়ি। প্রবেশদ্বার দিয়ে কয়েক কদম এগুলোই হাতের ডান পাশে রয়েছে জমিদারদের পুরনো কারুকাজে খচিত মসজিদ। মসজিদের দিকে তাকালেই যেন নয়ন জুড়িয়ে যায়। মসজিদের বিপরীত পাশে অর্থাৎ দক্ষিণ পাশে রয়েছে জমিদারদের বংশধরদের কবর। আর কবরগুলোতে রয়েছে ফলক। ফলকগুলোতে প্রয়াত জমিদারদের কীর্তির বর্ণনা লেখা রয়েছে। জমিদার বাড়ির ভেতরে রয়েছে বেশ ক’টি ছোট-বড় মঠ। তার মানে এখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের জমিদার ছিলেন।
সেসময় রূপসার খাজুরিয়া এলাকা সিংগেরগাঁও নামে পরিচিত ছিল। সেখানে বাইশ সিংহ পরিবার নামে এক হিন্দু পরিবার বসবাস করত। তৎকালীন বংশাল গ্রামের হিন্দু জমিদারদের জমিদারির পতন হলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই জমিদারি কিনে নেন রূপসা জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আহম্মদ রাজা চৌধুরী। তিনি রূপসা জমিদার বাড়িতে জমিদারি শুরু করেন। আর তার মাধ্যমেই রূপসায় জমিদারি শুরু হয়। তারপর এ জমিদারির দায়িত্ব এসে পড়ে মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর উপর।
মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী ছিলেন দানশীল ব্যক্তি। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী রূপসায় জমিদারি করার কালে এলাকার অসহায়দেরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তার মৃত্যুর পর রূপসার জমিদারি ভার গ্রহণ করেন তারই পুত্র আহমেদ গাজী চৌধুরী। আহমেদ গাজী চৌধুরীর জমিদারি আমলে জমিদারি কায়দা কানুনের বিস্তৃতি প্রসারিত হয়। আহমেদ গাজী চৌধুরী নিজ কর্মগুণে আর কাজের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দয়া আর দানশীলতা ছিলো তার বৈশিষ্ট্য। জনকল্যাণ কাজের জন্যে তিনি জমি পর্যন্ত দান করেছেন।
রূপসার সুপ্রাচীন মসজিদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা এখনো জমিদার বাড়িতে প্রবেশের সিংহদ্বারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাই নয়, রূপসা আহম্মদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, আহম্মদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, লাউতলী দীঘি উল্লেখযোগ্য। আহম্মদ গাজী চৌধুরী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। আহমেদ গাজী সিলেটের হবিগঞ্জের লস্করপুরের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে বিবাহ করেন।
আহমেদ গাজীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তার ছিল ৫ কন্যা সন্তান। সকল কন্যা সন্তান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলে তার দ্বিতীয় কন্যা তহুরুন্নেছা চৌধুরানী জমিদারির উত্তরাধিকার হন। আহমেদ গাজী চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা হিসেবে তহুরুন্নেছা জমিদারিতে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সিলেটের হবিগঞ্জের দাউদ নগরের জমিদার সৈয়দ শাহ কেরামত উল্যাহর ছেলে সৈয়দ হাবিব উল্যাহর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবন শুরু করেন। তাদের সংসারে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল। তহুরুন্নেছা বিয়ের পর রূপসাতে থাকতেন। তার স্বামী সৈয়দ হাবিব উল্যাহ তহুরুন্নেছার জমিদারি দেখভাল করতেন। তহুরুন্নেছা নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। জমিদারি পরিচালনার কর্মদক্ষতায় তৎকালীন ব্রিটিশ পরিবার তহুরুন্নেছাকে ‘কায়সায়ে হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তহুরুন্নেছা চৌধুরীর একমাত্র কন্যার অকাল মৃত্যু হয়। তখন তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। এর কয়েক বছর পর তহুরুন্নেছার স্বামী সৈয়দ হাবিব উল্যাহ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
তারপর জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তহুরুন্নেছা চৌধুরানীর একমাত্র পুত্র সৈয়দ আব্দুর রশিদ চৌধুরী। আব্দুর রশিদ চৌধুরী রূপসায় রসু চৌধুরী নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। রসু চৌধুরীর জমিদারির আমলে বহিরাগত লোকজন রূপসা বাজারে টোকেন ছাড়া প্রবেশ করতে পারতো না। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের বিভিন্ন জেলায় জমিদারদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু রূপসার জমিদার রশিদ চৌধুরীর সম্পত্তি দখল করতে পারেনি। আইয়ুব খান এখানে এসেছিলেন। রশিদ চৌধুরীর সাথে বৈঠক করেছিলেন তখন রশিদ চৌধুরী তাকে বলেছিল, আপনি আমার কাছে কী চান। জমিদারির সম্পত্তি না অন্য কিছু। আইয়ুব খান কোনো কথার জবাব দিতে পারেনি। ব্যর্থ হয়ে রূপসা থেকে ফিরে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার বেশিরভাগ জমিদাররাই পাকিস্তান মিলিটারি বাহিনীকে অর্থ এবং বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই রূপসা জমিদাররা পাকিস্তানি মিলিটারিকে সাহায্য করেননি। তারা মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। ১৯০৭ সালে সৈয়দ আব্দুর রশিদ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন আর ১৯৮১ সালে তিনি এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তিনি কলকাতায় শিক্ষা জীবন শেষ করে জমিদারি শুরু করেন। রূপসা জমিদারের এই বংশধর কুমিল্লার লাকসামের মনীষী নবাব ফয়জুন্নেছার পরিবারের সৈয়দা আমিরের নেছাকে বিবাহ করেন। আব্দুর রশিদের আমলে জমিদারি অনেক বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তার অবদান ছিল অনেক বেশি। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও ছিলেন তিনি।
রশিদ চৌধুরীর জমিদারির আমলে এ এলাকার মানুষকে চলাচলের জন্যে ফসলি জমির আইল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তখন গ্রামবাসী সে পথেই চলাচল করতো। রশিদ চৌধুরী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার দানশীলতা, দয়ার কথা আজো এলাকাবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। প্রতি বছর ঈদুল আযহার সময় তিনি ৩০/৪০টি গরু জবাই করে এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করতেন।
গ্রামবাসী ও প্রজাদের কখনোই জমিদার রশিদ চৌধুরীর রোষানলে পড়তে হয়নি। রশিদ চৌধুরী রূপসা এলাকার যতগুলো বাজার রয়েছে প্রতিটি বাজারে মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন মুসল্লিদের জন্যে। শুধু তাই নয়, ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া মন্দিরের জন্যে তিনি অবদান স্বরূপ জমি দান করেছেন। চাঁদপুর শহরের চৌধুরী জামে মসজিদ ও চৌধুরী ঘাটটি এ জমিদার বাড়ির জমিদারদের জনহিতকর অবদান। ১৯৮১ সালের ১৭ জুলাই রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই এ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।
রূপসা জমিদার বাড়িটি প্রায় ৮ একর সম্পত্তির উপর। তাদের কত সম্পত্তি রয়েছে তার হিসেব নেই। জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। জমিদার বাড়িতে ইট দিয়ে তৈরি করা মোট তিনটি ভবন আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মূল ভবন, আর একটি আছে মূল ভবনের বাম পাশে এবং আরেকটি আছে মূল ভবনের পিছনে। এছাড়াও আছে ঢেউটিন দিয়ে তৈরি করা তিনটি ঘর। জমিদার বাড়িতে ঢোকার পথে ডানপাশে আছে জমিদার বাড়ির মসজিদ এবং জমিদার বাড়ির কবরস্থান। আর ঘাটবাঁধানো একটি বিশাল পুকুর ও জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বার।
বাংলাদেশে অবস্থিত বেশিরভাগ জমিদার বাড়িই অযত্ন ও অবহেলার কারণে প্রায় ধ্বংসের মুখে। কিন্তু রূপসা জমিদার বাড়ি এখনো প্রায় আগের মতোই আছে। রূপসা জমিদার বাড়িতে প্রবেশ পথে একটি গেইট রয়েছে, ভিতরে একটি মসজিদ, জমিদার পরিবারবর্গের একটি কবরস্থান, একটি কাছারি ঘর রয়েছে। কবরের প্রতিটি ফলকে লেখা রয়েছে এখানে শায়িত ব্যক্তিদের সুকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। পথ ধরে সামনে এগুলেই চোখে পড়বে ঘাঁট বাঁধানো দীঘি। তবে আগের সে দীঘি এখন আর নেই।
জমিদারের জমিদারি না থাকলেও এতটুকু সম্মান আর শ্রদ্ধার কোনো ঘাটতি হয়নি প্রজা প্রিয় জমিদারদের প্রতি সাধারণ মানুষের। এ এলাকার সাধারণ মানুষ আজো জমিদারদের পূণ্যময় কাজগুলোর প্রশংসা করতে ভোলেন না। জমিদারি প্রথা থাকাকালীন প্রজাদের খাজনার টাকায় ভোগ বিলাস না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অনেক কিছুই স্থাপন করে গেছেন জমিদাররা।
বর্তমানে জমিদার বাড়িতে প্রায় জমিদারদের অর্ধ শতাধিক পাইক পেয়াদারা বসবাস করছে। রশিদ চৌধুরীর প্রথম সংসারের ছোট ছেলে মোঃ আলমগীর হোসেন চৌধুরী বাড়িতে বসবাস করছে। রশিদ চৌধুরীর নাতি সৈয়দ মেহেদী হাছান চৌধুরী পারিবারিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জমিদার বাড়ির খোঁজে দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াই আমি। সরকারী তত্ত্বাবধান ছাড়া এত সুরক্ষিত অবস্থায় আর কোনো জমিদার বাড়ি দেখিনি। নিজের শহরে টিকে থাকা এই রূপসা জমিদার বাড়ি নিয়ে তাই আমার গর্বের শেষ নেই।