গৌতম দাস
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, ভারতের সাবেক কূটনীতিক, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ২০০৭ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভারতের বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো হিসেবে সক্রিয়। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের নীতিনির্ধারকরা যা ভাবেন, অবস্থান নেন এমন সবার সাথে, অন্য সব কূটনীতিকের চেয়ে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আস্থার সাথে সংযুক্ত এমন এক ব্যক্তিত্ব তিনি। এর সম্ভাব্য কারণ, ২০০৭-০৯ সময়পরিধিতে তার বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্বে থাকা। না এটা যথেষ্টভাবে বলা হলো না। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কিছু কথা বলা দরকার। বাংলাদেশ যে পিনাক রঞ্জনকে চিনত তা থেকে ভিন্ন, আনলাইক এক পিনাক রঞ্জনের এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে গত ৫ সেপ্টেম্বর ‘সাউথ এশিয়ান মনিটর’ পত্রিকায়। সে প্রবন্ধের ভাষ্যে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর থেকে ভারতের সমর্থন প্রত্যাহারের ইঙ্গিত হিসেবে পাঠ করার সুযোগ আছে।
এক-এগারোর সরকারের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এবং পরিণতিতে, আমেরিকা যদি বাংলাদেশকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে দিয়ে থাকে; তবে ভারতের দিক থেকে এতে এক নম্বর পরামর্শদাতা ও বাস্তবে রূপদানকারী ব্যক্তি কাকা বাবু প্রণব মুখার্জি। আর এ কাজের মাঠের বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী।
উইকিলিকস ফাইল থেকে জানা যায়, এক-এগারোর টেকওভার এবং এর লক্ষ্য অনুযায়ী সাধিত কাজ শেষে এরপর এর এক্সিট রুট কী হবে, মানে কাকে ক্ষমতা দিয়ে তারা কেটে পড়বে, এটা নিয়ে শত প্রশ্ন ও অনুরোধ সত্ত্বেও ক্ষমতা দখলকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বিউটিনিসের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর জানতে পারেনি। উপায়ন্তরহীন সেই পরিস্থিতিতে অবস্থা দেখে মনে হয়, এ ব্যাপারে ক্ষমতা দখলকারীরা একটা নিজস্ব আবছা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। তা হলো, লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ হওয়া শেষে তারা নিজেরাই এরশাদের মতো কোনো দল গঠন করে নেবে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ২০০৭ সালের জুনের পর থেকে অক্টোবরের মধ্যে এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে, আমেরিকা এ অঞ্চলের ‘টেররিজমের বিরুদ্ধে পাহারাদারের’ ঠিকা ভারতকে দিচ্ছে। ‘ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকা তার নিরাপত্তা স্বার্থ’ বুঝে নেবে। তাই মনে করা হয়, এরই নিট ফলাফলে বাংলাদেশ ভারতের ইচ্ছাধীনে চলে যায়। এর অন্য আরেকটি দিক ছিল আমেরিকা ওয়ার অন টেররের নামে পদক্ষেপের আড়ালে ভারতকে অন বোর্ড করে নিয়েছিল। যার মানে হলো, এটাই আমেরিকান স্বার্থে ‘চীন ঠেকাও’ বা ‘চায়না কনটেনমেন্টের’ কাজটি ভারতকে দিয়ে করিয়ে নিতে আমেরিকা তাকে রাজি করিয়ে নেয়। বিনিময়ে এরই রাজভেট হলো, আমেরিকার বাংলাদেশকে হস্তান্তর, ভারতের করিডোর লাভ ইত্যাদি।
কিন্তু বিউটেনিস নিজেদের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মইন-ফখরুদ্দীন ও তার সঙ্গীদের রাজি করাতে পারছিল না। তারা শেখ হাসিনার বিনা জামিনে দেশত্যাগ ও তাকে ক্ষমতায় আনা ইত্যাদিতে রাজি হচ্ছিল না। এ সময় পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী কিছু নির্ধারক কাজ করে তাতে মইন ও তার সঙ্গীদের বাধ্য হয়ে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আগমনের পরে ২০০৯ সালে পিনাক রঞ্জন তার ‘সফল’ অ্যাসাইনমেন্ট শেষে দেশে ফিরেছিলেন।
পিনাকের এই লেখার শিরোনাম পিনাকের মতো নয়। যেমন বাংলায় শিরোনামটি হলো- ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের ছায়া, হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, বিএনপিকে দমন।’ ইংরাজিতে, “Shadow of India, Hasina governmentÕs corruption, repression of BNP looms over Bangladesh polls.”
এটি বেশ তামাশার যে ‘বিএনপির ওপর নিপীড়ন হচ্ছে’ আর এ কথা ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত তার লেখার শিরোনাম করেছে। তবে এর চেয়েও আরো বিস্ময়কর হলো, শব্দ বাছাইয়ে পরিবর্তন। বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে কি না, শেখ হাসিনা সরকার সেই দুর্নীতি করছে কি না- এটি গত দশ বছরে ভারত বা পিনাক রঞ্জনের ভাষায় উঠে আসেনি। এটি মূলত আমেরিকান ভাষা। পিনাক রঞ্জনের লেখায় যেসব বিস্ময়কর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তার একটি তালিকা আমরা দেখে নেই।
এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন : পিনাক রঞ্জন আওয়ামী লীগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের জন্য সরাসরি অভিযুক্ত করেছে। লিখছে, ‘আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পদক্ষেপকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং এর মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের নীলনকশা হিসেবে দেখা হয়েছে। অথচ নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এই আওয়ামী লীগই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার বিক্ষোভ করেছিল। এর জের ধরে বিএনপি সরকার সংবিধানে বিধিটি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার আয়োজিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল করে।’
দুই. কোটা আন্দোলন ও যানবাহন ইস্যুতে ছাত্রদের আন্দোলন সামলাতে ব্যর্থতা ও হার্ডলাইনে যাওয়া : এটি সত্যিই বিস্ময়কর যে, পিনাক রঞ্জনের মতো ভারতের কোনো কূটনীতিক হাসিনাকে ‘হার্ডলাইনে দমন করা’ আর কাজ সামলাতে ‘ব্যর্থতার’ জন্য আঙুল তুলছে। কিছুটা আমেরিকান বা পশ্চিমা কূটনীতিকের আদলে মানবাধিকারের কথা ব্যাকগ্রাউন্ডে মনে রেখে তারা যেভাবে কথা বলেন, যা বলাই বাহুল্য ‘পিনাকসুলভ নয়’ তা না হয়েও তিনি লিখেছেন- ‘সরকারি চাকরির কোটার মতো ঘরোয়া ইস্যু এবং ঢাকার অবাধ্য ও বিশৃঙ্খল যানবাহন নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা আন্দোলন অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষমতা রাখে। বিভিন্ন ইস্যুতে হাসিনা সরকারের ছন্দপতন ঘটেছে, যথাযথভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, ঢাকার অবাধ্য যানবাহন চালকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। এসব চালক দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ফলে দেশব্যাপী ছাত্রদের ক্রোধ উসকে দেয়া এবং এ ইস্যুতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নস্যাতের অভিযোগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ফটোগ্রাফারকে গ্রেফতার ছিল বেপরোয়া সিদ্ধান্ত। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করে, কিন্তু শেখ হাসিনা কোনো ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করেননি।’
এমনকি ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ফটোগ্রাফারকে গ্রেফতার’ বলে শহিদুল আলমের কথা তিনি উল্লেখ করে লিখেছেন- ‘এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করে’।
মজার ব্যাপার হলো গত দশ বছরে ভারতের কোনো কূটনীতিক, কলামিস্ট, মিডিয়া রিপোর্ট কেউ শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গুম-খ্নু, পায়ে গুলি করে দেয়া ইত্যাদিতে বা ‘হার্ডলাইনে দমন করা’ আর কাজ সামলাতে ‘ব্যর্থতার’ জন্য আঙুল তুলছে আমরা এমন দেখিনি।
তিন. স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, বিরোধী দলকে দলন ও ব্যাপক দুর্নীতি : নিজ চোখে দেখলেও এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন ‘স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, বিরোধী দলকে দলন ও ব্যাপক দুর্নীতির’ অভিযোগ আনছেন। কারণ, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় আনার এক মাঠের কুশীলব তিনি নিজেই। তিনি লিখেছেন- হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, বিরোধী দলকে দলন ও ব্যাপক দুর্নীতি। নির্বাচনী প্রচারণায় এসব ইস্যু ও ভারত ফ্যাক্টর প্রাধান্য পাবে। রাজনৈতিক বিরোধীদের অব্যাহতভাবে হয়রানি করার ফলে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নীরব ক্ষোভ বেড়েই চলেছে এবং ব্যাপকভাবে এ ধারণার সৃষ্টি করেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে। ক্রমেই এমন অভিমত জোরালো হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগ আগামী সংসদ নির্বাচনে লজ্জাজনক সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। অনেক সমালোচক বিশ্বাস করেন, হাসিনা সরকার নির্বাচন ‘ম্যানেজ’ করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় একে বলা হয় ‘নির্বাচনী জালিয়াতি’।
চার. মাদকবিরোধী অভিযান আসলে ‘গুলি করে হত্যার’ নীতি : কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন কি পরিচয় বদলে ‘মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট’ হয়ে যাচ্ছেন? তিনি লিখেছেন- মাদকের বিরুদ্ধে কথিত জাতীয় অভিযানটি ‘গুলি করে হত্যার’ নীতিতে পর্যবশিত হয় বলে মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্টরা জানিয়েছেন। এতে অনেক নিরপরাধ মারা যায়।
পাঁচ. সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আওয়ামী লীগের হিন্দু দলন ইস্যু : ভারতের কোনো সাবেক হাইকমিশনার শেখ হাসিনা ও তার দলকে ‘হিন্দু সংখ্যালঘুদের দলন, হয়রানি ও বৈষম্য করছে’ বলে অভিযোগ করছে; এটি এর আগে চিন্তাও করা যায়নি। এটাই কি হাত ছেড়ে দেয়ার চূড়ান্ত ইঙ্গিত? সবাইকে অবাক করে পিনাক রঞ্জন এই অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক প্রধান বিচারপতি সরকারের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পদত্যাগ করতে ও বিদেশে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনসূচক থাকা হিন্দু সংখ্যালঘুরাও ক্ষুব্ধ। কারণ, আওয়ামী লীগ নেতারা দায়মুক্তির সাথে হিন্দু সম্পত্তি জবরদখল করেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া ভারতের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের হয়রানি ও বৈষম্য করা হলেও কিছু বলবে না।’
ছয়. বিএনপির প্রতি সহানুভূতি : পিনাক রঞ্জনের দু-দুটি প্যারাগ্রাফ ধরে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিমূলক ভাষায়, ‘তারা হাসিনা সরকারের হাতে নির্যাতিত’ এ পটভূমি তৈরি করে লিখেছেন, ‘তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে বিএনপি।’ অর্থাৎ বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলনের প্রতিও তার সহানুভূতির ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। তিনি পরের প্যারাগ্রাফে আরো লিখেছেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই আদালত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়কেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতে পারে। তা ঘটলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়বে।’
এখানে পাঠককে একটু সাবধান করার আছে যে, এখনই কোনো ‘সরল’ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কিছু নেই। ওয়েট অ্যান্ড সি। পিনাক রঞ্জনের ভাষা ও বক্তব্যে সত্যিই কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কি না বিচার্য বিষয়, এতটুকুতেই আপাতত থাকা ভালো।
সাত. আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির ভেতরে কথিত ভাঙনের গুজব ছড়ানোর দায় আনা : পিনাক রঞ্জন বেশ খোলাখুলিই লিখেছেন, ‘বিএনপির প্রবীণ নেতারা তারেককে অপছন্দ করেন। তারা নেতা হিসেবে খালেদাকেই অগ্রাধিকার দেবেন। বিএনপির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা রয়েছে, এমন গুঞ্জনও রয়েছে যে ভাঙনের মাধ্যমে নতুন দলের আবির্ভাব ঘটতে পারে। সম্ভাব্য ভাঙনে আওয়ামী লীগের হাত আছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।’
তবে লক্ষণীয় বিষয় বিএনপি নিয়ে এত কথা তিনি লিখেছেন অথচ ২০০১-০৬ সালের বিএনপি সরকারের কোনো কাজ বা পদক্ষেপের সমালোচনা নেই। এমনকি, দশ ট্রাক অস্ত্র অথবা কথিত জঙ্গি বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেয়ার কোনো অভিযোগও তিনি তোলেননি। এটি কোনো ভারতের কূটনীতিক ও সাবেক হাইকমিশনারের জন্য চরম ব্যতিক্রম। বিশেষ করে ঠোঁট কাটা অকূটনীতিকসুলভ মন্তব্যের জন্য যেই পিনাক রঞ্জন খারাপভাবে খ্যাত।
আট. নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগকে অধস্তন করে রাখার অভিযোগ : এ অভিযোগ তুলেছিল মূলত বিএনপি। কিন্তু পিনাক রঞ্জন সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে এনেছেন। তবে অবশ্যই ‘নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগকে অধস্তন করে রাখার’ এই অভিযোগ খুবই মারাত্মক। তিনি লিখেছেন, ‘বিএনপির নির্বাচনী প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি। দলটি অভিযোগ করছে, আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগকে অধস্তন করে রেখেছে।’
পিনাক রঞ্জনের লেখায় মূল অভিযোগ মূলত এগুলোই। তবে কামাল হোসেনের যুক্তফ্রন্টকে নিয়ে হাসিনার বিদ্রƒপ মন্তব্যেরও পিনাক সমালোচনা করেছেন। এ ছাড়া ‘ভারত ফ্যাক্টর’ বলে একটি শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। ব্যাপারটি অনেকটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় সব কিছুতেই ভারতের দাদাগিরি ও হস্তক্ষেপ আর নিজের একক স্বার্থে সব নিয়ে যাওয়া এসব কিছুকে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন, আর তা করেছেন অনেকটা ক্ষমা চেয়ে নেয়ার ভঙ্গিতে। যেমন নিজে থেকেই প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে বিএনপির হাসিনাকে ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নতজানু দেখানোর সম্ভাবনা থাকায় ভারত ফ্যাক্টর হবে বিপুল। প্রধান সমালোচনা হবে, হাসিনা ভারতকে খুব বেশি ছাড় দিয়েছেন, কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছেন অতি সামান্য। আবার ভারতের পানি না দেয়া ইস্যু নিজেই তুলে বলছেন, ‘নদীর পানিবণ্টন এখনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেলেও তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না এমন নয়।’ এ ছাড়া, আসাম নাগরিকত্ব ইস্যুতে প্রস্তাবের সুরে বলেছেন, ‘…দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা অবৈধ অভিবাসী ইস্যুটি বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে উদ্বিগ্ন করবে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এনআরসি থেকে সৃষ্ট অনিবার্য প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।’
সোজা কথায় রাখঢাক না করে বললে ব্যাপারটা হলো, গত ১০ বছরে ভারতের যত রুস্তমি, প্রভাব বিস্তার, বর্ডার কিলিং থেকে শুরু করে তার যা দরকার তা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, ভারতের স্বার্থ আগে ইত্যাদিতে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ যে চরমভাবে ক্ষুব্ধ, সে সম্পর্কে পিনাক রঞ্জন সচেতন। তিনি ইঙ্গিতে যা বলতে চাইছেন, তা যদি আমরা বুঝে থাকি তা সম্ভবত এমন যে, তিনি বলতে চাইছেন, সম্ভাব্য নতুন সরকার এলে সব ভুলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন করে যাত্রা করা যেতে পারে।
বলা বাহুল্য, মি. পিনাক রঞ্জন আসলে অনেক ফাস্ট। তাই দ্রুত অনেক আগে চলে গেছেন আর খুবই সরল ভাষ্য হাজির করেছেন। বাংলাদেশে গুম হওয়া কোনো মানুষ ভারতের মাটিতে পাওয়া যাওয়া কি এতই সরল! তাই পিনাক রঞ্জন খুব গভীর সচেতন তা বলতে পারছি না। তাকে অনেক গভীরে চিন্তা করতে হবে আর স্বভাবতই অনেক কাঠখড়ও পুড়বে।
সবশেষে পিনাকের শেষ প্যারাগ্রাফের চারটি বাক্য সম্পর্কে : বাংলাদেশে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করুক এর বিরুদ্ধে ভারতের আপত্তি ঈর্ষামূলক ও ক্ষতিকর তা কি ভারত বুঝেছে? আমরা কোথাও এমন কিছু দেখিনি। ফলে তার প্রথম বাক্য- ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক পূর্ণ বিকশিত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং পরিকাঠামোর আরো একীভূতকরণ, সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র আরো আধুনিকায়ন, মোটরযান চুক্তি ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ভবিষ্যতে আরো জোরালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই আশার কোনো ভিত্তি নেই। খামাখা ইউজলেস।
দ্বিতীয় বাক্য : ‘ঢাকায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ভারত তার সাথে কাজ করবে।’ এই বাক্য থেকে আমরা হাসিনা সরকার দুর্বল অবস্থায় আছে, তাই সম্ভবত তিনি বুঝতে চাইছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সফর, তার মাতব্বরির মিল খুঁজে পাই না। তিনি বলেছিলেন, যারা নির্বাচনে আসবে তাদের নিয়েই নির্বাচন হবে আর এরশাদ যেন বিরোধী দলের জায়গা পূরণ করে। সেটি তাহলে কেন বলেছিলেন?
তৃতীয় বাক্য : ‘তাই বলে কোনো হাসিনাবিরোধীকে ভারত বিকল্প মনে করছে, এমন কিছু ভাবা হবে কষ্টকর কল্পনা।’ বোঝা গেল এটা পিনাকের ‘সংবিধি সতর্ককরণ’ যে ভারত বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছে ব্যাপারটা তা না। নো প্রবলেম।
চতুর্থ ও শেষ বাক্য : ‘অবশ্য, হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা ও তার প্রতি ভারতের সমর্থন অনিবার্য মনে করা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়, ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ক্রমেই এমন অনুভূতিও জোরালো হচ্ছে।’
‘ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়’- আসলে এটাই হলো ঘুরিয়ে বলা যে কাজ ফুরিয়েছে, শেখ হাসিনা ক্রমেই লায়াবিলিটি বলে অনুভূত হচ্ছেন আমাদের কাছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক