আবু রায়হান: চকবাজারের ভয়াবহ আগুন যে ৬৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তারা তো আর ফিরবেন না। তবে এমন কান্নার শেষ কোথায়- এই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। কারণ কোনো একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কিছু দিন আলোচনা-সমালোচনা চলে। কেউ দায় এড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সময়ের তালে তালে তার রেশও একসময় ফুরিয়ে যায়। তখন সবাই ভুলে যান আগের শোকগাথা। পুরনো ঘটনা থেকে যেন কেউ শিক্ষা নিতে চান না। জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মে। এরপর ঘটে আরেকটি দুর্ঘটনা। চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরেও যার নজির গুলশান এফআর টাওয়ার, গুলশান কাঁচাবাজারসহ আরো অনেক। চুড়িহাট্টার ধ্বংসস্তূপ ধুয়েমুছে সাফ করার চেষ্টা চলছিল। পুড়ে যাওয়া যানবাহন ও বাসার আসবাব সরাচ্ছিলেন কেউ কেউ। নতুনভাবে ঘর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক করে নেওয়ার কাজও চলছিল। তবে প্রশ্ন হলো- এমন আরেকটি ট্র্যাজেডি রোধে কতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে? আবার কি একই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে হবে? জনবসতিপূর্ণ কোলাহলময় পুরান ঢাকা থেকে কবে সরানো হবে কেমিক্যালের গুদাম। সেখানে প্রায় সব বাড়িতে কোনো না কোনোভাবে কেমিক্যালের গোডাউন ও কারখানা রয়েছে। এমনকি চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামে যে বাড়ির সামনে থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই বাড়ির প্রায় পুরোটা ছিল কার্যত কেমিক্যাল নামক ‘বোমা’র গুদাম। ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রসাধনী ব্র্যান্ড ‘ক্লেরিসে’র বেবি লোশন ও দুবাইয়ের ‘স্টারলিং’ পারফিউমের শত শত বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। দেশে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন হয় না। বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নকল মোড়কের এসব পণ্য ওয়াহেদ ম্যানশনের ভাড়া গুদামে রেখে তা বাজারজাত করা হচ্ছিল।
৯ বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডিতে প্রাণ যায় ১২৪ জনের। তার পর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত পদক্ষেপের কোনো কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি। তাই পুরান ঢাকায় যেন আরেকটি বড় ট্র্যাজেডির ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। চকবাজারের ভয়াবহ দুর্ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। এ ঘটনায় বিশ্ব গণমাধ্যমে আবারও শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ।
চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটির একজন সদস্যও। জুলফিকার রহমান বলেন, ভবনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। বোতলে পারফিউম রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলের পারফিউম বাষ্প হয়ে ‘বোমা’র মতো কাজ করেছে। রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সভাপতি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে চলতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কোনো কোনো পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চরম দুর্দশায় পড়েছে। শুধু দায়ী ব্যবসায়ী বা ভবনের মালিকদের বিচার করতে হবে তা না, যেসব সংস্থার অবহেলার কারণে এই অবস্থাপনাগুলো চলছিল, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
হতাহত ব্যক্তিদের স্ত্রী, বাবা, মা, ভাই ও সন্তানদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছিল পরিবেশ। নিহত ব্যক্তিদের ছোট ছোট সন্তানদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থান জরুরী। নিহত মোহাম্মদ শাহীনের স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে তাঁর। এমন কোনো আত্মীয়স্বজন তাঁর নেই, যাঁরা তাঁকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারেন, পাশে দাঁড়াতে পারেন। ময়না বেগমের বড় ছেলেটির বয়স ১৩ বছর। সবচেয়ে ছোট মেয়ের বয়স ৭ বছর। ময়না বলেন, ‘আমার খুব সুখের সংসার ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর রাতারাতি সবকিছু পাল্টে গেছে। খাব কী, আমার বাচ্চাদের কীভাবে পড়াব, বাসা ভাড়া কী করে দেব—এসব নিয়ে চোখে রীতিমতো অন্ধকার দেখছি। ময়নার মতো এমন অবস্থার কথা বলেন নিহত মোহাম্মদ কামাল হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেন। মোহাম্মদ কামাল হোসেনের রয়েছে ৬টি কন্যা সন্তান। বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের বাসিন্দা কামাল হোসেন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সহায়তা করার মত আর্থিক সঙ্গতিও নেই আপনজনদের মধ্যে কারো। এখন এ পরিবারটির ভবিষৎ কেবলই অন্ধকার! নিহতদের বেশিরভাগের পরিবারেরই দরকার দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা।