মাওলানা মিরাজ রহমান: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদার! তোমরা অধিক ধারণা থেকে দূরে থাক। কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। আর একজন অন্যজনের গিবত করো না। [সুরা আল-হুজুরাত:১২]। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ওপর অনুমান ও মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বারণ করা হয়েছে। এমনকি অন্য ধর্মের অনুসারীদের কোনো গোপণ বিষয়েও অহেতুক অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে নিন্দনীয় মনে করে ইসলাম। ইসলামের শিক্ষা হলো- পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণা রাখা। সুধারণা পোষণ করা। মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব ধরনের সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মন্দ ধারণার বশবর্তী হয়ে কারো সম্পর্কে মুখে কিছু উচ্চারণ তো করা যাবেই না, উপরন্তু মন্দ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে সরে আসার প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাচর জন্য তাওবা-ইস্তেগফার পড়ার নির্দেশ প্রদান করেছন রাসুল [সা.]। রাসুল [সা.] ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ধারণাভিত্তিক কথা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না আর তোমরা পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করো না এবং পরস্পর শত্রুতা ও দুশমনি পোষণ করো না; বরং হে আল্লাহর বান্দারা, ভাই ভাই হয়ে থাক [বোখারি]। মন্দ ধারণা তাকেই বলে, যে ধারণার পক্ষে বাহ্যিক কোনো কারণ কিংবা সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই । এমন ধারণাকেই কোরান-হাদিসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তা থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যার মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারি পরিলক্ষিত হয়, তার সম্পর্কে ফাসাদ ও খিয়ানতের ধারণা পোষণ করা হারাম বলে বিবেচিত হবে। তবে যদি কারো মধ্যে সুস্পষ্টভাবে খিয়ানত পরিলক্ষিত হয় এবং তার স্বভাব-প্রকৃতিও মন্দ হয়, আর এ ব্যাপারে যদি সমাজে তার কুখ্যাতিও থাকে, তাহলে এমন লোক সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা হারাম হবে না। মন্দ এবং ভালো ধারনা মূলত একটি মানসিকতার সাথে সম্পর্কিত। যার মানসিকতা যেমন সে মানুষের প্রতি ধারনাও করে থাকে তেমন। আরবি ভাষা-সাহিত্য একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছ- পাত্রের মাঝে যা রয়েছে তাই তো পাত্র থেকে বের হবে। আতরের পাত্রের মুখ খুললে সুগন্ধি বের হবে এবং পানি ভর্তি গ্লাস থেকে পানি বের হওয়াটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যে মানুষের মানসিকতা যেমন তার ধারণাশক্তিও ঠিক তেমন। আলোচনা প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট গল্প এখানে না বললেই নয়, একদিন শীতের রাতে সুবহে সাদিকের সময় একজন মুমিন বান্দা অজু করার জন্য পুকুর ঘাটে এলেন । একই সময় এক চোর ব্যক্তি চুরি শেষে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হতে এলো। মুমিন বান্দা চোর ব্যক্তিকে দেখে ভাবলেন- ভেবেছিলাম এমন শীতের রাতে আমি বুঝি একাই ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি । নাহ আল্লাহর আরো একজন বান্দাও অজু করতে এসেছেন। অপরদিকে চোর ব্যক্তি মুমিন বান্দাকে দেখে ভাবতে লাগলো- ভেবেছিলাম এমন শীতের রাতে আমি একাই বুঝি মানুষের ঘরে সিদ কাটি। নাহ, আমার চোর এই মহল্লাতে আরো রয়েছ। গল্পটি একটি কৌতুকভিত্তিক ঘটনা হলেও এর মাঝে শিক্ষা নিহিত। মানুষ তার মানসিকতার সমান বড়। মানসিকতাই একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয়। ধারণা পোষণ করার মূল ভিত্তি এই মানসিকতা। তাই উচিত, আমাদের মানুসিকতাকে ইসলামের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা। সকল প্রকার মন্দ ধারনা পোষণ করা থেকে বিরত থাকা। মন্দ ধারণা কখনই কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং তা হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে, পাস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। যে মন্দ ধারণা পোষণ করে, সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর এক গুনাহ অন্য গুনাহর দিকে টেনে নেয়। এভাবে মন্দ ধারণা পোষণকারী বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধ ও পাপে জড়িয়ে পড়ে। অন্যকে মন্দভাবে মূল্যায়ন, অন্যের সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা এবং অন্যের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করাই হলো পারস্পরিক ভালোবাসা নষ্ট ও শত্র“তা সৃষ্টির কারণ। আমি যদি মুসলিম ভাই সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করি এবং মুসলিম ভাইকে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের মাঝে হৃদ্যতা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে এবং আমাদের ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হবে। আর যদি এর বিপরীত করি, তাহলে নিজদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্র“তা সৃষ্টি হবে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বলতে আমাদের মাঝে কিছুই থাকবে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মন্দ ধারণা পোষণ করার মতো খারাপ ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।