নিজে ব্যাংকার, স্বামী চাকরী করেন প্রাইভেট কোম্পানিতে। সব মিলিয়ে ইসরাত জাহান চৌধুরীর সংসারটা বেশ সুখের। এই সুখটা আরো বেড়ে গিয়েছিল চিকিৎসকের কাছ থেকে সন্তান সম্ভাবনা হওয়ার খবর শুনে। সন্তানের নামও ঠিক হলো। নাম হবে তুলিকা। কিন্তু কথায় আছে, বেশি সুখের ভার নেয়া কঠিন। ইসরাত জাহানের জন্য এই ভার তীব্র হয়েছিল সন্তান কোলে আসার পর। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় তাকে। আবার সন্তানের নামও তুলিকা রাখা হয়নি। তবে যার হৃদয়ে অদম্য স্পৃহা তাকে দমায় কে? ইশরাত বলেন ‘আমার সন্তানের নাম তুলিকা রাখতে পারিনি সেই কষ্ট মনে ছিলো। তার উপরে সকলের অসহযোগিতায় চাকরি ছাড়লাম। এতে মনের কষ্ট আরো বেড়ে গেলো। ঢাকা রিজেন্সিতে কিছুদিন চাকরি করেও সুবিধা করতে পারিনি। তাই ভাবলাম এমন কিছু করবো যেটা আমার সংসার জীবনে কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। সেই সাথে এর অর্থের যোগান দিতে কারো ধর্ণা দিতে হবে না। আর অবশ্যই সেই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখবো ‘তুলিকা’।
ইশরাত নতুন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে ২০১৫ সালে মাঠে নামেন। তার অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। কয়েকটা ব্যবসার কথা মাথায় এসেছিল। শেষ পর্যন্ত পাট পণ্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে হুট করেই ব্যবসা শুরু করেননি। ২ বছর এর বাজার ও পণ্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। ‘আমি প্রথমে এই পণ্যের বাজার দেখেছি। যারা এই ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। পাট পণ্যের আদি-অন্ত জেনেই ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটাই আমার শেষ সুযোগ। আমার ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই কারণ এই ব্যবসায় আমাকে আমার শেষ পুঁজিটুকু বিনিয়োগ করতে হবে। এটা যদি হারাই তাহলে আমার হাতে আর কোনো সুযোগ থাকবে না। আমাদের সমাজে একজন ছেলের হাতে পরিবার দায়িত্ব দিতে পারে, কিন্তু একজন মেয়ের ওপর সামান্য আস্থা রাখতে পারে না’।
বাজার বিশ্লেষণের পর ২০১৭ সালে পাট পণ্য তৈরির ব্যবসায় নেমেছিলেন ইশরাত। অনেক শঙ্কা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বুকে ছিলো আশা আর মনে ছিলো পরিশ্রমের মানসিকতা। প্রথমদিকে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। কারণ পণ্যের বাজার ঘুরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন; নিজে কাজ শুরু করে বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো ভিন্ন। কিভাবে বাজার ধরতে হবে, বিশেষ করে রপ্তানি করতে হবে সেটা সম্মন্ধে বাস্তব ধারণা ছিলো না তার। ‘আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম। আমি জানতাম না কিভাবে রপ্তানির অনুমোদন নিতে হয়, ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়, বায়ার হ্যান্ডেল করতে হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিলো আমি পারবো। প্রতিটি ধাপ পেরোনোর সাথে সাথে সব কিছু সহজ মনে হতে থাকে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে যখন একটি রপ্তানি আদেশ পাই তখন উৎসাহ ও সকলের সহযোগিতা আরো বেড়ে যায়। পরিবারের অন্যরাও আমার পাশে দাঁড়ায়। এরপরে আরো ২টি রপ্তানি আদেশ পাই। বর্তমানে একটি আদেশ রয়েছে’। মূলত ইতালি ও আয়ারল্যান্ডে পণ্য রপ্তানি করেন তিনি।
এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি প্রথা চালু হয়ে গেছে। সেটা হলো আমরা পড়ালেখা করি চাকরির জন্য। এটা শেষ করতে করতে আমরা ২৭-২৮ বছর বয়সে পৌছাই। ততদিন বাপের ‘অন্ন ধংস’ করতে থাকি। অথচ এই সময়টাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কাজ করারও সুযোগ রয়েছে। এতে যেমনি সাবলম্বী হওয়া যায় তেমনি পরিবারকেও সহায়তা করা যায়। একইসাথে নিজের মনোবলও বাড়ে। অন্যদের কর্মসংস্থানও তৈরি হয় এর মাধ্যমে।’
‘আমাদের বড় একটি মানসিক সমস্যা হলো, আমরা মনে করি ব্যবসা করতে অনেক বেশি টাকা লাগে। এই টাকার যোগান কিভাবে দিবো সেই চিন্তা করতে গিয়ে মনোবল নষ্ট করে ফেলি আমরা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের এক লাফে অনেক বড় মাপের ব্যবসায়ী হতে হবে সেই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি মাত্র ১ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে মূলধন রয়েছে ৫ লাখ টাকারও বেশি। অথচ ব্যবসার বয়স মাত্র ২ বছর পার হলো। তাই যার কিছু করার ইচ্ছা আছে, তার উচিত যতটুকু সামর্থ আছে সেটুকু নিয়েই মাঠে নেমে পড়া। তবে ব্যবসা করার আগে অবশ্যই তার সম্ভাব্যতা এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। আর অবশ্যই পণ্যের মানের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে। মান ভালো হলে ক্রেতা আপনার কাছে আসবেই।’ বাধা বিপত্তির প্রসঙ্গে এই নারী উদ্যোক্তা জানান, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবার থেকে একটু বেশিই বাঁধা থাকে। তারপরও নতুন উদ্যম নিয়ে মেয়েদেরকে এগিয়ে যেতে হবে’। উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন,‘বর্তমানে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো- সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া। যদি তরুণ উদ্যোক্তাগণকে ৪-৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ দেয়া হয়, তাহলে তারা আরো সহজে ব্যবসা করতে সক্ষম হবেন।’