মহররম মাসের রোজাঃ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা। (মুসলিমঃ ১/৩৬৮)
হজরত আলী (রাঃ)- কে জিজ্ঞেস করা হলো, রমজান মাসের রোজা ব্যতীত রাসুল (সাঃ) আর কোনো মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কি? হরজত আলী (রাঃ) বলেন, এ বিষয়ে আমি এক ব্যক্তিকেই রাসুল (সাঃ)-এর কাছে প্রশ্ন করতে দেখেছি। সে সময় আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাদের রমজান মাস ব্যতীত আর কোনো মাসের রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে থাকেন কি?
রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, রমজানের পর যদি তোমরা রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রোজা রাখো। কেননা এটি আল্লাহর মাস। এই মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা একটি সম্প্রদায়ের তওবা কবুল করেছেন। (আশা করা যায়) সেদিন অন্যান্য সম্প্রদায়ের তওবাও কবুল করা হবে। (তিরমিজি শরিফঃ ৭৪১)
আশুরার রোজার বিধানঃ হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) আমাদের (রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে) আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। আর এ বিষয়ে তিনি নিয়মিত আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না, নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিমঃ ১১২৮)
হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে রাসুল (সাঃ)-কে সেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখিনি। (বোখারিঃ ২০০৬, মুসলিমঃ ১১৩২)
* হজরত হাফসা(রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) চারটি কাজ কখনো ছেড়ে দিতেন না। এর মধ্যে একটি হলো আশুরার রোজা।
* হজরত আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) বলেন, আশুরার দিন ইহুদিরা ঈদ পালন করত। রাসুল (সাঃ) সেদিন সাহাবিদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।( বোখারিঃ ২০০৫, মুসলিমঃ ১১৩১)
* হজরত আবু কাতাদা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তিনি এর ফলে পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিমঃ ১১৬১, তিরমিজিঃ ৭৪৯)
* হজরত সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে লোকজনের মধ্যে এ মর্মে ঘোষণা দিতে আদেশ করলেন, যে ব্যক্তি আহার করেছে, সে যেন দিনের অবশিষ্ট অংশে পানাহার বর্জন করে। আর যে ব্যক্তি আহার করেনি, সে যেন রোজা পালন করে। কেননা আজকের দিন ‘আশুরার দিন।’ (বোখারিঃ ২০০৭, মুসলিমঃ ১১৩৫)
আশুরার রোজা কয়টি?
ইসলামী শরিয়তে আশুরার রোজা দুটি। মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ। তবে কোনো কোনো আলেম এ বিষয়ে বর্ণিত সব হাদিসের ওপর আমল কার্যকর হওয়ার জন্য বলেন, মহররমের ৯, ১০ ও ১১ তারিখ তিন দিনই রোজা রাখবে। সবার জন্যই নিম্নোক্ত হাদিস প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন (মহররমের দশম দিবস) রোজা রাখো এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো। আশুরার আগে এক দিন বা পরে এক দিন রোজা রাখো। (মুসনাদে আহমদঃ ১/২৪১, সহিহ ইবনে খুজাইমাঃ ২০৯৫)
মহররম মাসে যাদের ক্ষমা লাভ মুসলিম উম্মাহর অনুপ্রেরণা
মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণমাস হলো মহররম। আরবি হিজরি সালের প্রথম মাসও এটি। কুরআনুল কারিমে এ মাসকে হারামের অন্তর্ভূক্ত করে এর মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ১০ মহররম তথা আশুরার ঐতিহাসিক বিয়োগান্তক ঘটনা বিশ্ববাসীর আবেগ ও অনুভূতিতে ইসলামের পূনর্জীবনী শক্তি ও সাহস হিসেবে স্থায়িত্ব লাভ করেছে।
এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহসহ খুন-খারাবি তথা রক্তপাতকে হারাম করে তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ মাসের ফজিলত অনেক বেশি। কারণ কুরআনের অনেক ঘটনার সমাপ্তি এবং ক্ষমা এ মাসেই সংঘটিত হয়েছিল। যার কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো
হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের মুক্তিঃ আল্লাহ তাআলা সুরা আম্বিয়ায় ঘোষণা করেন- ‘এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেন- তুমি ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গোনাহগার।’ (সুরা আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৭)
আল্লাহ তায়ালা হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে মুসিল অঞ্চলের নিনওয়া নামক স্থানের নবি করে পাঠান। তিনি সেখানে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করেন। মানুষ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেনি।
এ কারণে হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য সমুদ্র পাড়ে গিয়ে নৌকায় আরোহন করলেন। নৌকা সমুদ্রে কিছুদূর যাওয়ার পর ঝড়ের কবলে পড়ে গেল। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো নৌকা থেকে একজনকে ফেলে দেয়া হবে।
সেখানে একে একে তিনবার লটারি করা হলো কাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হবে। তিন বারই লটারিতে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের নাম ওঠে। কিন্তু লোকজন তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে অসম্মতি জানায়। হজরত ইউনসু আলাইহিস সালাম সবার হেফাজতের কথা ভেবে নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নদীতে লাফিয়ে পড়লেন।
আল্লাহ তাআলা হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে হেফাজত করার জন্য ‘বাহরে আখদার’ তথা সবুজ সাগর থেকে একটি বিরাটাকার মাছ পাঠিয়ে দিলেন। মাছটি পানি ফেড়ে এসে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামকে পেটে ধারণ করে।
আল্লাহর নির্দেশে মাছ তাঁর মাংস খেল না। তার হাঁড় ভাঙাসহ কোনো ক্ষতি করল না। এ মাছের পেট ছিল তাঁর জন্য কয়েদখানা। মাছের পেটে তিনি আল্লাহর তাসবিহ শুনে তাঁর সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।
সিজদায় পড়ে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম বলেন- ‘হে আল্লাহ আমি এমন একস্থানে আপনার সিজদা করছি। যে স্থানে কেউ কোনো দিন আপনাকে সিজদা করেনি।’
হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৮) আর হজরত ইউনুছের মুক্তির এ দিনটি ছিল মহররম মাসের ১০ তারিখ।
হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের মুক্তিঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের কথাও কুরআনে তুলে ধরেছেন। হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে আল্লাহ আর্থিক, দৈহিক ও সন্তানের দুঃখ-কষ্টে পতিত করেন। তার ধন-সম্পদ জীব-জন্তু, ক্ষেত-খামার, বাগ-বাগিচা সবই ছিল। তাঁর ওপর আল্লাহর পরীক্ষা আসে, এবং তার সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ দেহ কুষ্ঠরোগে ভরে যায়।
আল্লাহর নিকট তিনি দোয়া করেন; তাঁর দোয়া আল্লাহ কুরআনে তুলে ধরে বলেন- ‘এবং স্মরণ করুন আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন; আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। (সুরা আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৩)
অতপর আল্লাহ তাআলা হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করে তার সমুদয় সম্পদ, স্ত্রী-সন্তানদের পুনরায় দান করেন। তাও কুরআনে উল্লেখ করে বলেন- ‘অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত আর এটা এবাদত কারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৪) তাও ঘটেছিল এ মহররম মাসে।
পৃথিবীর আদি হতে শুরু হয়ে কারবালার ঘটনা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অগণিত অসংখ্য ত্যাগ ও ক্ষমার নজির মুসলিম উম্মাহর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করেছেন।
এ পবিত্র মাসেই কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত সংঘটিত হয়েছিল। এ মাস মুসলিম উম্মাহর ত্যাগ, ক্ষমা, শিক্ষা গ্রহণের মাস। এ মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহর কুরআন ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত যে ‘মুহররম মাগফিরাতের মাস।’ এ মাসেই আল্লাহ তায়ালা অনেক নবি-রাসুলকে বিভিন্ন বিপদ থেকে হেফাজত করেছেন। আবার অনেককেই আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন।
যেহেতু মুহররম মাসেই আল্লাহ তাআলা নবিদের ক্ষমা করেছেন। অসংখ্য কল্যাণের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ মাসে যদি মুসলিম উম্মাহ যথাযথ পবিত্রতা ও মর্যাদার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করেন; তবে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদিকেও ক্ষমা করে তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কবুল করতে পারেন।
মুহররম মাসে আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফেরাত লাভ করার সুবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই এ পবিত্র মাসটি শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর দরবারের কঠিন কঠিন বিপদ-মুসিবত থেকে ক্ষমা প্রার্থণা করা সবার জন্য একান্ত আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এ পবিত্র মাসে মাগফেরাত ও ক্ষমা লাভ করার তাওফিক দান করুন এবং কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।