এম এম রহমাতুল্লাহঃ কেনাকাটা, দর্শনীয় স্থান, হাই-এন্ড রিসোর্ট, সাদা বালির সৈকত, কৃত্রিম দ্বীপ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিরাপত্তা প্রতি বছর লাখ লাখ ট্যুরিস্ট আকৃষ্ট করে। আরব আমিরাত সরকার নিকট ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান করার জন্য দেশটির পর্যটন শিল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে ইউএই বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় নাম। সংযুক্ত আরব আমিরাত দেশটার নতুন যাত্রার হ্রস্ব ইতিহাস আপনাদের আগ্রহব্যঞ্জক হতে পারে। সাতটি শেখশাসিত আমিরতন্ত্র ব্রিটিশের আশ্রিত ছিল। তাদের মধ্যে আবুধাবি আয়তনে ৮৭ শতাংশ। তার পরই আসে দুবাই। আরো পাঁচটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শেখতন্ত্র হচ্ছে শারজা, আজমান, ফুজায়েরা, রাস আল খাইমা এবং উম আল কায়াম। এই সংযুক্ত আরব আমিরাতেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরো কয়েকটি দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থান নিয়েই এ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীটি সাজানো হয়েছে।
‘বুর্জ খলিফা’ আরবি শব্দ, এর বাংলা অর্থ ‘খলিফার টাওয়ার’। দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম ভবনটির উদ্বোধন করেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে ভবনটির নামকরণ করেন বুর্জ খলিফা। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারী আরব আমিরাতের দুবাই শহরে অবস্থিত এই ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। নির্মানাধীন সময়ে এই ভবনটিকে সবাই ‘বুর্জ দুবাই’ নামে চিনলেও উদ্বোধনের সময় নাম পরিবর্তন করে রাখা ‘বুর্জ খলিফা’। এই ভবনটির আরেক নাম ‘দুবাই টাওয়ার’। বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ গ্লাস ও স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো একসাথে রাখতে ১৭টি স্টেডিয়ামের সমান জায়গা প্রয়োজন হবে। ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ ইট-বালি-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে ১২৮৩ মাইল লম্বা দেওয়াল তৈরি করা যাবে। আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়। রকেটের মতো দেখতে ২০৬ তলাবিশিষ্ট ‘বুর্জ খলিফা’র মোট উচ্চতা ২,৭১৭ ফুট। ছয় লাখ বর্গফুটবিশিষ্ট এই ভবনে একসঙ্গে ১২ হাজারেরও বেশি লোকের সমাবেশ হতে পারে। বুর্জ ভবনে ৫৪টি এলিভেটর বা লিফট আছে। এগুলোর গতি ঘণ্টায় ৪০ মাইল। সম্পূর্ণ ভবনটি তৈরি করতে মোট ব্যয় হয় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ এগার হাজার ছয়শত সত্তর কোটি টাকা। ‘বুর্জ খলিফা’র বাইরের প্রাঙ্গনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা রয়েছে। এই ফোয়ারটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে বাংলাদেশী টাকায় এক হাজার ছয়শত একানব্বই কোটি আটত্রিশ লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার। ‘বুর্জ খলিফা’ ভবনটি তৈরি করতে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। বিলাস বহুল এই ভবনের একেকটি কামরা কেনার জন্য বর্গ মিটার প্রতি ক্রেতাদের গুনতে হয়েছে গড়ে ৩৭,৫০০ মার্কিন ডলার। এত উচ্চ মূল্য থাকা স্বত্বেও দুই বছরের মধ্যেই ৯০০ কামরার প্রায় সবকটিই বিক্রি হয়ে গেছে। বুর্জ খলিফায় প্রতি বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া অফিস-আদালতের জন্য চার হাজার ডলার বা দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা।বুর্জ খলিফার” নির্মাণকাজ ২০০৪ সালে শুরু হয় এবং ২০০৯ সালে ভবনের কাজ শেষ হয়। সুবিশাল এই ভবনটি তৈরীতে ইট,বালি,রড,সিমেন্ট ছাড়াও গ্লাস ও স্টিল ব্যবহার করা হয়। ভবনটিতে যত পরিমাণ গ্লাস এবং স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো একসাথে রাখতে প্রায় ১৭টি স্টেডিয়ামের সমান জায়গা দরকার হবে। আর যে পরিমাণ ইট-বালি-সিমেন্ট খরচ হয়েছে তা দিয়ে প্রায় ১২৮৩ মাইল লম্বা দেওয়াল বানানো যেত। বুর্জ খলিফার উচ্চতা ২৭১৭ ফুট বা ৮১৮ মিটার, যা প্রায় আধা মাইল দীর্ঘ। সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে প্রায় ৬০ মাইল বা ৯৫ কিলোমিটার দূর স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ১৬০ তলাবিশিষ্ট ভবনটি দেখতে রকেটের মতো। মজার আরেকটি বিষয় হলো ভবনটির নিচতলা থেকে সর্বোচ্চ তলার মধ্যে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে। ভূমি থেকে ভবনটি এতো উচু যে ভবনের উপরতলার লোকজন সূর্যাস্তের পরও দুই মিনিট সূর্যটাকে দেখতে পায়। তাই মুসল্লিরা রমজান যখন ইফতার করে তার ২মিনিট পর উপরতলার মানুষজন ইফতার করেন।
বুর্জ খলিফা ভবনটিতে ৫৪টি লিফট বা এলিভেটর রয়েছে যার গতি ঘন্টায় ৪০ মাইল। বুর্জ খলিফা ভবন নির্মাণে লোহা ব্যবহার করা হয় মাত্র ৪ হাজার টন যা পরিমাণে ছিল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের অর্ধেক। যদিও উচ্চতায় বুর্জ খলিফা এম্পায়ার স্টেট এর দ্বিগুন। বুর্জ খলিফায় আমেরিকানদের বসবাসের অগ্রাধিকার বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তাদের জন্য এই ভবনের ৯ থেকে ১৬ তলা পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া ভবনের ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ৯০০ অ্যাপার্টমেন্ট আছে ভবনে। ১৫৮তলায় আছে একটি মসজিদ; ৪৩তম এবং ৭৬তম তলায় আছে দুটি সুইমিং পুল। আরো আছে ১৬০ কক্ষবিশিষ্ট একটি হোটেল। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট অফিস রয়েছে বুর্জ খলিফার বিভিন্ন ফ্লোরে। বুর্জ খলিফার ১৫৯ তলা পর্যন্ত অনায়াসে যাওয়া সম্ভব হলেও, এর উপরে যেতে হলে আপনাকে অক্সিজেন সাথে নিয়ে যেতে হবে। অনেক উঁচুতে অবস্থান হওয়ার কারনে সেখানে অক্সিজেন পৌছাতে পারে না। ভবনের ১৬০ থেকে ২০৬ তালা পর্যন্ত কেউ বাস করে না। এই ফ্লোরগুলো কারিগরি কাজের জন্য ব্যবহার হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে- বুর্জ খলিফা থেকে সূর্য সবার আগে দেখা যায়! বুর্জ খলিফায় বসবাসরত অধিবাসীরা দিনের শুরুতে সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে আগে সূর্য দেখেন এবং দিনের শেষেও সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে তারা বেশি সময় সূর্য দেখতে পান। এ জন্য তাদের কাছে দিনের পরিধি অনেক বেশি। আর একটি চমকপ্রদ তথ্য হোল – বুর্জ খলিফা টাওয়ারটি আত্মহত্যার জন্য রেকর্ড গড়েছে। ভবনটি চালু হওয়ার ১৮ মাস পর জনৈক ব্যক্তি এই অট্টালিকার ১৪৬ তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। লাফিয়ে পড়ার পর লোকটি ৩৮ তলায় এসে পড়ে নিহত হন। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার রেকর্ড। এর পরও অনেকেই এই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। ফলে অনেকেই ভবনটিতে অভিশাপ আছে বলে মনে করেন।
ভবনের বাইরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিশাল পার্ক। ভবনটির চারপাশে রয়েছে ৭.৪ একরের অপরুপ সুন্দর উদ্যান আর ৩০ একর আয়তনের কৃত্রিম হ্রদ। বুর্জ খলিফার বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিন ৯,৪৬,০০ লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে যা ১০০ কিমি. পরিমান অভ্যন্তরীণ পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রনের জন্য ৩৪ কিমি. এবং জরুরি অগ্নি নিয়ন্ত্রনের জন্য রয়েছে আরও ২১৩ কিমি. পরিমান বিশেষ পাইপ লাইন ব্যবস্থা। বিশাল এই ইমারতটি একসঙ্গে ২৫ হাজার লোকের ভার সইতে পারবে। আপনার যদি কখনও দুবাইতে যাওয়ার সুজগ হয়, তাহলে অবশ্যই বুর্জ খলিফা থেকে ঘুরে আসার চেস্টা করবেন। তবে আপনি কিন্তু চাইলেই এই ভবনে যখন খুশি ঘুরতে যেতে পারবেন না! স্বশরীরে ভবনের ভেতরে যেতে হলে খরচ করতে হবে পকেটের টাকা। ১৬০ তলা ভবনের মধ্যে প্রায় এক শ’ তলায় যেতে টিকেট নেয় ২শ’ দিরহাম, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আর ১৬০ তলায় যেতে হলে অনুমতি নিয়ে আরও অনেক বেশি দিরহাম গুনতে হয়। তাই ভবনে প্রবেশের আগে পকেটে পয়সা আছে কি না দেখে নিবেন।
শেখ জায়েদ মসজিদ: সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থানের লিস্টের পরবর্তী স্থানে রয়েছে শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ (Sheikh Zayed Grand Mosque)। মসজিদটি অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের একটি আধুনিক নিদর্শন। এর অবস্থান আবুধাবি শহরে। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় মসজিদ। মসজিদটি ৩০ একর জমির উপর নির্মান করা হয়েছে এবং এখানে একসাথে ৪০০০০ জন মুসুল্লি নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের অভ্যন্তরে সোনা, মোজাইক টাইলস, কাচ এবং মার্বেলের প্রচুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আর বাইরের দিক তৈরি স্বেতপাথরের। আর কিবলার দেয়ালে চোখে পড়বে আল্লাহ্’র ৯৯ টি নাম।
আবুধাবিকে যেভাবে বদলে দিয়েছেন শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান
লোকটা প্রায় আজীবন নিরক্ষর ছিলেন, শেষ বয়সে কোনো রকমে নাম সই করতে শিখেছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন আর দূরদৃষ্টির কথা সবার মুখে মুখে, তার স্মৃতি আবুধাবির সব নর-নারীর হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবে আরো বহু যুগ। তিনি ছিলেন শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের সম্বন্ধে একটা অনুষ্ঠানের মাল-মসলা সংগ্রহ করছিলাম। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইলি যুদ্ধের জের ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এক লাফে বহু গুণ বেড়ে যায়। উপসাগরীয় দেশগুলো পেট্রো-ডলারের পাহাড় ব্যবহার করে তখন উন্নয়নের কাজে হাত দিয়েছে। তাদের নিজেদের জনবল খুবই নগণ্য। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে তারা শ্রমিক আমদানি করছে। বাংলাদেশ থেকে হাজারে হাজারে লোক আসছিল তখন এসব দেশে। এখানে-ওখানে নতুন কতগুলো অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে মূলত বিদেশী বিশেষজ্ঞদের বাসস্থান হিসেবে। আদিবাসী বেদুইন আরব তখনো তাঁবুতে বাস করে। শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের পরিবার বাস করত দেয়ালঘেরা একটা জমিতে তৈরি কয়েকটা একতলা ঘরে।
আবুধাবির ঘুমে-ঝিমোনো জীবনে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল তখন সড়ক-মহাসড়ক তৈরির প্রাণচাঞ্চল্য। দুই ক্যারেজবিশিষ্ট প্রশস্ত সড়কগুলোর চৌহদ্দি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সব তৎপরতা মাঝের জায়গাটুকুতে। দূর-দূরান্ত থেকে বাড়ন্ত খেজুরগাছ এনে সেখানে সমান দূরত্বে সারি করে লাগানো হয়েছে। অবশিষ্ট স্থানে লাগানো হয়েছে সবুজ ঘাসের চাপড়া। শোনা যায়, সেসব চাপড়া আমদানি করা হয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে। শত শত পাকিস্তানি শ্রমিক রাবারের হোজ দিয়ে সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্তের অনেক পর পর্যন্ত পানি দিচ্ছে সেই ঘাসে এবং খেজুরগাছের চারায়। আরো কোথাও কোথাও সারভর্তি শত শত লরি দাঁড়িয়ে। শ্রমিকরা দুই সারি নিচু কংক্রিটের রেলিংয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সার ঢালছে। এখানেও লাগানো হবে খেজুরগাছ আর সবুজ ঘাস। তারপর দু’পাশের সড়ক-মহাসড়ক তৈরি হবে। স্বল্প জনসংখ্যার দেশ, ঘরবাড়িও কম। কী হবে এত সব সড়ক তৈরি করে? আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ তার দেশের মরুভূমিতে একটা সবুজ আর সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। খেজুরগাছ আর ঘাসের মতো আরো বহু গাছ পরে লাগানো হয়েছে। বেশির ভাগই বিদেশী। বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদরা গোড়ায় বহু আপত্তি ও নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন যে, এই গরম মরুভূমির দেশে সেসব গাছ টিকবে না। শেখ জায়েদ শোনেননি সেসব নিষেধ। গাছ আমদানি করা হয়েছে। উপসাগরের নোনা পানি লবণমুক্ত করে দেশের তখনকার চাহিদার বহু গুণ মিঠাপানি তৈরি হয়েছে। সে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে অঢেল। সেসব গাছ আরো বড় হয়েছে এখন। এখন আর সকাল-সন্ধ্যা হোজে করে পানি দিতে হয় না, ছোট ছোট ফুটো বিশিষ্ট রাবারের নল মাটির সামান্য নিচে পুঁতে দেয়া হয়েছে, সেসব ফুটো দিয়ে প্রয়োজনমতো পানি আসে ঘাসে ও গাছে, তবে রোদের তাপে উবে গিয়ে পানির অপচয় হয় না। তা ছাড়া গাছ-গাছড়ার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টিও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ হারিয়ে ব্রিটেন তখন আর ধনী কিংবা শক্তিশালী দেশ ছিল না। আবুধাবির প্রতিরক্ষার জন্য সৈন্য মোতায়েন রাখা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবুধাবিতে কিছু খনিজ তেল আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম তখন ব্যারেলপ্রতি তিন-চার ডলার। তার থেকে কতই বা আয় হবে? ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শেখ জায়েদ তাদের বিরত করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এই এলাকাটার ওপর বিদেশীদের নজর আছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের। তারা যদি একে একে সাতটি শেখতন্ত্রই দখল করে নেয়? ব্রিটিশদের পরামর্শে শেখ জায়েদ সাতটি অঞ্চলকে একীভূত করে একটা ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগ নিলেন। অন্য শেখরা নানা অজুহাত দেখিয়েছিলেন। দুবাইয়ের শাসক শেখ রশিদ আল মাখতুম বললেন, তার এলাকায় মজুদ তেলের পরিমাণ সামান্য, দুবাইয়ের চলবে কী করে? শেখ জায়েদ আশ্বাস দিলেন, বললেন, দৈনিক এক লাখ ২০ হাজার ব্যারেল করে তেল তিনি দেবেন দুবাইকে। যাক, শেষ পর্যন্ত ফেডারেশন গঠিত হলো। স্থির হলো যে, আবুধাবির শাসক বরাবর প্রেসিডেন্ট হবেন। দুবাইয়ের শাসক হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিটিশরা চলে গেল ১৯৭১ সালে। কিন্তু কপাল আর কাকে বলে! কিছু দিনের মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া গেল আবুধাবিতে যে পরিমাণ তেল আছে বলে আগে হিসাব করা হয়েছিল প্রকৃত মজুদ তার বহু গুণ বেশি। আরো কী আশ্চর্য! ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পরাজিত আরবরা তেল রফতানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম এক লাফে ২৫ গুণেরও বেশি বেড়ে যায়। তখন থেকে খনিজ তেলের নতুন নাম হয়েছে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ কালো সোনা। দুবাই স্থির করল তেলের আয় দিয়ে তার চলবে না। গোড়া থেকেই সে পর্যটন শিল্পের দিকে মনোযোগ দেয়। কী প্রয়োজন পর্যটক আকর্ষণের জন্য? চাই যথেষ্ট ভালো হোটেল আর শপিং মল। বিদেশী শ্রমিকদের দিয়ে দিন-রাত কাজ করিয়ে সেসব তৈরি হলো। পর্যটকদের আসা-যাওয়ার জন্য সুদক্ষ এয়ারলাইন এমিরেটস গড়ে উঠল। দুবাই বিমানবন্দর এখন আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের একটা প্রধান জংশন। কিন্তু কেন আসবে পর্যটকরা? পশ্চিমের ধনী দেশগুলো আবার শীতের দেশও বটে। সেসব দেশের মানুষ একটু রোদ চায়, গায়ে তাপ লাগাতে চায় এবং তারা খেলাধুলা পছন্দ করে। আমিরাতে রোদ সারা বছর পাওয়া যায় এবং মোটামুটি উষ্ণ এখানকার আবহাওয়া। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে এবং প্রায়ই কৃত্রিম উপায়ে দুবাইতে ক্রিকেট, টেনিস, ফুটবল, গলফ, ঘোড়দৌড়, মোটর রেসিং ইত্যাদি বহু খেলাধুলার চমৎকার আয়োজন করা হয়েছে। সম্প্রতি আবার সারা বছর ধরে আইস স্কিয়িং করার জন্য কৃত্রিম বরফজমা পাহাড়ের ঢালু তৈরি হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে এবং পশ্চিমের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের পুরস্কার দিয়ে এখন এসব ক্রীড়ার বিশ্ব প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগী আর দর্শক মিলে বহু হাজার পর্যটক আসে একেকটি প্রতিযোগিতায়।
উষ্ণ আবহাওয়া, শপিংয়ের স্বর্গ রাজ্য, সব রকমের খেলাধুলার অফুরন্ত সুযোগ সবচেয়ে বড় কথা, আয়কর থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি কারণে বহু বিদেশী দুবাইতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসতি করতে শুরু করেছে। তাদের চাহিদা মেটাতে বহু সুউচ্চ আর সুদর্শন ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে। উপসাগর থেকে জমি উদ্ধার করে খেজুরের ডালের আকৃতিতে অভিজাত বসতি এলাকা গড়ে উঠেছে। খেজুরের সবচেয়ে উঁচু পাতা যেখানে থাকার কথা সেখানে তৈরি হয়েছে অপূর্ব সুন্দর আর বিলাসবহুল প্যালেস হোটেল। পাম জুমায়েরা নামক এই নতুন বসতির বাড়ির মালিকদের মধ্যে আছেন ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহ্যাম ও তার পপতারকা স্ত্রী পশ-স্পাইস ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম। এত সব সুবিধার কারণে কালো টাকার মালিক বহু বিদেশী বসতি করেছে দুবাইতে। শুনেছি বলিউডের বহু চিত্রতারকাসহ বিত্তশালী ভারতীয়রা এখানে সম্পত্তি কিনেছেন, বসতি করছেন। সেই সাথে বহু ‘গ্যাং-স্টারও’ নাকি এসেছে। মুম্বাইয়ের সঙ্গীত তারকা আশা ভোঁশলের বাড়ি আছে এখানে। ব্যবসায়ও ফেঁদেছেন তিনি। তার দুবাইতে দু’টি এবং আবুধাবিতে একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ আছে, সবগুলোর নামই ‘আশা’। আবুধাবিতে শেখ জায়েদ কিন্তু এসব উচ্ছলতার মধ্যে যাননি। গোড়া থেকেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন : তেলের টাকা বেশি দিন থাকবে না; অতএব সে টাকার অপচয় করা চলবে না, এমনভাবে সে অর্থ ব্যয় ও বিনিয়োগ করতে হবে যাতে তেলসম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরে আবুধাবির মানুষ তার থেকে উপকৃত হতে পারে। মূলত অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য তিনি বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনেছেন চড়া বেতনে। কিন্তু দেশের ছেলেমেয়েদের সরকারি ব্যয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। যার যেখানে খুশি এবং যে শিক্ষাক্রম খুশি উচ্চশিক্ষার জন্য কারো অর্থাভাব হয়নি।
সুউচ্চ আর নয়নাভিরাম অট্টালিকা অজস্র তৈরি হয়েছে আবুধাবিতেও। কিন্তু বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আর হাসপাতাল নির্মাণের দিকে। প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় আর নিউইয়র্ক বিশ্বদ্যিালয়ের শাখা তৈরি হচ্ছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপকরাও মাঝে মধ্যে আসবেন শিক্ষা দিতে। ক্রীড়া স্টেডিয়াম আর আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ডায়াবেটিক মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতাল ভবনটিতে কয়েকজন বিদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক নিয়োগ করা হয়েছে এ হাসপাতালে। তবে মূল সড়কের অদূরে, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ বাস করে এবং বাজারগুলো আছে, সেখানে রাস্তাঘাট সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়নি বলেই আমার মনে হলো। পার্কিংয়ের যথেষ্ট জায়গা নেই, যানজট লেগেই থাকে। শেখ জায়েদ তার স্বপ্নের নগরীর পরিকল্পনার জন্য দু’জন স্থপতি ডেকেছিলেন। একজন মিসরীয়, অন্যজন জাপানি। জাপানি স্থপতি বলেছিলেন, বিশাল পরিসরে আবুধাবির মূল ভূমিতে নগরীর ভিত্তি স্থাপন করা হোক। অন্য দিকে মিসরীয় স্থপতি পরামর্শ দিলেন, কতই আর বড় হবে এ নগরী? মূল ভূমিসংলগ্ন দ্বীপটার (বর্তমানে আবুধাবি নগরী যেখানে অবস্থিত) ওপর তৈরি করাই বেশি সমীচীন হবে। শেখ জায়েদ ভেবেচিন্তে মিসরীয় স্থপতির পরামর্শ শোনাই বেশি যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করেছিলেন। তিনি নাকি মনে করেছিলেন যে, মিসরীয় আরব স্থপতি আরব চরিত্র এবং আরবদের মনঃস্তত্ত্ব জাপানিদের চেয়ে বেশি ভালো বুঝবেন।
শেখ জায়েদের দূরদৃষ্টিতে এখানে ভুল হয়েছিল। প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই দ্বীপে আর স্থানসঙ্কুলান হচ্ছিল না। বিদেশ থেকে বড় বড় পাথর এনে উপসাগরের কূলে ফেলা হলো। তারপর আমদানি করা বালু আর মাটি। এভাবে সাগর ভরাট করে নগরীর পরিসর বৃদ্ধি করা শুরু হলো। সেই যে শুরু হলো সেটা এখনো চলছে। এখানে-সেখানে সমুদ্রে স্থলভাগ সৃষ্টি করা হচ্ছে, নগরীর পরিসর দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাসক ও আমিরাতের প্রেসিডেন্ট বেশ ক’বছর আগেই সেই ছোট্ট ডেরায় বাস করা বন্ধ করেছেন। তার জন্য সুরম্য বহুতল প্রাসাদ তৈরি হয়েছে। সে প্রাসাদ দেখতে ইতোমধ্যেই বিদেশী পর্যটকদের আগমন শুরু হয়েছে। আরো একাধিক প্রাসাদ আছে বর্তমান শেখ ও প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের। তার ভাইদের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যও তৈরি হয়েছে ছোটখাটো প্রাসাদ। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের অদূরে সমুদ্র থেকে ছিনিয়ে আনা জমির ওপর তৈরি হয়েছে আবুধাবি প্যালেস হোটেল মূলত বিদেশী রাজা-রাজড়া ও প্রেসিডেন্টদের জন্য। সুতরাং অত্যন্ত বিলাসবহুল। অবশ্য চৌহদ্দির মধ্যে একটা বাড়তি ভবনে বাণিজ্যিক হোটেলও আছে প্রতি রাতে অন্তত আড়াই-তিন হাজার ডলার রুম ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য যাদের আছে তাদের জন্য। তবে সীমিত বিত্তের পর্যটকদের জন্যও চার-পাঁচতারা হোটেল অনেক হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনের দু-চারটি করে হোটেল আছে। তা সত্ত্বেও ২০১০-২০৩০ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আরো ৪২টি পাঁচতারা হোটেল তৈরি হবে। এই ২০-সালা প্রকল্পের স্থপতি-মডেল দেখলে চোখ কপালে ওঠবে নিঃসন্দেহে।
শেখ জায়েদ মারা গেছেন অনেকদিন আগে। তারপর থেকে আবুধাবির শাসক এবং আমিরাতের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। কিন্তু তার কয়েক ভাই এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত। শেখ জায়েদের মৃত্যুর পর থেকে তারা একটু বেশি উচ্চাভিলাষী এবং উদ্যোগী হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের অনেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।বিভিন্ন সময়ে ফর্মুলা ওয়ান মোটর রেসিংয়ের সময় পর্যটকে টইটম্বুর হয়ে যায় আবুধাবি। নতুন একটা এয়ারলাইন (এতিহাদ) খুলেছেন তারা। অল্প সময়ের মধ্যেই এতিহাদ এয়ারলাইন্সের সুখ্যাতি হয়েছে দুনিয়াজোড়া। পর্যটকের ভিড় রয়েছে নগরীর অদূরে নির্মিত শেখ জায়েদ মসজিদদে। সৌদি আরবের বাইরে এটাই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সর্ববৃহৎ মসজিদ। যে মার্বেল দিয়ে সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিসৌধ তাজমহল তৈরি করেছিলেন সে ইতালীয় মার্বেল দিয়েই শেখ জায়েদের পুত্ররা তার স্মৃতিতে এ মসজিদটি তৈরি করেছেন। ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় হয়েছে। শেখ জায়েদের সমাধিও আছে এখানে। দিবারাত্রি ২৪ ঘণ্টা সেখানে কুরআন তেলাওয়াত হয়। কিন্তু সে সমাধি নিয়ে ধর্মীয় বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরব এ মসজিদের উদ্বোধন বর্জন করেছে, সৌদিরা কারো কবর বিশেষভাবে চিহ্নিত বা সুসজ্জিত করার বিপক্ষে। তাজমহলের স্টাইলে কয়েকটি গম্বুজ আছে এ মসজিদে। আগাগোড়া শ্বেত মার্বেলে তৈরি মসজিদে তাজমহলের অনুকরণে মূল্যবান পাথর দিয়ে লতা-পাতার কারুকার্য খোদিত হয়েছে, ভেতরে বিভিন্ন কক্ষে রঙিন মার্বেলের সিলিং আর ফ্লোরে মনোরম কারুকার্য। চার দিকের বিশাল বাগানে পূর্ণদৈর্ঘ্য বহু খেজুর গাছ এনে লাগানো হয়েছে। বাগানে ও বাইরের ফটক ইত্যাদির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি, কিন্তু বহু বিদেশী পর্যটক দেখেছি সেখানে। শেখ জায়েদ তেলসম্পদের অপচয় না করার যে নির্দেশ গোড়াতেই দিয়েছিলেন সেটা পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে। আবুধাবি তার তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ করছে। এ লক্ষ্যে মরহুম শেখ জায়েদ গোড়াতেই একটা আবুধাবি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি (আডিয়া) স্থাপন করেছিলেন। এ অথরিটি পৃথিবীর বহু দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় বহু ব্যাংকের বন্ড, ঘরবাড়ি-ইমারত, হোটেল, বন্দর ইত্যাদিতে অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন এয়ার লাইন্স কোম্পানী তাদের যাত্রাবিরতী দিয়ে থাকে দুবাইতে। তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকেই ক্রিকেটের শহর হিসেবে পরিচিতি রয়েছে শারজাহ আবু ধাবী ও দুবাই শহরের। সুযোগ পেলে আপনারাও ঘুরে আসতে পারেন বিশ্বের অন্যতম বিলাসিতার দেশ আরব আমিরাতে।
আয়তনে ছোট হলেও বিশ্বের অন্যতম বড় শ্রমবাজার আরব আমিরাতে এ মাসের শেষের দিকে সফরের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।