মো: মসিউল আযম: সেকালে খানেওয়ালাও ছিল, খিলানেওয়ালাও ছিল। বেশি খেতে পারার মধ্যে ছিল একটা কৃতিত্ব। যে মেহমান যত বেশি খেতে পারতেন, তাদের মেজবান তত বেশি আত্মতৃপ্ত বোধ করতেন। যেসব খানেওয়ালার কথা লিখছি এদের অনেকেই এখন পরলোকে। তাদের খাওয়ার কৃতিত্ব এখনো গ্রাম-গঞ্জের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। এখনকার যুগে বেশি খাওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, বরং যে বেশি খেতে পারে তাকে সবাই ‘পেটুক’ বলে। মুখে কিছু না বললেও হেয় চোখে দেখবে। এখন কেউ বেশি খেলে নিজেকে এক ধরনের অপরাধী ভাবেন।
সেকালে কোনো বাড়িতে আত্মীয়স্বজন গেলে ছাগল জবাই করে এবং নিজ পুকুরের মাছ খাওয়ানো ছিল একটি রেওয়াজ। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে এলে কমপক্ষে সাত দিন না থাকলে মেজবান খুশি হতেন না। এরপরও অনুরোধ আসত, আর দুটো দিন থেকে যান। আসা আপন ইচ্ছায়, আর যাওয়া পরের ইচ্ছায়- এটা ছিল রীতি। ভালো খেতে পারার সুনাম ছিল। মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা খামারপাড়া গ্রামের মমতাজ মিয়া ৭০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার ‘সাধারণ’ খাবার ছিল পাঁচ কেজি চালের ভাত। দিনে একবার খেতেন দুপুরে। গোসলের পর আহার। যদি কেউ তাকে দাওয়াত করত, বলতেন- তিন কাতার লোক খাওয়াতে পারলে তবে খাবো। প্রতিবারই তিনি বসতেন এবং খাবার খেতেন।
একবার স্থানীয় হাটে বড় কাঁঠাল বিক্রির জন্য আনা হয়েছে। এক একটি কাঁঠালের ওজন কমপক্ষে ৩০-৩৫ কেজি। কাঁঠাল বিক্রেতার সাথে মমতাজ মিয়া বাজি ধরলেন, এক কাঁঠাল তিনি একাই খাবেন। বিক্রেতার ধারণা ছিল না যে, একটি কাঁঠাল কেউ একা খেতে পারে। কাঁঠাল বিক্রেতার সাথে চুক্তি হলো, একটা কাঁঠাল একা খেতে পারলে বাকি কাঁঠালগুলোর কোনো দামই নেবেন না। মমতাজ মিয়া একাই সব কাঁঠাল খেয়ে সাবাড় করলেন। বাজিতে জিতে তিনি বললেন, ‘তোকে তিনটি কাঁঠাল দিতে হবে না। একটি কাঁঠাল দিলেই হবে।’ এখনকার দিনে ওই ধরনের একটি কাঁঠালের মূল্য হবে কমপক্ষে তিন শ’ টাকা।
আরেক দিনের ঘটনা। মমতাজ মিয়া একটি বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলা হাকিমপুর গ্রামে। তবারক মোল্লা প্রাক্তন চেয়ারম্যান হাকিমপুর ইউনিয়ন; তার মেজো ছেলে শিশু মোল্লার বিয়েতে। তবারক মোল্লা আত্মীয়স্বজনদের দুপুরে খাওয়ার জন্য পুকুর থেকে ১০-১২ কেজি ওজনের একটি রুই মাছ ধরেন। মমতাজ মিয়া ওই সময় পুকুরের কাছে ছিলেন। তিনি বললেন, একটি মাত্র রুই মাছ আমরা (আত্মীয়রা) কী খাবো, আর বাড়ির মানুষেরা কী খাবে ? এই কথা শোনার পর পুকুর থেকে আরো দু’টি বড় মাছ ধরা হয়। খাওয়ার সময় মমতাজ মিয়া একাই একটি রুই মাছ খেয়ে ফেলেছিলেন।
মমতাজ মিয়ার দুই ছেলে ‘বাপ কা বেটা’। অর্থাৎ তারাও বেশ খেতে পারতেন। ছোট ছেলে রফিক মেম্বার বেঁচে আছেন। তিনি অনায়াসে পাঁচ কেজি গোশত খেতে পারেন। মমতাজ মিয়ার বড় ছেলে ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় মেডিক্যালের স্টোর-কিপার। অফিসে যাওয়ার পথে সকালের নাশতা করতেন বড় দুটি শসা। একটি খেতেন, আরেকটি বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন। বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি ওষুধ ডেলিভারি নিতে এলে তার সোজাসাপটা কথা, হয় ৫০ টাকা দাও অথবা একবার খাওয়াও। এর বেশি চাহিদা তার ছিল না।
মাগুরা জেলার বরইতলা বিষ্টুপুর গ্রামের মোল্লাগোষ্ঠীর ভালো খেতে পারার জন্য নাম ডাক আছে। তারা এখনো মাথাপিছু এক কেজি চালের ভাত খেতে পারেন। যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামের মাওলানা আবদুল জলিল মেহেরুল্লা নগরীর এলাকায় খানেওয়ালা হিসেবে খ্যাতি আছে। দৌলতদিহি গ্রামের মরহুম হজরত আলী বিশ্বাস একদিন দাওয়াত দেন মাওলানাকে। হজরত আলী তাকে বলেন, ‘তুই নাকি বড় খেতে পারিস’? ঠিক আছে, আমি তোকে দাওয়াত দিলাম। অতিথি আপ্যায়নের জন্য হজরত আলী বিশ্বাস বাজার থেকে পাঁচ কেজি গরুর গোশত, চার কেজি খাসির গোশত, দুই কেজি কৈ মাছ ও দই কিনে বাড়ি ফেরেন। স্ত্রীকে বলেন, ভালো করে রান্নার জন্য। তিনি বলেন, মাওলানার খাওয়ার পর খাবার বাঁচলে আমরা খাবো।
যথারীতি মাওলানা খাবার শুরু করলেন। প্রথমে দুই কেজি কৈ মাছ শেষ করেন এবং গোশতের অর্ধেক একাই সাবাড় করে ফেলেন। খাদেমদের প্রায়ই বলেন- ‘এই তোমরা আপা (বিল মাঠের মধ্যে কুয়া) পালা দাও। অর্থাৎ আমার পেটের দিকে নজর দাও এবং সেই পরিমাণ খাবার পরিবেশন করো। ’
ছাতিয়ানতলা গ্রামে আরো খাদক ছিলেন। এর মধ্যে মরহুম বেলায়েত আলী দফাদার অন্যতম। তিনি সাধারণত নিয়মিত চার সের চালের ভাত খেতেন। বিয়ে করতে গিয়ে তিনি খাওয়া নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করেন। চৌগাছা উপজেলা মুক্তারপুর গ্রামে বিয়ে করতে গেলেন। শ্বশুরবাড়িতে খাঞ্চায় করে খাবার দেয়া হয়েছে। খাবায়ের ‘সামান্য’ পরিমাণ দেখে বরের মেজাজ বিগড়ে যায়। প্রস্রাব করার নাম করে তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা নিজ গ্রামে চলে আসেন। বর ‘পালানো’র খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। পরে সবাই ছুটে আসে বরের বাড়িতে। তার মায়ের সোজা কথা : আমার ছাওয়ালকে তোমরা মেরে ফেলেছ।’ সবাই প্রত্যক্ষ করেন বিশাল আকৃতির এক পাত্রে ভাত দেয়া হয়েছে, সেই ভাত হবু বর মহা-আনন্দে গিলছে।
মরহুম কিয়ামত আলী মণ্ডলের খেজুরের গুড় খাওয়ার কাহিনী এখনো প্রবাদ হয়ে আছে এলাকায়। সে ঘাস কাটতে যেত সঙ্গীদের সাথে পাশের বাগডাঙ্গা গ্রামে। কাজ শেষে বিশ্রাম নিত ওই গ্রামের ফটিক বিশ্বাসের বাড়ির পাশে গাছের নিচে। সেখানে তারা শীতকালে রসগুড় জ্বাল দিত জালাইয়ে। ফটিক ছেলেদের আমন্ত্রণ জানাত গুড় খাওয়ার জন্য। একদিন গুড় জ্বাল দেয়া শেষে ঠিলে (পাত্রে) ঢালতে যাবে এই সময় কেয়ামত বলে, গুড় ঢালা বন্ধ রাখো। আমি আজ গুড় খাবো বলে, প্রথমে আঙ্গুল দিয়ে শুরু, তারপর হাতের তালু দিয়ে, পরে গুড় কম হয়ে গেলে জালাই মুখের ওপর ধরে চার জালাই গুড় পুরোটাই ঢক ঢক করে পানি খাওয়ার মতো খেয়ে সাবাড় করে ফেলে।
ছাতিয়ানতলা গ্রামের জালাল সর্দার (বর্তমানে অব: সরকারি কর্মচারী) সালিসি বৈঠকে গিয়ে এক ধামা চালের ক্ষীর (জাও) একাই খেয়ে ফেলেন। সে আমলে ভালো খানেওয়ালা হিসেবে সবচেয়ে বেশি সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি।
মরহুম আব্দুল গফুর তরফদার প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রায় ১২ বছর। এখনো লোকমুখে তার খাওয়ার কাহিনী ছড়িয়ে আছে গ্রামগঞ্জে। আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে এ ধরনের কয়েকজন খ্যাতিমান খানেওয়ালার সাথে একই খাবার টেবিলে। ২০০৩ সালে গিয়েছিলাম ভাইজীর বিয়েতে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার কামার আলী গ্রামে। ভাইজী জামাইয়ের চাচা আবু দাউদ দফাদারের খাওয়ার দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে। ভদ্রলোক গত ২০০৪ সালে মারা গেছেন। আমাদের সাথে নাস্তা পর্বে তিনি একাই দু-তিন কেজি মিষ্টি খেয়ে ফেললেন দুপুরের খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে। এরপর খাওয়ার টেবিলে একাই দুই গামলা খাসির গোশত, দুই পাতিল দই খেয়ে ফেললেন। অন্যান্য খাবার তো আছেই। দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছ।
আমার চাচা শ্বশুর মরহুম আবদুল বারী। তিনিও ছিলেন একজন সমঝদার খানেওয়ালা ও ভোজনরসিক ব্যক্তি। তার প্রতিদিন খাবারের মেনুতে ছিল দুই কেজি গরুর দুধ (জ্বাল দেয়া সরসহ) ছয়টি সবরি কলা, সপ্তাহে দুই দিন পাঁচ গণ্ডা চালের রুটি ও একটি মুরগির গোশত। জামাই হিসেবে আমি সাথে খেতে বসলে বেশি না খেতে পারার জন্য মৃদু বকুনি এবং স্ত্রী ও শ্যালিকাদের রীতিমতো গাল খেতে হতো চাচা শ্বশুরের কাছে। কেন জামাইয়ের পাতে তরকারি উপুড় করে ঢেলে দেয়া হয়নি; কম করে কেন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, ইত্যাদি ছিল তার অভিযোগ।
খাওয়ার সুনাম আছে আমার আত্মীয়স্বজন মহলে আরো কয়েকজনের। এর মধ্যে আছেন আমার ভগ্নিপতির বড় ভাই, যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের মরহুম কেরামত মহলদার ও তার ছোট ভাই আমার ভগ্নিপতি মরহুম আবুল মহলদারের। ভগ্নিপতি কোনো বাড়িতে খাবার সাধলে উপেক্ষা করতে পারতেন না। সব খাবার তার সামনে গামলা ভরে আনলে তার মন ভরত। বড় ভাই কেরামত মহলদারের সাথে বিগত ’৭০ দশকে স্থানীয় ফকিরহাট বাজারে মিষ্টি খাবারের দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানদার প্লেটে করে ১০-১২ পিস মিষ্টি দিয়ে গেলেন; সাথে মিষ্টি খাওয়ার চামচ। তিনি দোকানিকে বললেন, ‘চামচ দিয়ে মিষ্টি খেয়ে সাধ মেটে না।’ প্লেটের মিষ্টি শেষ করে এবার ধরলেন মিষ্টির কড়াই। হাতে নিয়ে টপাটপ মিষ্টি খেয়ে দেখতে দেখতে কড়াই ভর্তি সব মিষ্টি শেষ করে ফেললেন। গুনে গুনে মিষ্টির দোকানিকে তখনকার ৮০ টাকা মিষ্টির দাম পরিশোধ করলেন। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বিশারত ওস্তাদ, মৃত বাংলা বাবু-এককালে এদের ভোজন কাহিনী এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, সমাজ উন্নয়ন কর্মী