উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

ওএসডি কালচার : পেশাজীবনের এক অভিশাপ

গোলাপ মুনীর: আমরা পত্রপত্রিকায় এমন অনেক খবর পড়ি, যেগুলো অনেক সময় বিশ্বাস করতেও বাধে, অবাক লাগে। কখনো কখনো মনে হয়- এমনটি কী করে হতে পারে? কিংবা এমনটি হওয়ার বা করার কী অর্থ হতে পারে? কিন্তু সব সম্ভবের এই দেশে আসলে এমনটি ঘটে এবং ঘটে চলেছে। গত ২২ জানুয়ারি দেশের প্রভাবশালী জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ‘এইট ইয়ার্স অ্যাজ সেক্রেটারি বাট নো ওয়ার্ক’ শিরোনামে তেমনি একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু বিশ্বাস করতে সত্যিই অবাক লাগে। প্রশ্ন জাগে কেন এমনটি চলবে? কার স্বার্থে চলতে পারে এমন মেধা ও অর্থের অপচয়?

খবরটিতে বলা হয়েছে- আট বছর আগে মো: এবাদত আলী পদোন্নতি পেয়ে হন বাংলাদেশ সরকারের একজন ভারপ্রাপ্ত সচিব। কিন্তু ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর তাকে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউিটি) করা হয়। তখন তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের রেলওয়ে বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে। এরপর বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় তিনি পদোন্নতি পেয়ে হন সচিব, যদিও তিনি তখন ছিলেন একজন ওএসডি। এরপর থেকে ওএসডি হওয়ার কারণে তাকে আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে হয়নি এবং তাকে নিয়মিত অফিসেও যেতে হয়নি। কিন্তু এবাদত আলী তার মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা নিয়মিত পেয়ে আসছেন। এর বাইরে তিনি প্রতি বছর পেয়েছেন গাড়ি সুবিধা, আবাসিক বেনিফিট, চিকিৎসাভাতা, ভ্রমণভাতা ও বিনোদনভাতাসহ সন্তানদের শিক্ষাভাতা, টেলিফোন বিল এবং ডমেস্টিক এইড। এ ছাড়া, তিনি সাত বছর ধরে পেয়েছেন আরো অনেক সুবিধা, যা পরিশোধ করা হয় জনগণের করের টাকায়।

গত ২২ জানুয়ারি এই রিপোর্ট প্রকাশের দিনে তিনি একজন ওএসডি হিসেবে এলপিআরে (লিভ প্রায়র রিটায়ারমেন্টে) গেছেন। তিনি আরো এক বছর শুধু বিনোদন ও ফোনভাতা ছাড়া বাকি সব সুবিধা ভোগ করবেন। তবে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বিদায় সংবর্ধনা পাবেন না, যা সাধারণত একজন সচিব অবসরে যাওয়ার পর পেয়ে থাকেন মন্ত্রণালয়ে তার শেষ কর্মদিবসে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে এবাদত আলীকে ওএসডি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু অফিস আদেশে এই পরিবর্তনের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এবাদত আলী এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কারণ, এখনো তিনি সরকারের চাকরিতে আছেন। উল্লেখ্য, পাবনার সন্তান এবাদত আলী ১৯৮২ সালে বিসিএস পাস করে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তার কর্মজীবনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে। তিনি তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ছিলেন ট্যারিফ কমিশনের সদস্য এবং সিরাজগঞ্জের ডিসি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কর্মহীনভাবে তাকে চাকরি জীবনের শেষ আট বছর কাটাতে হয় একজন ওএসডি হিসেবে।

এর কয় বছর আগে ডেইলি স্টারের আরেকটি রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা আরেকজন ওএসডির কথা জানতে পারি। তার নাম এম এ মোমেন। রিপোর্ট মতে, ২০০১-২০০৬ সালের দিকে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর কিছু অবৈধ বিলবোর্ড নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কোকো নিজে অকুস্থলে এসে হাজির হলেও তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কাজ থামাননি। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি ছিলেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার আমলে বিমান দ্বিতীয়বারের মতো লাভের মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে জাতীয় এই বিমান পরিবহন সংস্থা প্রতি বছর অব্যাহতভাবে ২৫০-৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে যাচ্ছিল। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় পাবলিক পরীক্ষায় ছাত্রনেতাদের নকল করতে না দেয়ায় তার কাছে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে তাকে হত্যার হুমকি প্রদর্শন করা হয়েছিল। এম এ মোমেন পরিচিত ছিলেন সিভিল সার্ভিসের একজন মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে।

স্বাভাবিকেই যারা তাকে জানতেন, তাদের অনেকের প্রত্যাশা ছিল- তার কাজের ও সৎ সাহসের গুণেই তিনি আরো ভালো পদোন্নতি ও পদ পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরপরই তাকে করা হলো ওএসডি। আর তা করা হলো তার কাজে গাফিলতি অথবা কম কর্মসাফল্যের কারণে কিংবা পেশাগত দুর্ব্যবহারের জন্য নয়। অনুমান করা হয়, বিএনপি সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও ভালো দায়িত্ব পালন করতে দেয়াই হয়তো তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে হয়তো বিএনপিমনা আমলা ভেবে বসে।

তাই এ বছরের আগস্টে এলো তার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি, তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো। ১৯৮২ সালের নিয়মিত বিসিএস ব্যাচের শুধু এম এ মোমেনকেই এ ধরনের দুর্ভোগে পড়তে হয়নি। এমন আরো কয়েকজনকেও চিহ্নিত করা হয় বিএনপিমনা লোক হিসেবে। তাদেরকেও আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। এম এ মোমেনের ব্যাসমেট ছিলেন শেখ আবদুর রশিদ। তিনি বিসিএস মেধা তালিকার শীর্ষ পদটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারও হয়তো স্বপ্ন ছিল এক সময় শীর্ষ সারির একজন নামীদামি আমলা হবেন। কিন্তু তাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি থাকার সময় তাকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ওএসডি করা হয়।

এভাবে ওএসডি করার অনুশীলন চলতেই থাকে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ওএসডির সংখ্যা এক সময় ২৫০ থেকে ৬৫০-এ নিয়ে তোলে। প্রাথমিকভাবে অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয় রাজনৈতিক কারণে। এবং এক সময় দেখা গেল, পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি না করেই পদোন্নতি দেয়ার কারণেও ওএসডির সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। কিছু কর্মকর্তাকে অলস করে বসিয়ে রাখা হয়েছে পেশাগত দুর্ব্যবহার অথবা কম কর্মসাফল্য প্রদর্শনের কারণে। বর্তমানে যে বিপুলসংখ্যক সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিবকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে, তাদের পদায়ন প্রায় অসম্ভব। কারণ, সে পরিমাণ পদ খালি নেই।

সাধারণত একজন ওএসডিকে শুধু অফিসে হাজির হয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে হয় না। আর বেসরকারি আমলাদের ওএসডি করা হয় রাজনৈতিক কারণে কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে। একজন আমলা চাকরির শুরু থেকে বেশ কয়েকবার পদোন্নতি পাওয়ার পর কমপক্ষে ২৫ বছর পর সচিব পদে উন্নীত হতে হয়। তা ছাড়া, তাদেরকে দেশ-বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ জন্য তার পেছনে সরকারের প্রচুর টাকা খরচ হয়। যদিও একজন ওএসডিকে তার বিল কালেকশনের কাগজপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেখাতে হয়, তবুও তাকে কোনো চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয় না। বিভিন্ন সূত্র মতে, ওএসডিরা সাধারণত মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে কিংবা অন্য ওএসডিদের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটান। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে ৫০০-এর কর্মকর্তা ওএসডি মর্যাদা নিয়ে চাকরিতে আছেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ওএসডি হচ্ছেন একজন ডিউটিহীন কর্মকর্তা। বাংলাদেশে একজন বিসিএস কর্মকর্তাকে ওএসডি করা একটি সাধারণ প্রপঞ্চ। সব সরকারের আমলেই ওএসডি করার অনুশীলন চলেছে কম-বেশি। আর এসব কর্মকর্তার পেছনে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে অহেতুক। কারণ, কাজ না করিয়েই তাদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জোগান দিতে হয় বছরের পর বছর ধরে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে ওএসডি কালচার। কয় বছর আগে প্রকাশিত এক রিপোর্ট মতে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে আমাদের সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৩ হাজার ৬০৫ জন ওএসডির বেতনভাতা এবং জোগাতে হয়েছে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। অনেক ওএসডি ডিউটি না থাকার সুযোগ নিয়ে অন্যত্র নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন, এমনটিও শোনা যায়। কেউ চাকরি করছেন বহুজাতিক কোম্পানিতে কিংবা অন্য কোনো বেসরকারি কোম্পানিতে। কেউ সময় কাটাচ্ছেন পড়াশোনা করে কিংবা বই লিখে। খুব কমসংখ্যক ওএসডি আয়েশি সময় কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের সাথে।

এরপরও বলতে হবে, এরা কেউই ওএসডি জীবন চাননি। তারা চেয়েছিলেন চাকরিস্থলে তাদের স্বাভাবিক কর্মজীবন চালিয়ে যাবেন। তাদের মেধামনন আর কাজের মধ্য দিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা দেশ-জাতির উপকারে লাগাবেন। কিন্তু ওএসডি নামের অপসংস্কৃতি চালু থাকার কারণে অনেকেই সেই সুযোগ হারান এবং দেশ-জাতি দেশের ওএসডি করা মেধাবী গোষ্ঠীর সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে- ওএসডি হওয়া কর্মকর্তারা এক ধরনের অস্বস্তি নিয়েই জীবন কাটান।

একজন ওএসডি যিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি নাম না প্রকাশের শর্তে একটি পত্রিকাকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘ওএসডি হওয়া একটি অভিশাপ। আমি মহাশক্তিধর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আমার শত্রুও যেন ওএসডি হওয়ার এই ভাগ্যবিড়ম্বনায় না পড়েন।’ এ কর্মকর্তাকে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি নোটিশের মাধ্যমে ওএসডি করে। আরেকজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন তাকে ২০১৮ সালে ওএসডি করা হয়। যদিও কাগজপত্রে তার চাকরি এখনো বিদ্যমান, তবুও মাসের পর মাস ধরে তিনি কোনো কাজই করছেন না। তিনি প্রতিটি কর্মদিনে সচিবালয়ে যান। চেকিংয়ের পর তিনি সোজা চলে যান লাইব্রেরিতে, গল্পগুজব করেন অন্য ওএসডিদের সাথে। অফিসের সময় শেষে তিনি বাড়ি ফেরেন। মাসের পর মাস এভাবেই কাটছে তার অফিস জীবন।

ওএসডি হওয়া আরেক অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ‘আমাদের সময়টা খুবই খারাপ। আমার পদ আছে, বেতনভাতা আছে, কিন্তু নেই কোনো ডেস্ক, যাকে নিজের বলতে পারি। আমার আর কোনো ডিউটি নেই। এটি একটি শাস্তি। এটি আমার পেশাজীবনের একটি অভিশাপও।’ এই ওএসডি হওয়ার বিষয়টির নেতিবাচক প্রভাব তার একার মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে না। এর প্রভাব পড়ে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর, এমনকি ঘনিষ্ঠ স্বজনদের ওপরও। তার নিজের জীবনে এর প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে এই ওএসডি কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ পরিস্থিতির জন্য আমার পরিবার আমাকে অবহেলার চোখে দেখে। এরা ভাবতে পারে, আমি কোনো ভুল করেছি অথবা আমি কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাটুকু রাখি না। অনেকে মনে করেন, আমাকে ওএসডি করা হয়েছে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে।’ আরেকজন বলেন, ‘আমি লজ্জাবোধ করি এ কথা বলতে যে, আমাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে।’

একজন আমলা শ্রেণীর কর্মকর্তাকে ওএসডি বানিয়ে রাখা কোনো ভালো অনুশীলন নয়। কোনো কর্মকর্তাই চান না ওএসডি হয়ে মর্যাদাহীন অবস্থায় এমন চাকরিতে বছরের পর বছর কিংবা মাসের পর মাস লেগে থাকতে কিংবা এক সময় বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে, যা অন্যের কাছে উল্লেখ করতেও তার আত্মসম্মানে বাধে। সত্যিই যেমনটি ভুক্তভোগীরা উল্লেখ করেছেন, ‘ওএসডি হওয়া তাদের জন্য পেশাজীবনের একটি অভিশাপ।’ তারা চান না, তার কোনো শত্রুও যেন এই অভিশাপের শিকার হন। অথচ দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের মতো একটি গরিব দেশ এই ওএসডি নামের অপ্রয়োজনীয় বোঝাটি বয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা নিশ্চয়ই আন্দাজ-অনুমান করতে পারি, দীর্ঘ দিন একজন সচিবকে ওএসডি করে রাখা বিপুল অর্থ অপচয়েরই নামান্তর। অথচ একজন-দু’জন নয় শত শত ওএসডি কর্মকর্তাকে দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে রাখার ব্যাড কালচারটি যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এ নিয়ে বিকল্প ভাবনাচিন্তার কথা কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হতে শোনা যায় না।

মনে হয়, বিষয়টি যেন স্থায়ী রূপ নিয়ে বসে আছে। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, ওএসডি কালচার আমাদের জাতীয় জীবনে থাকবেই। কিন্তু আমাদের ভাবনায় নেই- আমরা কাদের ওএসডি করে বসিয়ে বসিয়ে বেতনভাতা জুগিয়ে কর্মহীন করে রাখছি। এরা প্রত্যেকেই বিসিএস পাস সমাজের অন্যতম মেধাবী একটি গোষ্ঠী। হতে পারে তাদের কেউ কেউ সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী নন। শুধু এ কারণে কিংবা কোনো কারণ না দর্শিয়ে এদের ওএসডি করে রাখা রীতিমতো একটি অপরাধ। এই ওএসডি কালচার তাদের মেধামনন সূত্রের সম্ভাবনাময় অবদান থেকে জাতিকে বঞ্চিত করারই অপর নাম। সাবেক আমলাদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে- অধিক মাত্রায় ওএসডি করার বিষয়টি জনপ্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। তা ছাড়া, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কারণে এক দিকে যেমন ওএসডি বানানোর কাজটি গতি পেয়েছে, তেমনি পদ সৃষ্টি না করে গণপদোন্নতির অনুশীলনও বেড়েছে। এর ফলে অনেকে পদোন্নতি পেয়েও পদ পাচ্ছেন না। এ নিয়ে পদোন্নতি পাওয়া আমলাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এর ধাক্কা লাগছে আমলাদের শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও।

আমলাদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবসৃষ্ট নানা অসন্তোষের খবর মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যম সূত্রে দেশবাসী জানতে পায়। সব মিলিয়ে বলতে হয়, ওএসডি কালচারসহ দেশের আমলাতন্ত্রে বিরাজমান নানা সমস্যা নিয়ে সমন্বিতভাবে ভাবার চূড়ান্ত সময় এসেছে। কিন্তু দৃশ্যপট দেখে মনে হচ্ছে, আমরা এ সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবছি না। বরং আমরা এমন সব কর্মকাণ্ডে মশগুল, যা শুধু এ সমস্যাকে আরো জটিল করেই তুলছে। ভুললে চলবে না, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসার চরম সময় এখন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *