মুজতাহিদ ফারুকী: বই পড়ার অভ্যাস নাকি সারা বিশ্বেই কমে যাচ্ছে। সাধারণ আড্ডায় বা সুধীজনের সমাবেশে এ রকম কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটি মোটেও সত্য নয়। হয়তো পড়ার ধরন পাল্টেছে, উপকরণ পাল্টেছে, কিন্তু পড়ার অভ্যাস মানুষের কমেনি। বিশ্বের যে দেশ যত উন্নত, সে দেশের মানুষের বই পড়ার অভ্যাস তত বেশি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশের একটি ছবি দেখেছি, যেখানে একটি ট্রেনের যাত্রীদের সবার হাতে বই দেখা যাচ্ছে। যারা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, তারাও ওই দাঁড়ানো অবস্থাতেই বই মেলে রেখেছেন চোখের সামনে। উন্নত দেশগুলোর মানুষেরা চলার পথের সময়টুকু বই পড়ে কাটিয়ে দেন। আমাদের মতো রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বা অন্যের ছিদ্রান্বেষণে মেতে ওঠেন না।
ইদানীং প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকে কম্পিউটারে, মোবাইল ফোনে, ট্যাবলেট পিসিতে বা কিন্ডলেতে বই পড়েন। সারা বিশ্বে অসংখ্য বই প্রতিদিন অনলাইনে বিপণন হচ্ছে পিডিএফ ফরম্যাটে। অ্যামাজনের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা লেখকের সর্বশেষ প্রকাশিত বইটিও পাওয়া যাচ্ছে ঘরে বসেই। সুতরাং মুদ্রিত বইই পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। মূল বিষয় হলো আপনি পড়ছেন কি না, আপনার সন্তান পড়ছে কি না। বেশ কিছু দিন আগে শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখেছি, সেখানকার তরুণেরা আমেরিকায় সদ্য বেরোনো একজন লেখকের বইটি এসেছে কি না সেই খোঁজ নিচ্ছেন তাদের লাইব্রেরিতে। আমাদের এখানে সে রকম কোনো দৃশ্য আজো চোখে পড়েনি। ভারত যে ক্রমেই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সামনের কাতারে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, তার কারণ নিঃসন্দেহে এই পাঠাভ্যাসের মধ্যে নিহিত।
বই পড়ার প্রয়োজন কেন? না, এর যে প্রায়োগিক দিক অর্থাৎ লেখাপড়া না করলে চাকরি-বাকরি পাওয়া যাবে না; কর্মসংস্থান হবে না এবং আমাদের বাঙালি জীবনের বহুল কথিত সেই ‘গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া’ যাবে না, সেদিকটি তো আছেই। আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্যই জরুরি ও অপরিহার্য। সেটি করতে হবে এবং ভালো করেই করতে হবে। কিন্তু আমরা বলছি সেই পাঠাভ্যাসের কথা যেটি মানুষ করে মনের আনন্দে, নিজের জ্ঞানের সীমা সম্প্র্রসারণ করতে এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানতে। বিশ্বজগতের সৃষ্টিরহস্য, বিশ্বের ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদদের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন জানতে হলে বই পড়তেই হবে। বই মানুষের মনের পুষ্টি জোগায়, মনকে উদার ও মানবিক করে তোলে, জীবনের শাশ্বত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে এবং মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, তার জীবনকে করে পরিমার্জিত।
পণ্ডিতজন বলে গেছেন, একটি ভালো বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ যার সাথে কোনো পার্থিব ধনসম্পদের তুলনা হতে পারে না। ধনসম্পদ একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি কালজয়ী বইয়ের আবেদন কখনো ফুরাবার নয়।
বই পড়তে হবে এ কারণেই। আমাদের ইসলাম ধর্মে জ্ঞানচর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর এ কথা কে না জানে, ইসলামি বিশ্বে যত দিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিল, তত দিনই তারা বিশ্ব শাসন করেছেন। বিশ্বের রাজনৈতিক ও জ্ঞানের জগৎ একসাথে অধিকার করে রেখেছে।
বই সম্পর্কিত কিছু উদ্ধৃতি দিই বিশিষ্টজনের মুখ থেকে। মার্কিন লেখক রে ব্রাডবেরি বলেন, ‘একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তোমাকে বই পোড়াতে হবে না। স্রেফ মানুষের বই পড়া বন্ধ করতে পারলেই হলো।’ তার মানে হলো, আমরা যদি বই না পড়ি তাহলে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আপনাআপনিই ধ্বংস হয়ে যাবে, কোনো যুদ্ধবিগ্রহের দরকার হবে না।
নোবেল বিজয়ী রুশ কবি ও লেখক জোসেফ ব্রডস্কিও বলেছেন প্রায় একই রকম কথা। তিনি বলেন, ‘বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। তার মধ্যে একটি হলো, বই না পড়া।’ মার্কিন দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের নেতা ফ্রেডরিক ডগলাস বলেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। তিনি বলেন, ‘একবার তুমি পড়তে শেখো, তুমি চিরকালের জন্য স্বাধীন।’
স্বাধীনতা মানুষের চিরন্তন আকাক্সক্ষা, ব্যক্তিজীবনে এবং জাতীয়পর্যায়ে সব মানুষই স্বাধীনতা চায়, শৃঙ্খলিত জীবনের অবসান চায়। আর সেজন্যই মানুষের নিরন্তর পথচলা, অবিশ্রান্ত সংগ্রাম। উদ্ধৃতি হয়তো বেশি হয়ে যাচ্ছে। তবুও অন্তত আরো তিনটি উদ্ধৃতি না দিয়ে শেষ করতে পারছি না।
বিশ্ববিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সাথে না থাকলে জীবন অচল।’ জন মেকলে বলেন, ‘প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় বসবাস করব, তবু এমন রাজা হতে চাই না, যে বই পড়ে না।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।’
আর উদ্ধৃতি না দিয়ে শুধু বলব, বই না পড়ার কারণে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছি। আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ, লেখাপড়ায় পিছিয়ে যেতে যেতে আমরা এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি যখন আমাদের শিক্ষিত লোকেরাও ঠিকমতো নিজের ভাষা পর্যন্ত লিখতে পারছেন না। আমরা সাধারণভাবে স্নাতকোত্তর পাস করা লোকদের কথা বলছি না, বরং যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং লেখালেখির চর্চা করেন, তাদের কথাই বলছি।
সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের লেখা নিবন্ধ দেখার সুযোগ হয়েছে, যেগুলো সতর্কতার সাথে সম্পাদনা না করলে ছাপার উপযোগী হয়ে ওঠে না। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট অনেক লেখকের লেখা পড়ে দেখেছি, ভাব প্রকাশের কী ভয়াবহ দুর্বলতা থেকে যায় তাদের লেখায়।
এটি গেল একটি দিক। কিন্তু বই না পড়ার কারণে এর চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে আমাদের তরুণদের। সেটি হলো তারা যুক্তি ও কুযুক্তির তফাত বুঝতে পারছে না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে কতগুলো যুক্তিহীন, একগুঁয়ে মানুষ তৈরি হচ্ছে আমাদের সমাজে। কূপমণ্ডূকতার ঘেরাটোপে বন্দী এসব লোক যখন রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে জায়গা করে নেয় তখন সমাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়, সমাজ পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে এবং পরিণামে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।
এখন বই পড়া কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ তা স্বীকার করতেই হবে। বইয়ের দাম বেড়েছে। বিদেশী বই কিনতে আগের তিন থেকে দশগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ বই না পড়ার অজুহাত হিসেবে এই দাম বাড়ার বিষয়টিকে তুলে ধরে। একটি ছেলে বা মেয়ে স্মার্টফোন এবং তাতে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে মাসে যে অর্থ ব্যয় করে, তা দিয়ে সারা মাসের জন্য বেশ ক’টি বই কেনার সুযোগ এখনো আছে বলে মনে করি। যারা ঈদের সময় ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে লেহেঙ্গা কেনে, সমাজের সেই ধনিক শ্রেণীর মেয়েরা বই পড়ে না। যে তরুণটি এক জোড়া কেডস কিনতে ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করে, তার কাছে বই পড়া মানে নিছক সময়ের অপচয়। সে কম্পিউটারে, টিভিতে, সিনেপ্লেক্সে ইংরেজি সিনেমা দেখে বিজাতীয় জীবন সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা নেয়ার চেষ্টা করে।
বিদেশ ট্যুরে গিয়ে বিদেশীদের সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান আহরণ করে এবং নিজের দেশ, সমাজ, সংস্কৃতিকে হেয় করতে, অবজ্ঞা করতে শিখে। সে সব সময় এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ অবিলম্বে পাল্টে ফেলার সুপারিশ করে বক্তৃতাবাজি করবে। আমরা এ ধরনের শেকড়বিহীন মানুষের কথা বলতে চাই না। আমরা চাই নিজের সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে একে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার, একে উন্নততর করে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন সত্যিকারের আলোকিত মানুষ; যারা দেশকে ভালোবাসবে শর্তহীন সরলতায়, শুধুই এ দেশের কাদা-মাটিতে, জলে-হাওয়ায় বেড়ে ওঠার কৃতজ্ঞতায়। আর এটি করতে হলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো পড়া। নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের বই পড়তে হবে। পড়তে হবে, গভীর অভিনিবেশে, মেধা ও হৃদয়ের যুগপৎ ব্যবহারে।
আমাদের দেশে ‘পাঠাগার আন্দোলন’ বলে এখন প্রায় কিছুই নেই। উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রামপর্যায়ে রাজনৈতিক দলের অফিস স্থাপনের দিকে আমাদের যতটা ঝোঁক, লাইব্রেরি বা পাঠাগার প্রতিষ্ঠার দিকে তার লাখ ভাগের এক ভাগ আগ্রহও দেখা যায় না। এ জন্য আমাদের ছেলেবেলায় দেশের বিভিন্ন শহরে যত লাইব্রেরি ছিল, তার বেশির ভাগ এখন নেই। আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতে যতটা পছন্দ করেন, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা বিদ্যমান লাইব্রেরিগুলোতে পাঠসামগ্রী সরবরাহ করার উদ্যোগ নিতে ততটাই অনাগ্রহী।
এমনই পরিস্থিতিতে আমাদের আবেদন, নতুন সংস্কৃতিমন্ত্রী যেন এ বিষয়টির দিকে নজর দেন এবং কার্যকর উদ্যোগ নেন। বই পড়া জাতীয় অনুশীলনের অংশ হলেই কেবল দেশ, জাতি তথা গোটা বিশ্ব হয়ে উঠবে সুন্দর, সুশৃঙ্খল এবং আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য একটি কাক্সিক্ষত আবাসস্থল। তাই বই পড়–ন আনন্দের সাথে, বাঁচুন আলোকিত মানুষ হিসেবে।