নারী-পুরুষ কারোই শিক্ষার ব্যাপারে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই
ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়াঃ ইসলামে নারী পুরুষ সবার জন্যই শিক্ষাকে ফরজ বা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দ্বীনি ও বৈষয়িক শিক্ষা গ্রহণেও কোনো বিধি-নিষেধ নারী-পুরুষ কারো জন্য নেই। আল্লামা শফী মেয়েদের পঞ্চম শ্রেণীর পর স্কুলে না দেয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা তিনি পরিবেশ পরিস্থিতির দিক লক্ষ্য রেখে বলেছেন এবং মুরব্বি হিসেবে ভুলেও বলে থাকতে পারেন বলে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন। এ বিষয়ে ব্যাখ্যায় না গিয়ে ভুল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়াই যুক্তিযুক্ত হবে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। গত শুক্রবার হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক মাহফিলে মেয়েদের পঞ্চম শ্রেণীর পর স্কুলে না পাঠাতে আল্লামা শফীর দেয়া বক্তব্য ও হাত উঠিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলছে। ইতোমধ্যেই আল্লামা শফীর পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। তার পরও আলোচনাও সমালোচনা থেমে নেই। নারীদের শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করা সংবলিত তার বক্তব্য এবং নারীর শিক্ষার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসলামী বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেন। বায়তুল মোকাররমের প্রধান পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমানের কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি যে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রয়োজন বলেছেন- এটার ব্যাখ্যা উনি দেবেন। আমরা মনে করি যে, উভয়ের শিক্ষা প্রয়োজন। ইসলাম মেয়েদের কম শিক্ষা দিতে হবেÑ এমন কোথাও বলেনি বরং শিক্ষিত করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে।
মুফতি মিজান বলেন, ইসলামতো নারীদের শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছে। কারণ মা শিক্ষিত হলে সন্তান শিক্ষিত হবে। মা-বাবা উভয়ের শিক্ষার প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ে। একজন শিক্ষিত আরেকজন অশিক্ষিত এটা ইসলাম বলে না। বরং ছেলে বা মেয়ে উভয়কেই শিক্ষিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে। আমরা জানি, বহু মহিলা সাহাবি ছিলেন যারা বড় বড় আলেমা ছিলেন, দ্বীনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, কুরআনের হাফেজা ছিলেন। হাদিস বিষয়ে তাদের প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। শফী সাহেব যেটা বলছেন আমি দেখলাম উনি কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন ছেলেমেয়ের যেখানে অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকেÑ এটা তো আসলে নতুন কোনো কথা নয়। এটা তো সবসময়ের কথা। এটা ঠিক আছে ছেলেমেয়ের সুন্দর একটা পরিবেশ। পরিবেশটা পেলে তারা আরো ভালো শিক্ষা পাবে, আরো সামনে অগ্রসর হতে পারবে। তারা আরো বেশি করে মানুষের সেবা করতে পারবে। এক কথায় আমরা চাই যে, শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বীনি শিক্ষা, বৈষয়িক শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন আছে, এমন নয় যে, শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন আছে , বৈষয়িক শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। বৈষয়িক শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষাটা থাকতে হবে। বাকি আমরা মনে করি শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন ছেলেমেয়ে উভয়কেই।
মিরপুর জামেয়া কাসেমিয়া মাদরাসার শিক্ষা সচিব মুফতি আবদুল মালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হুজুর যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলেছেন এটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আর এখন যে সমালোচনা হচ্ছে আসলে উনি সেটা বলেননি। আর উনার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। নারী শিক্ষার ব্যাপারে ইসলামের তো সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশিকা আছে। এখন সামাজিকভাবে ঘোলা করতে চাইলে দরজা খোলা থাকে না- বিষয়টা এই টাইপের আরকি। কিন্তু আসলে হুজুর তো ওই উদ্দেশ্যে বলেননি।
মুফতি মালেক বলেন, ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা, বেপর্দার বিষয়টা থাকে সেখানকার কথা বলেছেন তিনি। উনি হয়তো এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার কথা বলেছেন যে, প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেলে তো পর্দা ফরজ। পর্দা যখন চলে যায় তখন এই শিক্ষাটা আপনি মোবাহ পর্যন্ত নিতে পারবেন। মোবাহর পরে যখন ফরজের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তখন বিষয়টা তো আবার শরিয়তের লঙ্ঘন হয়। বিদ্যমান যে শিক্ষাটা আছে, তাতে দেখা যায় পারিপার্শি¦ক অনেক গুনাহ ও শরীয় বিধান তরক হয়ে যায়, যার কারণে হয়তো বলে থাকতে পারেন। এটা ছাড়াতো এ কথা বলার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তিনি বলেন, ইসলামের সামগ্রিকভাবে নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধ বা কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু কোনোটা অগ্রাধিকার পাবে সেটা দেখতে হবে। আমি কেবল নফল জাতীয় এলেম নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম কিন্তু ফরজ সম্পর্কিত এলেম ঢাকা পড়ে গেলÑ এসব বিষয় কিন্তু দেখতে হবে।
বারিধারা শেখ যাকারিয়া রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, আসলে ইসলামের বিধি বিধানতো পরিষ্কার। হাজারো মহিলা সাহাবি জ্ঞান শিখেছেন। শিক্ষা পুরুষের জন্য যেমন নারীর জন্যও তেমন জরুরি। এতে ভুলের কোনো অবকাশ নেই। আমার মনে হয় হুজুর যেটা বলেছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট, অবস্থা, অবস্থান নিয়ে। যে আমাদের শিক্ষাগারে নারীদের মান-সম্মান, সম্ভ্রম, ইজ্জত, তাদের রক্ষার পরিবেশতো অনেক জায়গায় সেই। সেই হিসেবে ইসলাম বলে, যদি তোমার ইজ্জতের ক্ষতি হয়, মান নষ্ট হয়, মান ইজ্জতকে নষ্ট করে তো সাধারণ শিক্ষা তো দূরে থাক, ইসলামী শিক্ষাও জায়েজ নেই। কোনো শিক্ষাই জায়েজ নেই। আমার মনে হয় হুজুর বর্তমান পরিবেশের দিকে লক্ষ্য করে কথাটা বলছেন। মানে হুজুরের অজানা নয়, মেয়েরা দাওরা পর্যন্ত মাদরাসায় পড়তে পারলে স্কুলে পড়তে পারবে না কেন? এটা কোনো যুক্তিতেই আসে না এবং হুজুরের এমন মতামত হতে পারে। হুজুর ওই দিকটা দেখে বলছেন। হুজুরের পক্ষ থেকে এখন একটা জবাবও এসেছে যে, আমি নিষেধ করিনি, আমি পরিবেশের কথা বলছি। উনি ব্যাখ্যাটা পরে দিয়েছেন, প্রথমে কথাটা বলেছেন। ব্যাখ্যাকে সামনে সামনে আনলে উনার কথা নিয়ে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে না। এটাই বাস্তবতা আমি যতটুকু বুঝি। কারণ জাতীয় শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষাকে ইসলাম মূল্যায়ন করে। আল্লামা ওবায়দুল্লাহ সিন্দী তাফসিরি বলেছেন, জাগতিক শিক্ষা অত্যন্ত ভালো। তবে শর্ত হলো, শিক্ষার্থীরা নিজে যে, মুসলমান তার যে একজন আল্লাহ আছে, আল্লাহর গোলামি করা লাগে এই বিষয়টা যেন বিলুপ্ত না হয়। যদি কোনো শিক্ষা বা পরিবেশের কারণে আল্লাহকে ভুলে যায়, নিজের মুসলমানিত্ব ভুলে যায়, তাহলে শিক্ষাটা জায়েজ নেই। এটাকে যদি ধরে রাখতে পারে তাহলে শিক্ষাটা অনেক ফলপ্রসূ এবং এটা মুস্তাহাব, সওয়াবের কাজ। আরেকটা শর্ত দিয়েছেন দেশ জাতির উপকারের জন্য শিক্ষা গ্রহণের নিয়ত যেন শিক্ষার্থীর অন্তরে থাকে। মুসলমানরা যাতে অন্যদের দ্বারস্ত হতে না হয় সেজন্য জাগতিক শিক্ষা অর্জন করে জাতি ও দেশকে উন্নয়ন করবো- এটা নিয়ত থাকতে হবে। আর মুসলানিত্বকে না ভুলতে হবে। এ দুইটা শর্ত থাকলে জাগতিক শিক্ষা বড় সওয়াবের কাজ। আহমদ শফী আমাদের মুরব্বি, সারা বিশ্বের মুরব্বি। আমাদের বাইরে নন তিনি। উনি যখন কথা বলেছেন হয়তো শর্তটা লাগাননি। পরে উনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একজন বক্তার নিজস্ব ব্যাখ্যা আসার পর এটার অপব্যাখ্যা চালিয়ে দেয়া বৈধ হবে না, তার প্রতি অন্যায় হবে।
রাজধানীর কাঁটাবন মসজিদের খতিব ড. খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, ইসলামের বিধান তো পুরুষ মহিলা সবার ওপর জ্ঞানার্জন সরাসরি ফরজ। কুরআনে ‘ইকরা বিইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ এর বিধান তো সবার জন্য। কুরআনের নির্দেশ হলো জানতে হবে আগে। তার আলোকে জানার পর আল্লাহকে বিশ্বাস করতে হবে। আগে শিক্ষা অর্জন করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা অর্জন ঈমান আমল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কুরআনের আয়াতের আলোকেই আল্লাহর রাসূল বলেছেন শিক্ষা অর্জন সবার ওপর ফরজ। ব্যাখ্যাতো অন্য জিনিস। উনি যেটা বলেছেন সেটাতো বলেছেনই। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে লিমিটেশন নেই। আজকে মহিলা ডাক্তার দরকার, ইঞ্জিনিয়ার দরকার সব সরকার। হজরত ওমর রা: কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে মহিলা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতেন। নিশ্চয়ই আগে মহিলা বিশেষজ্ঞ তৈরির ব্যবস্থা করেছেন। কুরআন-হাদিস সাহবিদের আমল সবমিলিয়ে ইসলামে মহিলাদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো সীমা আরোপ করা যাবে না। মাওলানা শফীর ব্যাপারে কথা হলো, উনি মুরব্বি মানুষ কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলেছেন। উনার কথাকে দলিল হিসেবে নেয়ারও সুযোগ নেই, আবার উনার পক্ষ থেকে যে ব্যাখাটা দিয়েছেন সেটা না দিয়ে উনি ভুল করে ফেলেছেন এটা বললেই সবচেয়ে ইনসাফ হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে পর্দার ব্যবস্থা থাকে না, নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না সেখানে পড়ানো যাবে না। এটা ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত না পড়ানোর কথাটা তো উনি তখন সরাসরি বলে ফেলেছেন।