দিল আফরোজ রিমা
গায়ের রং কালো বলে যখন তখন অনেক অপমান সহ্য করতে হয় জুবাইদার। তবে নিজে র্ফসা না বলে তার কোন আফসোস নেই। আলাহ তার গায়ের জন্য যে রংটি পছন্দ করেছেন তা সে কখনো অপছন্দ করতে পারে না। স্বামীকেও কোন দোষ দেয় না। তার কালো স্ত্রী পছন্দ নাই হতে পারে। শুধু মাঝে মাঝে ভাবে কালো একটি মেয়ে যে তার এত অপছন্দের তাকে স্বামী বিয়ের আগে দেখেও কেন বিয়ে করল। এ শুধু মনেরই কথা মুখে সে কখনো কিছু বলেনা।
স্বামীর অবহেলা খারাপ আচরণ সহ্য করে চলছে দিনগুলি। ইতিমধ্যে বাবার কাছ থেকে পাওয়া জুবাইদার বেশকিছু জমি স্বামী সাইফুদ্দীন নিজের নামে লিখে নিয়েছে। জুবাইদা লিখে দিয়েছে নির্দিধায়। জমিগুলো দিয়ে দেবার পর থেকেই তার সাথে খারাপ ব্যাবহারের সীমাটা আরো বেড়ে যায়। এমন ব্যাবহার করে যাতে সে নিজে থেকেই চলে যায়।
গ্রামের এক ধনি ব্যাবসায়ীর মেয়ে মমতাজের সাথে তার ভাব জমে উঠে। এক সময় সাইফুদ্দীন মমতাজকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মমতাজ তাকে র্শত দেয়, জুবাইদাকে তালাক দিলে সে বিয়ে করতে রাজি হবে।
সাইফুদ্দীন ভাবে, জুবাইদাকে তালাক দেওয়া একটা ঝামেলা। মোহর আনার বেশকিছু টাকা দিতে হবে। তারচেয়ে ভাল হয় ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে। সে মনে মনে ভাবে, জুবাইদার সব জমি এখন আমার। মমতাজও বিশাল ব্যাবসায়ীর একমাত্র সন্তান। বাবার কোটি কোটি টাকার মালিকতো সেই হবে। তাই মমতাজকে হাতছারা করলে চলবে না। এখন জুবাইদা ঝামেলাটাকে কি করা যায় সেটাই ভাবতে হবে।
তারপর একদিন সে গ্রামের গরীব নিরীহ রহিমের বাড়িতে যায়। তাকে না পেয়ে তার স্ত্রীর কাছে বলে আসে,রহিম যেন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে। তার জন্য অনেক টাকার একটি কাজ পাওয়া গেছে।
পরের দিন রহিম খুশি হয়ে সাইফুদ্দীনের সাথে দেখা করতে তার বাসায় যায়। ড্রইং রুমে বসে আস্তে আস্তে কথা বলার ব্যাপারটা জুবাইদা খেয়াল করে। তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। সে জানালার পাশে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনে এবং মুবাইলে রের্কড করে। সাইফুদ্দীন রহিমকে যে কাজের প্রস্তাব দেয় প্রথমে রাজি না হলেও অনেক টাকার লোভে সে রাজি হয়ে যায়। রহিম চলে যায়। পরের দিন রাত চারটায় এই বাড়িতে তার কাজ। সাইফুদ্দীন মনে মনে হাসে আর ভাবে, রহিমকেতো আমি একটি টাকাও দেব না। বরং হত্যার দায়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব।
এদিকে জুবাইদা সব শুনে একটু অবাক হয়। সে স্বামীকে এতটা খারাপ কখনো ভাবেনি। যাহোক মন খারাপকে প্রশ্রয় না দিয়ে জুবাইদা শক্ত হাতে মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়। জুবাইদা ধার্মিক, উদার কিন্তু বোকা নয়। সে খুব বুদ্ধিমতি এবং যোগ্য। স্বামীকে তার সম্পত্তি লিখে দিয়েছে বলে বোকামি করেছে ? তা নয়। সে স্বামীর আবদার রেখেছে। জুবাইদার কথাই বলছিলাম। সে উচ্চশিক্ষিতা, আত্ম রক্ষার কৌশল জানে, ড্রাইভিং জানে, আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সবকিছুর সাথেই সে সুপরিচিত। কিন্তু সে খুব নরম মনের। তার চলাফেরায় কোমলতা প্রকাশ পায়। সে নিরহংকার ও লাজুক একজন খুব সাধারন মেয়ে।
পরের দিন জুবাইদা প্রতিদিনের মত রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে। তাহাজ্জুত পড়তে বসে। তাহাজ্জুত পড়া শেষ করে জায়নামাজে বসে বুঝতে পারে তার পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। সে সেকেন্ডের মধ্যে উঠে দাঁড়ায় এবং জোরসে একটি ঘুসি গিয়ে লাগে রহিমের বুকে। রহিম সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার হাত থেকে খসে পড়ে ধারালো দা। জুবাইদা শক্ত রসি দিয়ে রহিমের হাত পা বেঁধে রাখে। যাতে জ্ঞান ফিরলে সে পালাতে না পারে। আর কোন সময় নষ্ট না করে মন শান্ত করে আবার জায়নামাজে বসে সে। যথা সময়ে আজান হয়। ফজর পড়ে ওয়াজিফা পড়তে থাকে জুবাইদা। এমন সময় সাইফুদ্দীন চুপি চুপি এসে রহিমের কাছে বসে। তাদের ফিসফিসানি শুনতে পায় জুবাইদা। রহিমের জ্ঞান ফিরেছে জুবাইদা বুঝতে পারে। সে মোনাজাত করে নায়নামাজটা ভাজ করে জায়গামত রাখে। জুবাইদার ধারনা সাইফুদ্দীন এবং রহিম খুব ভয় পেয়ে গেছে তাই ওরা এখন পালানোর সাহসও পাবে না। কারন,যারা অসৎ তারা ভিতু আর কাপুরুষ হয় সাহসি হয় না। তার স্বামী জানেও না যে সে কম্ফু ক্যারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া মেয়ে। আর এমন পর্দানশীল মেয়ে কখনো এতকিছু জানে তাও সাইফুদ্দীন কোন দিন আন্দাজ করতে পারেনি। আজ তার আত্মরক্ষার কৌশলটা খুব কাজে লাগলো। যাহোক জায়নামাজটি রেখে সে স্বামীকে বলে, খবরদার তুমি ওর বাঁধণ খুলবে না। চলে যাও এখান থেকে।
সাইফুদ্দীন কোনদিন জুবাইদাকে এমন করে কথা বলতে শুনেনি। সে ভয় পেয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে ওখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জুবাইদা আর দেরি না করে থানায় ফোন করল। কাছেই পুলিশ ষ্টেশন। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। জুবাইদার ঘরের তিন জায়গা থেকে তিনটি ছোট ছোট স্পাই ক্যামেরা বের করে পুলিশের হাতে দিল। আর ড্রইং রুমের সাইফুদ্দীন এবং রহিমের মোবাইলে রেকর্ড করা পুলিশকে শুনিয়ে দিল। পুলিশ দুই জনকেই ধরে নিয়ে গেল।
মামলা হলো,বিচার হলো, দুই জনেরই যাবৎ জীবন কারাদন্ড হলো। একদিন জুবাইদা স্বামীর সাথে জেলখানায় দেখা করতে গেল। সাইফুদ্দীন তাকে বলল, আমি খুব লোভ করেছিলাম তাই আজ আমার এই অবস্থা। তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে বেশি লোভ করা ভাল নয়। আরো বলেছিলে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমি সে কথায় কান দেইনি। তোমার সবকিছু নিয়ে তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমি খুব খারাপ ? মানুষ কেন এত খারাপ হয় বলতে পার জুবাইদা ?
জুবাইদা শান্ত কন্ঠে বলে, আমার ধারনা তুমি একদিন খুব ভাল হয়ে যাবে।
কথাটি বলে সে চলে আসে।
স্বামী জেলে যাওয়ার পর সে স্বামীর ঘর থেকে বাবার বাড়ি চলে যায়। একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে।
জেলখানায় সাইফুদ্দীনের তিন মাস কেটে গেল। জুবাইদা ভাবল, এবার ক্ষমা করা উচিত। সে উকিলের সাথে পরার্মশ করে তার সমস্ত অভিযোগ তুলে নিল। সে স্বামীর এবং রহিমের মুক্তির সব ব্যাবস্থা করে বাবার বাড়িতে চলে যায়।
যে রহিম টাকার লোভে জুবাইদাকে খুন করতে চেয়েছিল তার অবর্তমানে তার পরিবারকে জুবাইদা সাহায্য করেছে।
সাইফুদ্দীন ছাড়া পেয়ে নিজেই বুঝতে পারে তার উত্তম স্ত্রীই তাকে বের করার ব্যাবস্থা করেছে। ওখান থেকে সে সোজা শ্বশুর বাড়িতে জুবাইদার কাছে চলে যায়। তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চায় আর তার সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দিবার অঙ্গিকার করে। কিন্তু জুবাইদা বলে, আমি তোমাকে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আর আমি সম্পত্তি দিয়ে কি করব। আমি যা দেই তা কখনো ফিরিয়ে নেই না। তাই সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার কোন প্রশ্নই আসে না। তুমি এবার তোমার পছন্দ মত বিয়ে করে সুখি হও। কাখনো লোভ করোনা। হত্যা করা মহা পাপ। তাই ওসবের ধারে কাছেও যেও না।
সাইফুদ্দীন বিনিত ভাবে বলে জুবাইদা আমাকে যদি মাফ করে থাকো তাহলে বাড়ি চল। আমি আর এমন ভুল কোনদিন করব না। আমি ভাল মানুষ হতে চাই। তুমি যদি আমার পাশে থাকো আমাকে পথ দেখাও তাহলে আমি পারব। আমাকে ভাল হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি তোমার সব কথা মেনে চলব।
ঠিক আছে তুমি যদি আমাকে আবার মেরে ফেলার ব্যাবস্থা করো তাহলে করবে। তবুও আমি যাব তোমার সাথে। তোমাকে ভাল মানুষ হতে সাহায্য করব। আর হায়াত মৌততো আলাহর হাতে।
জুবাইদা স্বামীর সাথে নতুন করে সংসার শুরু করে। সত্যিই সাইফুদ্দীন একজম ভাল মানুষ একজন খাটি মুসলমান হয়ে উঠল। সুখ শান্তিতে ভরে উঠল ওদের সংসার।