অর্ণব সান্যাল: হয়তো অফিসের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ই-মেইল পাঠাচ্ছেন। অথচ অ্যাটাচমেন্টে অতি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ফাইল যোগ না করেই ‘সেন্ড’ করে দিলেন। এর পরের অবস্থা কল্পনা করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু ভাবতে গিয়ে গা একটু শিরশির করে!
অফিসে ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কাজ করলে টুকটাক ভুল হবেই। তবে কখনো কখনো ভুল খুব বড় হয়ে গেলে তা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। এমনকি চাকরি নিয়েও টানাটানি হতে পারে। তাই কাজে ভুল হওয়ার পর আপনি কীভাবে তা সামাল দেবেন, তার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
কর্মক্ষেত্রে ভুল ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলে। বেশির ভাগ সময়ই নিজের আত্মপরিচয় বা নিজের কাছে নিজের যে ভাবমূর্তি থাকে, সেটি শঙ্কায় পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাককম্বস স্কুল অব বিজনেসের সেন্টার ফর লিডারশিপ এক্সিলেন্সের সহপরিচালক ক্যারোলিন বারটেল এবং রস স্কুল অব বিজনেসের সেন্টার ফর পজিটিভ অর্গানাইজেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা জেন ডাটন এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁদের মতে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ নিজের একটি ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। সহকর্মীদের কাছেও সবাই নিজের একটি নির্দিষ্ট ও আদর্শ ‘চেহারা’ সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু কাজে বড় ধরনের ভুল হলে তা ভেঙে পড়ে। এতে নিজের আত্মবিশ্বাসে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা দেয়।
জাপানের আকিও মোরিতার নাম শুনেছেন? গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রথম রাইসকুকার বানিয়েছিলেন। সেই রাইসকুকারে চাল ভালোমতো সেদ্ধ হওয়ার বদলে পুড়ে কড়কড়ে হয়ে যেত। প্রথম দিককার সেসব রাইসকুকার তাই বাজারে পাত্তাও পায়নি। ওই ভুল করার পর কিন্তু আকিও মোরিতা থেমে যাননি। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই পরিশ্রমের ফলও মিলেছে। আজও আছে আকিও মোরিতার ওই ‘ছোট্ট’ কোম্পানি, নাম ‘সনি’!
মোদ্দা কথা হলো আপনার ভুল হতেই পারে, আপনি একাধিকবার ব্যর্থ হতেই পারেন। কিন্তু চেষ্টা থামিয়ে দিলে চলবে না। কারণ, শুধু এর মাধ্যমেই ভুল শোধরানো যায়। এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক অফিসের কাজে ভুল হলে কী করা যেতে পারে।
১. একটু যাতনা, মন্দ না
ইচ্ছে করে কেউ ভুল করে না। কিন্তু ভুলের পর মানসিক যাতনা হতেই পারে। ওই আফসোস বা আক্ষেপ অনুভবে বাধা দেওয়ার দরকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই কাজে ভুল হলে হতাশা আসবে, লজ্জাবোধও হবে। তবে এ নিয়ে মাথা কুটে মরার অর্থ নেই। সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড অনুতাপে ভুগতে পারেন। এরপর সেই নেতিবাচক ভাবনা মন থেকে বের করে দিন। বেশি নেতিবাচক হলে আর ভুল শোধরানো হবে না। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে, ইতিবাচকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। মন থেকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন ভুলের বিষয়টি। এরপর ভাবুন ভবিষ্যৎ নিয়ে।
২. দায় নিন
নিজের ভুল স্বীকার করে নেওয়া দোষের কিছু নয়। কাজে ভুল হলে বসের সামনে সরাসরি বলে দিন, ‘আমি ভুল করেছি’ বা ‘আমার কাজটি ঠিক হয়নি’। কোনো অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরও অসন্তুষ্ট হতে পারেন। ভুলের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। তবে ক্ষমা চাইতে গিয়ে আবার বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। পুরো বিষয়টি হতে হবে সংক্ষিপ্ত।
৩. কী করবেন, ঠিক করুন
ভুল করলেন, স্বীকারও করলেন। এবার ভুল শোধরানোর উপায় খুঁজুন। আপনার ভুলের কারণে প্রতিষ্ঠান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আপনাকেই করতে হবে। শুরুতেই নিজে একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করুন। এ ক্ষেত্রে বস ও সহকর্মীদের পরামর্শও নিতে পারেন। আপনার ভুলের কারণে হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি প্রশমনের চেষ্টা করুন। যদি আংশিকও সফল হন, তবে সেটিও আপনার সাফল্য। এতেই আপনার মনোযন্ত্রণার উপশম হবে।
৪. ভুল এড়াতে কী করবেন, তা জানান
ভবিষ্যতে যেন কাজে ভজকট না হয়, তার জন্য কী করতে চাইছেন, তা ঊর্ধ্বতনদের জানান। ভুল থেকে কী শিখলেন, তা জানাতেও ভুলবেন না। এতে করে কর্তৃপক্ষের কাছে আপনার ভাবমূর্তি ইতিবাচক হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে আপনার দক্ষতাও বাড়বে। হয়তো এতে তাৎক্ষণিক ফল মিলবে না, কিন্তু এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
৫. নিজের যত্ন নিন
শরীরের সুস্থতার সঙ্গে নৈপুণ্যের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। শরীর সুস্থ না থাকলে কাজেও মন বসবে না। আর মনোযোগ না থাকলে কাজে ভুল হবে হরদম। তাই ঘুম ঠিকমতো হওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা—এসব বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখুন। মন প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করুন। পেশাগত হতাশাকে ব্যক্তিজীবনে ঢুকতে দেবেন না। এভাবে শরীর-মন সুস্থ রাখতে পারলে কাজে ভুলের পরিমাণও কমে আসবে।
তথ্যসূত্র: দ্য মুজে, নিউইয়র্ক টাইমস ও হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ