ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান: ১১ই জানুয়ারি, ২০২০ অনুষ্ঠিত হল ঢাবি আরবী বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ১ম পূনর্মিলনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে এই পূনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল এ যাবতকালে এই বিভাগে লেখাপড়া সম্পন্নকারী অগণিত আপন মানুষের এক মহামিলন।
এই পূনর্মিলনীতে আমার অংশগ্রহণ ছিল খণ্ডকালীন। অর্থাৎ সারাদিনের এই প্রোগ্রামে আমি সারাক্ষণ থাকতে পারিনি। মাননীয় উপাচার্যের উপস্থিতিতে শুরু হওয়া শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ এবং দূর দূরান্ত থেকে অাগত চিরচেনা প্রাণপ্রিয় মানুষগুলোর সাথে টিএসসি চত্বরে সাক্ষাৎ ও ছবি তোলার পর আমাকে চলে আসতে হয়েছিল। তাই এ উপলক্ষে আমি আমার অনুভূতি এই লেখার মাধ্যমে কিছুটা সবিস্তারে প্রকাশ করছি।
ছাত্র হিসেবে ১৯৬৯-৭০ সেশনে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দু’টি বিরতি ছাড়া আমি দীর্ঘকাল এই বিভাগের সাথে সংযুক্ত আছি। প্রথম বিরতিটি ছিল পাশ করে বের হবার পর এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আগ পর্যন্ত কয়েক বছরের এবং দ্বিতীয় বিরতিটি ৩০/৬/২০১৭ তারিখে চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণের পর ৭/১১/২০১৮ তারিখে অনারারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান পর্যন্ত কয়েক মাসের। তাই বলা যায়, আরবী বিভাগের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ দীর্ঘ এবং অনেকের চেয়ে অনেকটা ভিন্নতর।
বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠন ও তার পূনর্মিলনীর আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কয়েকজন মানুষকে নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে দেখেছি। আমি তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম পূনর্মিলনীর দিনে সর্বপ্রথম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের নাম স্মরণ করছি, যাদের প্রায় সকলেই এখন পরলোকগত। এঁরা হলেন: ড. সিরাজুল হক, জনাব খন্দকার আব্দুর রহমান, ড. মোহাম্মদ এছহাক, ড. ফাতেমা সাদেক, ড. সৈয়দ লুৎফুল হক, ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, ড. হাবীবুর রহমান চৌধুরী, জনাব আতম মুসলেহউদ্দীন, ড. সাহেরা খাতুন, জনাব মিসবাহউদ্দীন ইকবালী, জনাব আনম আব্দুল মান্নান খান, জনাব নাজির আহমদ, জনাব আব্দুল মান্নান খান, জনাব রেজাউর রহীম, জনাব আব্দুল মালেক (বড়), জনাব আব্দুল মালেক (ছোট) প্রমুখ।
এই বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম হলেও বেশ কয়েক বছরে কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না হওয়ায় এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে আমাকে প্রায় পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এ সময়ে আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এক বছর পাঁচ মাস সরকারী ঢাকা কলেজে লেকচারার হিসেবে চাকুরি করেছি। যদি সরকারী কলেজে থেকে যেতাম তাহলে সেটা হত আমার জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগে যোগদানের ফলে আমি লেখাপড়ার যে সুযোগ পেয়েছি কলেজে থেকে গেলে তা কিছুতেই সম্ভব হত না বলে আমার বিশ্বাস।
২৪ নভেম্বর, ১৯৮০ থেকে ৩০ জুন, ২০১৭ পর্যন্ত এই বিভাগে আমার নিয়মিত শিক্ষকতাকাল। এ সময়ে বিভাগের প্রশাসনিক কাজকর্মে আমার উল্লেখযোগ্য কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। এ ক্ষেত্রে আমার তেমন আগ্রহও ছিল না। তবে শিক্ষাদান ক্ষেত্রে আমার স্বভাবগত আগ্রহের কারণে আমি আমার শতভাগ সেবা প্রদানে সর্বদা তৎপর ছিলাম এবং সীমিত পরিসরে হলেও এখনো তৎপর রয়েছি। এ ক্ষেত্রে বিভাগকে আমি যা দিয়েছি বিভাগও আমাকে তার যথার্থ প্রতিদান দিয়েছে বলে আমি মনে করি। আমি মনে করি, আমার কর্মস্থল ঢাবি আরবী বিভাগ হওয়ার সুবাদেই আমি ১২টি গবেষণা প্রবন্ধ ও ৩০টির অধিক গ্রন্থ রচনায় সক্ষম হয়েছি। আমার মতে এটাই আমার প্রতি আমার বিভাগের অকৃপণ প্রতিদান। আমার অগণিত ছাত্রছাত্রীসহ দেশ-বিদেশের অনেক পাঠক আমার বইপত্র আগ্রহভরে পড়েন বলে জানা যায়। এখানে এ রকম কয়েকটি বইয়ের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা যেতে পারে:
১। সরল লিপির কোরআন শরীফ: প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০১২।
২। সরল রীতির কোরআন শরীফ (বাংলা অর্থসহ), প্রথম প্রকাশ মার্চ, ২০১১; ৪র্থ মুদ্রণ: মে, ২০১৭।
৩। সরল রীতির হাফিজী কোরআন শরীফ (বাংলা অর্থসহ), প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০১৮।
৪। কোরআনের শব্দকোষ (লুগাতুল কুর্আন), ১ম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ২য় পরিমার্জিত মুদ্রণ: মার্চ, ২০১৭।
৫। আল-মু’জামুল ওয়াফী: আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১৫০, ১ম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০০৫; ৩৩তম মুদ্রণ: জানুয়ারি, ২০২০।
৬। আল-মু’জামুল ওয়াফী: আধুনিক বাংলা-ইংরেজী-আরবী অভিধান, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১৩৪, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০১৪; ৭ম মুদ্রণ: জুলাই, ২০১৮।
৭। আল-কাফী: বাংলা-আরবী অভিধান, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৫৬, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৮; ২য় মুদ্রণ: নভেম্বর, ২০১৮।
৮। আশ-শাফী: বাংলা-ইংরেজী-আরবী অভিধান, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪০, প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০১৮; ২য় মুদ্রণ: মে, ২০১৯।
৯। আল-ক্বামূসুল ওয়াজীয: আরবী-ইংরেজী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০১৫; ৬ষ্ঠ মুদ্রণ: আগস্ট, ২০১৯।
১০। আল-ক্বামূসুল ওয়াজীয: বাংলা-ইংরেজী-আরবী ব্যবহারিক অভিধান, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০০২; ১৭তম মুদ্রণ: ডিসেম্বর, ২০১৮।
১১। তিন ভাষার পকেট অভিধান (আরবী-ইংরেজী-বাংলা): প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর, ২০১৪; ৪র্থ মুদ্রণ: জুলাই, ২০১৯।
১২। তিন ভাষার পকেট অভিধান (বাংলা-ইংরেজী-আরবী): প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ১৯৯৬; ২১তম মুদ্রণ: এপ্রিল, ২০১৯।
১৩। দিশারী: বাংলা-ইংরেজী-আরবী ব্যবহারিক শব্দকোষ, ১ম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯৯৬ (পরিবর্ধিত সংস্করণ); ২৮তম মুদ্রণ: ডিসেম্বর, ২০১৯।
১৪। আরবী ব্যাকরণ, ১ম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০০৬; ৬ষ্ঠ মুদ্রণ: অক্টোবর, ২০১৮।
১৫। দৈনন্দিন আরবী কথোপকথন: বিষয়ভিত্তিক ১১টি অধ্যায়ে মোট ৭৩টি কথোপকথন, ১ম প্রকাশ: মার্চ, ২০০১; ১৬তম মুদ্রণ: নভেম্বর, ২০১৯।
১৬। আরব মনীষা: বিভিন্ন যুগের সাতজন আরব ভাষাতাত্ত্বিক ও কবি-সাহিত্যিকের ব্যক্তি-পরিচয় ও অবদান, প্রথম প্রকাশ: জুন, ২০০৩; ৪র্থ মুদ্রণ: সেপ্টেম্বর, ২০১৫।
১৭। আদর্শ অনুবাদকোষ (আরবী বাংলা ইংরেজী অনুবাদের বই), ১ম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০০১; ৭ম মুদ্রণ: সেপ্টেম্বর, ২০১৯।
১৮। আদর্শ নামকোষ (নামের বই) ১ম প্রকাশ: অক্টোবর, ২০০৫; ১০ম মুদ্রণ: ডিসেম্বর, ২০১৮।
১৯। তিন ভাষায় শিক্ষাঙ্গন পরিভাষা: স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়, শিক্ষা-সরঞ্জাম ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক বিষয়ের বাংলা, ইংরেজী ও আরবী পরিভাষা। প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০০৫; ৭ম মুদ্রণ: জানুয়ারি, ২০১৭।
২০। ক্বাছীদাতুল বুর্দাহ: কাব্যানুবাদ ও গদ্যানুবাদসহ ইমাম বূছীরী (র) রচিত মূল ক্বাছীদাহ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০০১; ৮ম মুদ্রণ: সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
২১। হারীরীর মাকামাত: অনুবাদসহ আবুল কাসেম আল-হারীরীর মাকামাতের ভূমিকা, ১ম দশ মাকামা এবং ১৮ ও ১৯নং মাকামা, প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ২০১৫; ২য় সংস্করণ: মার্চ, ২০১৬।
২২। ইসলাম ও বাস্তবতার আলোকে আরব জাতীয়তাবাদ: সৌদী আরবের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও ইসলামী গবেষক শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায ওরফে বিন বায লিখিত نقد القومية العربية على ضوء الإسلام والواقع নামক বইয়ের বাংলা ভাষান্তর। প্রথম প্রকাশ: মে, ২০১৪; ৩য় মুদ্রণ: ডিসেম্বর, ২০১৮।
২৩। ফেইসবুক কণিকা: বিভিন্ন সময়ে ফেইসবুকে প্রকাশিত লেখার সংকলন, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।
২৪। আমার কবিতা (স্বরচিত ও আরবী থেকে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন), প্রকাশকাল: মার্চ, ২০১৮।
২৫। জীবনের কিছু কথা (আত্মজীবনী), প্রথম প্রকাশ: জুন, ২০১৮; ২য় মুদ্রণ: মার্চ, ২০১৯।
[বি. দ্র. আমার এ সব বইয়ের প্রকাশক: রিয়াদ প্রকাশনী; ঠিকানা: (১) ৩৪, নর্থ ব্রুকহল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফোন: 01914758103; (২) ইসলামিয়া মার্কেট, অফিস গলি, নীলক্ষেত, ঢাকা, ফোন: 01916747898]
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ১ম পূনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ইত্যাদি থাকার কথা জেনেছিলাম। সেখানে আমি কোন লেখা দিতে পারিনি বলে এখানে আমার “ফেইসবুক কণিকা” বই থেকে ছোট ছোট ৫টি গদ্য রচনা সংযোজন করলাম:
১। মেঘেরা কেউ উত্তরে যাবে না (কল্পনা)
নদী দেখতে দেখতে পথ চলার বাসনায় নৌপথে গ্রীনলাইন লঞ্চে ঢাকা থেকে বরিশাল রওয়ানা হই। মুন্সীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত যেতে খানিকটা প্রশান্তির পাশাপাশি অনেকটা বিরক্তিও অনুভব করি। নানা রকমের নৌযান আর বালির জাহাজ নির্মল পানি দেখায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতেই থাকে। চাঁদপুরের কয়েক মাইল ভাটিতে এলে অলৌকিকভাবে অকস্মাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য নজরে আসে। যতদূর দৃষ্টি যায়, কোথাও কোন লঞ্চ কিংবা জাহাজ এমনকি কোন মাছ ধরার নৌকাও নেই। পুরো দৃশ্যপট একেবারে ফাঁকা। অনেক দূরে পশ্চিম দিগন্তে ওপারের গাছপালার অস্পষ্ট হালকা রেখা। এই নাহলে কি আর মেঘনা? এটাই তো পদ্মা-মেঘনার আদি আসল রূপ। মনে মনে বলতে থাকি:
“পদ্মা! তুমি পারবে, সাহস কর; বুক ফুলিয়ে বল: আমি মরব না, আমাকে বাঁচতেই হবে। কী করবে? হিমালয়ের পাদদেশে মানস সরোবর থেকে আসা আমার ধারা বাঁধ দিয়ে আটকে রাখবে? আমি টলব না। আমি দমব না। আমি হুংকার দিয়ে বলব: মেঘের কাফেলা! কেউ উত্তরে যাবে না। তোমরা সব এখানেই থাম এবং তোমাদের সকল সম্ভার আমার কাছে জমা রাখ। আমি ওদের টেনে নামাব আর ওদের অফুরন্ত জলরাশি বুকে ধারণ করে সৃষ্টি করব বেগবান আর অদম্য এক প্লাবন। আমাকে চোখ রাঙানো? আমাকে তিলে তিলে মারার হুমকি? আমি পাল্টা জবাব দেব। আমি শুধু নিজেই প্লাবিত হব না, আমি ভাসিয়ে দেব দু’কূলের সব। আমি সকলের অজান্তে গভীর করে নেব আমার তলদেশ। এভাবে আমি আবার আগের যৌবন ফিরে পাব। সাগরের পানিকে আমি আর হিমালয় থেকে ঘুরে আসার সুযোগ দেব না। আমার বাঁচার জন্য আমি সব পানি পথেই ধরে রাখব। আমি শুধু একাই বাঁচব না। বাঁচাব আমার সহোদরা মেঘনাকেও। তারপর একে একে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ সহ আমাদের সব সন্তান-সন্ততিকেও বাঁচাব। আমরা আবার উত্তাল হব, হব দুরন্ত। আমরা আমাদের দূষণকারী আর চর ও পার দখলকারীদের আর ছাড় দেব না। আমরা নিজেরাই ওদেরকে দৃষ্টান্তমূলক প্রাকৃতিক শাস্তি দিয়ে দেব। আমরা মেরুদণ্ডহীন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কোন মেকী মিছিল বা মানববন্ধনের দিকে আর তাকিয়ে থাকব না।”
আমি এসব ভাবছি আর লঞ্চের ডান পাশ দিয়ে মেঘনার শান্ত জলরাশির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দৃষ্টি সীমায় এসে-পড়া যাত্রীবোঝাই একটি দীর্ঘকায় খেয়ানৌকা আমার এ তন্ময় ভাবনার ইতি ঘটায়।
২। তুই কি একেবারে মানুষ হয়ে গেছিস? (রম্যরচনা)
এক জায়গায় বাঁধা কয়েকটি গরু কাড়াকাড়ি করে রাখালের দেয়া ঘাস খাচ্ছিল। গরুরা ভাবল এই খাবারে সবার পেটের চাহিদা মিটবে না। তাই প্রত্যেকে আগে খাবার জন্য একটু গায়ের জোর খাটাচ্ছিল। এক পর্যায়ে একটি সবল গরু একটি দুর্বল গরুর পেটে শিং দিয়ে আঘাত করে বসল। আহত গরুটির পেট দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। এটা দেখে আরেকটি গরু আঘাতকারী গরুটিকে তিরস্কার করে বলল, ‘‘তুই কি একেবারে মানুষ হয়ে গেছিস? এভাবে ওকে আঘাত করলি কেন?’’ আঘাতকারী গরুটি জবাবে বলল, ‘‘আমি তো পেটের ক্ষুধার জ্বালায় ওকে গুতো দিয়ে একটু আহত করেছি মাত্র। মানুষ হলে তো একেবারে নিহতই করে ফেলতাম। আমি মানুষের মত অত খারাপ এখনো হইনি রে ভাই।’’ দূর থেকে রাখাল এসব দেখে কাছে এসে বলল, ‘‘এই যে গরুরা কোথাকার! তোরা দিনে দিনে এত খারাপ হয়ে যাচ্ছিস কেন? আবার নিজেদের হানাহানির উদাহরণ দিতে গিয়ে সৃষ্টির সেরা মানুষকে টেনে আনছিস। ভারী পাজি তো!’’ আঘাতকারী গরুটি মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘‘শোনেন গুরু, আমি তো পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক প্রতিপক্ষকে একটু আহত করেছি। আপনার মানুষেরা তো কত রকম ক্ষুধা নিবারণের জন্য একেবারে মেরে ফেলাসহ আরো কত রকম জঘন্য অপরাধ করছে বলে শুনতে পাই। সেগুলো উচ্চারণ করতেও আমার লজ্জা হয়। গরু বলে আমাদের কান তো আর বন্ধ থাকে না।’’ রাখাল বলে, ‘‘শোন্, তবুও সবাই জানে, সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সেরা। তোরা তো পশু, গরু।’’ এবারে গরুদের আত্মসম্মানে লাগায় সবক’টা গরু সমস্বরে বলে উঠল, ‘‘কিন্তু সবার তো এটাও জানার কথা ছিল যে, সৃষ্টির সেরা এই মানুষ গুরুতর অপরাধ করলে আমাদের পশুদের চেয়েও খারাপ হয়ে যায়। আপনি কি মনে করেন, সেসব অপরাধ মানুষ করছে না? বলব দু’চারটা? আমরা গরুরা কিংবা অন্য পশুরা তার কোনটা করি কি? নাকি করতে পারি?’’ বেচারা রাখাল মানুষের অপরাধ সম্বন্ধে গরুদের সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘‘থাক, অত বুঝে কাজ নেই। তোমরা মারামারি না করে মিলেমিশে খাও। আমি আরো ঘাস এনে দিচ্ছি।’’
৩। “কুন্ ফা-ইয়াকূন” যন্ত্র কম্পিউটার
কর্মে কারিগরের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক। আবার প্রত্যেক কারিগর তার কর্মে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রাখতে চায় যা কারিগরের পরিচয় বহন করে। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিজীব। আল্লাহ তাঁর এক একটি অসীম ক্ষমতা থেকে সামান্য পরিমাণ তাঁর সৃষ্টিকে দিয়েছেন। তাতেই একেকটির কত চমক! তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে অন্য সব প্রাণীর তুলনায় নিজের ক্ষমতা আর বৈশিষ্ট্য থেকে একটু বেশি পরিমাণই দিয়ে থাকবেন। কিন্তু তারপরও মানুষ কত অক্ষম আর দুর্বল! আল্লাহ তো নিজেই বলেছেন, “মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
আল্লাহ সবকিছু শোনেন। তাই তিনি سميع (সর্বশ্রোতা)। তাঁর এই শ্রবণ-ক্ষমতার যে টুকু তিনি মানুষকে দিয়েছেন তা দিয়ে সে অল্প দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসা শব্দ শুনতে পায়। বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে না হয় আরো কিছু দূর থেকে আসা শব্দ শুনল। কিন্তু তারপরও কতকিছু মানুষের শোনার বাইরে থেকে যায়! আবার আল্লাহ সবকিছু দেখেন। তাই তিনি بصير (সর্বদ্রষ্টা)। তাঁর এই দর্শণ-ক্ষমতার যে টুকু মানুষকে দিয়েছেন তা দিয়ে সে অল্প দূরের বস্তু দেখতে পায়। দূরবীন বা আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে না হয় আরো কিছু দূরের জিনিস দেখল। কিন্তু তারপরও কত কি মানুষের দেখার বাইরে থেকে যায়!
আমাদের নাগালে কম্পিউটার আসার পর মনে হয়েছিল, মানুষকে দেওয়া আল্লাহর আরেকটি ক্ষমতা বা বৈশিষ্টের বহিঃপ্রকাশ এতদিন পরে ঘটল। সেটি হল “কুন ফা-ইয়াকূন (হও আর হয়ে যায়)” ক্ষমতা। অর্থাৎ আল্লাহ যখন কিছু করতে মনস্থ করেন তখন শুধু বলেন, “কুন: হও’’ আর অমনি তা হয়ে যায়। মানুষকে তো একটু একটু করে সবকিছু করতে হয়। “হয়ে যাও” বললেই তো কিছু হয়ে যায় না। কিন্তু কম্পিউটার আবিষ্কারের পর দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সেরা মানুষকে এই জাতীয় কিছু ক্ষমতাও দিয়েছেন।
শোনা যায়, কম্পিউটার যন্ত্র আবিষ্কারের সময় নাকি বড় বড় অঙ্ক আর হিসাব করার সুবিধার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এই যন্ত্রটি দ্বারা যে এত সহযে এতসব কাজ করা সম্ভব হবে তা হয়তো এর আবিষ্কর্তারাও প্রথমে কল্পনা করেনি। অনেক বড় বড় কাজ সমাধার জন্য সঠিক মাপ আর হিসাব এই যন্ত্র অনায়াসে করে দেয়। আমরা সাধারণ লেখাপড়ার কাজে কম্পিউটার থেকে যে সুবিধা পাই তা যেন যাদুকেও হার মানায়। হাজার পৃষ্ঠার একটি বই এক ক্লিকে কপি করতে কিংবা মুছে ফেলতে পারি। মুহূর্তে বিশাল একটি সাহিত্যকর্মের লিপির স্টাইল পরিবর্তন করতে কিংবা বড় বা ছোট করতে পারি। অর্থাৎ যা করতে চাই তা যেন “হও’’ বললেই হয়ে যায়। এটা আর কিছুই নয়, আল্লাহর দেয়া সামান্য পরিমাণ “কুন ফা-ইয়াকূন” ক্ষমতা লাভ করে মানুষ কম্পিউটার আবিষ্কারের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব করেছে।
৪। আল্লামা নিয়াজ মাখদূম ওরফে খোতানী হুজুর (স্মৃতিচারণ)
ছারছীনা দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসার প্রয়াত হেড মোহাদ্দেস আল্লামা নিয়াজ মাখদুম (রহ) ওরফে খোতানী হুজুরের কথা মনে পড়ছে। চীনদেশের খোতান প্রদেশে জন্মস্থান হওয়ায় “খোতানী হুজুর” নামে খ্যাত হয়েছেন। এই নামে খ্যাত হওয়ার পূর্বে আমরা খোতানী হুজুরকে “চীনা হুজুর” বলতাম। খোতানী হুজুর যৌবনে চীনের সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশত্যাগী হন এবং ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে হাদীসশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এ সব কথা আমি কোন বইতে পড়িনি। পূর্বসুরীদের কাছ থেকে শুনে জেনেছি। সম্ভবত হুজুরের প্রথম জীবনের সেনা বিদ্রোহের ব্যাপারটি আড়ালে রাখার জন্য তাঁকে “চীনা হুজুর” বলতে বারণ করা হয়েছিল এবং জন্মস্থান “খোতান” প্রদেশের নামে “খোতানী হুজুর” বলতে বলা হয়েছিল। যতদূর মনে হয়, এই আখ্যা পরিবর্তনে আমার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মওলানা আজীজুর রহমান (রহ) ওরফে কায়েদসাব হুজুরের একটি ভূমিকা ছিল।
ছারছীনায় খোতানী হুজুর মূলত কামেল ক্লাসে বোখারী শরীফ পড়াতেন। যারা তখন ছারছীনায় কামেল পড়েছেন তারা অত বড় মোহাদ্দেসের কাছে হাদীস পড়ার সুযোগ পাওয়ায় বড়ই ভাগ্যবান। আমি ছারছীনায় ফাজেল পর্যন্ত পড়েছি। তারপর কামেল পড়ার জন্য ঢাকায় চলে আসি। খোতানী হুজুর তখন ফাজেলে হাদিসের একটিমাত্র ক্লাস নিতেন। আমি সেখানেই তার অল্প কিছুদিনের ছাত্র। তাই আমার মনে তাঁর পূর্ণাঙ্গ ছাত্র হতে না পারার একটা আক্ষেপ রয়ে গেছে। যদিও ঢাকায় কামেল পড়ার সুবাদে মুফতী আমীমূল এহসান (রহ) ও আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী (রহ)-এর ছাত্র হতে পারায় নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয়। যা হোক, ছারছীনায় সাত বছর পড়াশুনাকালে খোতানী হুজুরের সাথে মনে করার মত আমার দুটি স্মৃতি আছে:
এক: একবার প্রচন্ড ঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়েছিল এবং আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসে গোটা ছারছীনা তলিয়ে গিয়েছিল। খোতানী হুজুর তখন পরিবার নিয়ে নদীর পাড়ের দিকে একটি অসম্পূর্ণ একতলা দালানে থাকতেন। সেখান থেকে পানি ভেঙে তাঁর ছোট ছোট মেয়েদের কাঁধে করে উঁচু ভবনে নিয়ে আসার কাজ আমরা কয়েকজন ছাত্র করেছিলাম। হুজুর পরে ঐ ঘটনা অন্যদের কাছে বলার সময় আমার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন।
দুই: আমি ফাজেল শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা (এ ডি পি আই) ছারছীনা মাদ্রাসা পরিদর্শনে এসেছিলেন। নিচের থেকে শুরু করে ফাজেল পর্যন্ত ক্লাসগুলো বেশ তাড়াতাড়ি ভিজিট করে বিশেষ মুডে কামেল ক্লাসে ঢুকলেন। আমরাও কয়েকজন পিছনে পিছনে ঢুকলাম। ক্লাসে ছারছীনার ২য় মোহাদ্দেস বিহারী হুজুর হাদীস পড়াচ্ছিলেন। পরিদর্শক মহোদয় হাদীস বিষয়ে বেশ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন বলে মনে হয়। তার নানান প্রশ্নে ছাত্ররা সব নাজেহাল। তখন তিনি ছাত্রদেরকে বাদ দিয়ে ক্লাসের শিক্ষক বিহারী হুজুরের সাথে হাদীসের নানারকম বাহাছ শুরু করলেন। ততক্ষণে আরো কয়েকজন শিক্ষক এসে আলোচনায় যোগ দিলেন। এক পর্যায়ে আমাদের মনে হল, বিহারী হুজুরসহ শিক্ষকরাও যেন তার সাথে পেরে উঠছেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে কে একজন ইতিমধ্যেই খোতানী হুজুরকে বাসা থেকে ডেকে আনতে লোক পাঠিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে খোতানী হুজুর হাঁপাতে হাঁপাতে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তখন আর কেউ কিছু বলছেন না। খোতানী হুজুর একাই হাদীস বিষয়ে বিস্তারিত ও পণ্ডিত্যপূর্ন আলোচনা করে পরিদর্শকের সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিলেন। পরিদর্শক মহোদয় তৃপ্তির হাসি হাসলেন এবং স্বীকার করলেন যে, ছারছীনায় আসলেই হাদীস বিষয়ে পারদর্শী বড় আলেম আছে। ছারছীনার ছাত্র হিসেবে আমরাও তখন বুকে অনেক গর্ব অনুভব করলাম।
আসুন, আমরা সবাই এই মহান শিক্ষকের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতে চিরস্থায়ী শান্তিতে রাখেন এবং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের জন্য ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ বিধান করেন।
৫। হাসিটা আনন্দের না কষ্টের? (বাস্তব ঘটনা)
৩০ জুন, ২০১৭ তারিখে পুরোপুরি অবসরে যাওয়ার পর বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমার কর্মস্থল আরবী বিভাগে খুব একটা যাওয়া হয় না। একটি কাজে গতকাল এবং আজ ওখানে গিয়েছিলাম।
গতকাল দেখলাম, বেশ জাঁকজমক সহকারে অনার্স শিক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠান হচ্ছে। একটা প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। পাশ করার পর কর্মজীবন ও সংসারজীবনেও ওদের এই প্রাণচাঞ্চল্য বজায় থাকুক এবং ওরা কোনরূপ হতাশায় না পড়ুক, এই কামনা করি।
আজ যখন গেলাম তখন দেখলাম, ছেলেমেয়েরা অনেকেই বারান্দায় ঘোরাফেরা করছে। আমার কুশল জানার জন্য অনেকেই এগিয়ে এল। বেশ আন্তরিকতার সাথে আমার স্বাস্থ্য ও কাজকর্মের খবরও অনেকে জানতে চাইল। আমার খু্বই ভাল লাগল। মনে হল, আমি কিছুক্ষণের জন্য আমার স্বজনদের মাঝে ফিরে এসেছি।
বারান্দায় নিজের চারপাশে একসাথে এতগুলো চেনা মুখ দেখে অনুভব করলাম, ক্লাসরুম আর বসার রুম না হলেও বিভাগের সামনের এই বারান্দাটা যেন এখনো আমার নিজের। সবাইকে বিদায় জানিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়াতেই একজন ছাত্র দৌড়ে এসে বিনয়ের সাথে হাতে একটু আতর লাগিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, ঘ্রাণটা কেমন স্যার? এক পা লিফটে রেখে বললাম, ভালই তো। অমনি একরকম জোর করে আতরের কৌটাটি আমার হাতে গুজে দিল। আমি সাধারণত কারো কাছ থেকে কিছু নিতে আগ্রহী হই না। কিন্তু ও কষ্ট পেতে পারে মনে করে আর ফিরিয়ে দিলাম না।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। নিজের হাসি দেখা না গেলেও নিজের মুখে মৃদু হাসি টের পেলাম। কিন্তু হাসিটা আনন্দের, না কষ্টের, তা ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না।
সৃজনশীল রচনার জন্য মাতৃভাষা
মানুষ যত ভাষাই জানুক না কেন, গদ্যে কিংবা ছন্দে সৃজনশীল কিছু রচনার জন্য একজন মানুষের মাতৃভাষাই সঠিক মাধ্যম। আমার ক্ষেত্রে এটা একেবারেই সত্য। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে উর্দু, আরবী ও ইংরেজীতে কিছু লেখালেখি করলেও মাতৃভাষা বাংলায় যতটুকু লিখেছি ও লিখছি তাতেই খানিকটা তৃপ্তি অনুভব করি ।
কাব্যচর্চা তেমনভাবে না করলেও মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, একটু মনোযোগ দিলে দু’চার লাইন কবিতা রচনা করা কিংবা অন্য ভাষার কবিতা নিজের মাতৃভাষায় অনুবাদ করা একেবারে দুঃসাধ্য নয়। সেই মনে হওয়া থেকে সখের বশে রচিত ও অনূদিত কিছু কবিতা নিয়ে “আমার কবিতা” পুস্তিকাটির আত্মপ্রকাশ। মন চাইছে, সেখান থেকে ছোট ছোট কয়েকটি কবিতা এখানে উল্লেখ করি:
১। আমার গ্রাম: ইলুহার
বাংলাদেশের বরিশাল জেলা বানারিপাড়ায় থানা,
গ্রাম ইলুহার পোস্ট মলুহার থাক সকলের জানা।
এটাই আমার জন্মস্থান বাড়িঘর সবই আছে,
ছারছীনা হতে সামান্য দূরে সন্ধ্যানদীর কাছে।
দুই বোন যেন দুটি গ্রাম এই ইলুহার, মলুহার,
স্কুল আছে, মাদরাসা আছে, রয়েছে হাট বাজার।
গ্রাম দুইটির মাঝখানে বহে খাল, শোন এর হাল:
মানুষেরা নয়, মহিষ হাঁটিয়া কাটিয়াছে এই খাল।
পুবদিক থেকে পশ্চিমে গেছে আঁকাবাঁকা হয়ে চলি,
বড় মনোরম! কেড়ে নেয় মন এ মহিষকাটাখালি।
ইলুহার গ্রামে হিন্দুরা আছে, মুসলিম আছে বেশি,
উভয়ের মাঝে হৃদ্যতা আছে, নেই কোন রেষারেষি।
দশরথ দাস গরু কেনে বেচে হাটে মাঠে নিয়ে যায়,
মুসলমানেরা সেই গরু কিনে জবাই করিয়া খায়।
সাধন আসিয়া জনতার হাটে সেলুন খুলেছে ঠাটে,
ওর দোকানেই মুসলমানেরা লাইন ধরে চুল কাটে।
যার যার কাজ স্বেচ্ছায় সবে করে যায় অনায়াসে,
হিন্দু কে আর মুসলিম কে তা কেউ নাহি জিজ্ঞাসে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যদি দেখিবার কেহ চায়,
ইলুহার গ্রামে আসিয়া সে যেন একবার দেখে যায়।
২। সন্ধ্যানদীর ইলিশ মাছ
ওরে আমার সন্ধ্যানদী ইলিশ তোমার কই?
ইলিশ তো নয় ফুটত যেন তপ্ত খোলায় খই।
আষাঢ় এবং ভাদ্রমাসে জোয়ার ভাটা জুড়ে
মুখর হত সন্ধ্যানদী জেলে নৌকার ভিড়ে।
ইলশে গুড়ি বৃষ্টি যখন নামত বর্ষাকালে
নেচে নেচে ইলিশগুলো ঢুকত এসে জালে।
জাটকা ইলিশ চিনত না কেউ জানত না এর নাম,
বিঘত চওড়া বিরাট ইলিশ আমরা যে ধরতাম।
একটার ওজন দু’তিন কেজি তার যে কী স্বাদ ছিল!
দেখছি এখন এক কেজিতেই লাগছে অনেকগুলো।
অজ্ঞ লোকে আজকে যাকে “বড় ইলিশ” বলে
“বাচ্চা” বলে আমরা তাহা ছেড়ে দিতাম জলে।
ইলিশ কত বড় হয় তা তোমরা কি কেউ জান?
বোকার মত কারেন্ট জালে জাটকা ধর কেন?
বড় ফাঁসের জাল বানিয়ে বড় ইলিশ ধর,
বাচ্চাগুলো বের হয়ে যাক ওরাই হবে বড়।
আগের মত আবার ভরুক “সন্ধ্যা” ইলিশ মাছে,
ভাবব আমি আমার নদে আজও ইলিশ আছে।
৩। হাজার-এ-আসওয়াদ (কালো পাথর)
হাজার-এ-আসওয়াদ দেখেছো কি তুমি কাবা শরীফের গায়?
খানিক ঝলক দেখে নিতে পারো মানুষের চেহারায়।
কাবার কোণায় ধরিবারে তায় নরনারী যাহা করে,
নবীজির দ্বীন আদৌ কি তার অনুমতি দিতে পারে?
খালি পাও যদি তোমরা কখনো ধরিও চুমিও তবে,
ভিড়ের মধ্যে অমন করোনা, ইশারা করিলে হবে।
যদি কভু ভাব দেখিতে কেমন রং সেই পাথরের,
দেখে নিও রং কালো মানুষের ললাটের কপোলের।
আফ্রিকা থেকে এসেছে আমার কালো ভাইবোন যত
সৃষ্টি তাদেরে করেছেন খোদা যতন করিয়া কত!
কালো পাথরের খানিক পরশ করেন তাদেরে দান;
ওদেরে দেখিলে কালো পাথরের করা যায় অনুমান।
হাজার-এ-আসওয়াদ অন্তরে লয়ে ফিরিবে যখন দেশে,
কালো মানুষেরে যেয়ো তুমি ভাই আজীবন ভালবেসে।
৪। তায়েফ নগরী
তায়েফ নগরী সৌদি আরবে গ্রীস্মনিবাস জানি,
ফুলে ফলে ভরা সবুজেতে ঘেরা, আছে বৃষ্টির পানি।
মৃদু সমীরণ বহে অনুক্ষণ শীতলের সমারোহ,
রুগ্ন লোকেরা আসে এ শহরে সুস্থ করিতে দেহ।
বাগানের ফল স্বাদে অনুপম গাছ থেকে পাড়া তাজা,
যেই যেটা খায় অমনি সে কয়, এ দেখি দারুণ মজা!
তায়েফের হাওয়া ফলমূল খাওয়া সবারই আকর্ষণ,
আসে হেথা তাই লোকেরা সবাই জুড়াইতে দেহ মন।
উচ্চ পাহাড়ে বিদ্যুৎ বাতি নিশীথে যখন জ্বলে
নিচ থেকে দেখি আকাশের গায়ে তারকারা কথা বলে।
তায়েফে আসিলে অন্তরে এক নিষ্ঠুর স্মৃতি ভাসে,
নবীজির খুন ঝরেছে হেথায় দ্বীন প্রচারেতে এসে।
নিবেদন করি দেশবাসী আর প্রিয়জনে একে একে,
দেখিলাম যাহা তায়েফ শহরে সবাই যেন তা দেখে।
কেউ যদি কভু মক্কায় আসে হজ কিবা ওমরায়
সময় করিয়া একবার যেন তায়েফ সফরে যায়।
৫। আমার ছাত্রছাত্রী
কর্মজীবনে পড়িয়েছি আমি অগণিত ছেলেমেয়ে,
তৃপ্ত হয়েছে আমার এ মন কুড়ানো মানিক পেয়ে।
কোথাও কখনো দেখিলে আমায় ছুটে আসে ওরা কাছে,
বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসে, “স্যার! শরীরটা ভাল আছে?”
ফোন করে নেয় খবরাখবর ফেসবুকে দেয় সাড়া,
মেসেঞ্জারেও লিখিয়া জানায় আকুতি পাগলপারা।
কেউ কেউ লিখে, “আপনাকে স্যার দেখি না যে কতদিন!
আপনার কথা থাকিবে স্মরণ, বেঁচে থাকি যতদিন।”
কেউ কেউ বলে, “ক্যাম্পাসে স্যার আসছেন না যে মোটে,
কেমন আছেন? এখন কি করেন? কিভাবে সময় কাটে?”
বড় আদরের শিক্ষার্থীরা রেখেছে আমায় মনে;
আমার মনের কোন্খানে ওরা তা কি ওরা ঠিক জানে?
আগে দেখিতাম এখন দেখি না সারাক্ষণ মনে পড়ে,
ওদেরকে আমি কত মিস করি, বুঝাব কেমন করে?
কে বলে আমার চার ছেলেমেয়ে? আসলে যে ওরা কত,
কে দিবে তাহার সঠিক হিসাব ক’হাজার কয় শত?
বিধাতার দানে বেছে নিয়েছিনু শিক্ষকতার পেশা,
চাকরি তো নয়, পড়ানোর কাজ আসলে আমার নেশা।
চেষ্টা করেছি শতভাগ দিতে বিবেকের দাবি বলে,
আমার বাবার শিক্ষকতার অনুসরণের ছলে।
আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা বড় আশা নিয়ে আসে,
প্রস্তুতি ছাড়া পড়ালে যে তারা তুষ্ট হবে না ক্লাসে।
সঠিক সময়ে প্রত্যেক ক্লাস শুরু শেষ করা চাই,
নাহলে বেতন হালাল হবার আর কোন পথ নাই।
দোকানে আসিয়া ভাল মালামাল না পেলে খরিদ্দার
হতাশ হবেই, এমন দোকানে আসিবে না কভু আর।
পাঠদানকালে এসব ভাবনা ভাবিতাম প্রতি ক্ষণে,
হয়তো আমার শিক্ষার্থীরা রাখিয়াছে তাহা মনে।
জীবনে আমার বড় সঞ্চয় ওদের এই ভালবাসা,
মানুষের কাছে কোন কিছু আর নাহি করি প্রত্যাশা।
[অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পূনর্মিলনী উপলক্ষে আকাশের স্মরণিকায় আমি আমার এ বিনীত লেখাটি রাখলাম। ভাল লাগলে হিতাকাংক্ষীরা যার যার বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার করে অনেককে এটি পাঠ করার সুযোগ করে দিতে পারবেন। তাহলে আশা করি, আমার এই অনুভূতির পাঠকসংখ্যা নেহাত কম হবে না। এই পূনর্মিলনীতে অংশগ্রহণকারী আমার সহকর্মীদের প্রতি রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা। আর আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য থাকলো প্রাণভরা দোয়া।]