ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে হারিয়ে সরকার গড়তে যাচ্ছে আঞ্চলিক দল ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) ও কংগ্রেসের জোট। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক নিবন্ধন নিয়ে ভারতজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে বিজেপির এই পরাজয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। নির্বাচনের এ ফলাফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ আর কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর কার কী লাভ-ক্ষতি হলো, তা-ই নিয়ে চলছে আলোচনা।
নরেন্দ্র মোদি
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—এই ধারণাটা এবার একটু ধাক্কা খেল। মাত্র আট মাস আগের লোকসভা নির্বাচনে এ দাবির সপক্ষে প্রমাণ মিলেছিল বটে। তবে এখন এটি পরিষ্কার, ভোটারদের কাছে জাতীয় নির্বাচন আর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এক না। আর রাজ্য পর্যায়ে বিজেপির প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলায় মোদির আবেদনই যথেষ্ট না—এ প্রমাণও মিলল এবার।
মহারাষ্ট্রের পর ঝাড়খন্ডের পরাজয় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে একটু পিছিয়েই ফেলেছে বলা যায়। ঝাড়খন্ড হাতছাড়া হওয়ায় দলে এখন বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল ১১; যার অর্থ হলো কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে। ফলে সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের মতো ঝাড়খন্ডেও মোদি নিজে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মোদির প্রচারে লোকসমাগমও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এখন ভাবতে হবে ‘জাতীয়তাবাদের’ নির্বাচনী ইস্যু করা মাঠে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেছে কি না।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ
চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনে জয়ের মতো বিভিন্ন নির্বাচনে সাফল্য এনে দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। কিন্তু বছর শেষে রাজনৈতিক কৌশল ও তাঁর নিজের মনোনয়নের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ নিয়ে দলের মধ্যেও দুটি ধারা দেখা দিয়েছে। একপক্ষ বলছে, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ডের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে অমিত শাহ মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাই নির্বাচনের এই ফলাফল স্থানীয় বিজেপি নেতাদের ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। দলের আরেক পক্ষের মতে, নিজের স্বভাব অনুযায়ীই অমিত শাহ এই নির্বাচনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। একদিকে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার দলের প্রধান। তাই এই দুইয়ের মধ্যে তাঁর ভূমিকার সমন্বয় করার সময় এসেছে। তা ছাড়া নির্বাচনের এই ফলাফল দলের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে মাঠের দূরত্বকেও প্রতিফলিত করে। এটা এখন পরিষ্কার যে অমিত শাহকে রাজ্যপর্যায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
বিজেপির পরবর্তী পরীক্ষা হবে দিল্লিতে, যেখানে আম আদমি পার্টি দুর্দান্ত সময় পার করছে। অমিত শাহ হয় তো এই আশা করছেন, রাজধানীতে জয় এনে দিয়ে তিনি বিজেপির অবস্থান পাল্টে দিতে পারবেন।
সোনিয়া গান্ধী, কংগ্রেস সভাপতি
পরপর দুবার লোকসভা নির্বাচনে পরাজয় ও সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধীর পদত্যাগের ফলে দলের অভ্যন্তরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে সাময়িকভাবে কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নেন সোনিয়া গান্ধী। ঝাড়খন্ড নির্বাচনে এই জয়ের মাধ্যমে প্রতীয়মান হলো, তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এখনো প্রখর।
হরিয়ানায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তিনি ভুপেন্দর সিং হুড্ডাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভুপেন্দর সেখানে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু ফলাফলের পর তারা শারদ পাওয়ারের নেতৃত্ব মেনে নিতে তৎপর হলো। কিছু দোটানার পর শিবসেনাকেও সমর্থন দেয়।
ঝাড়খন্ডেও তারা প্রায় একই ধরনের নীতি অনুসরণ করে। কংগ্রেস তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে লড়ে। তারা ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সরেনের নেতৃত্ব মেনে নেয়। আবার স্থানীয় ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা বিজয়ে পেয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ফলাফলকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিফলিত করা, কংগ্রেস একাই রাজ্য পর্যায়ে জিততে পারে, তা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে দলের মনোবল চাঙা করা এবং আগামী বছর দিল্লি ও বিহার নির্বাচনে দলকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়াও তাঁর চ্যালেঞ্জ, যেখানে তাঁর দলের অবস্থান অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
হেমন্ত সরেন, জেএমএম নেতা
হেমন্ত সরেনের বাবা শিবু সরেন ঝাড়খন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। ঝানু এই উপজাতীয় নেতা ঝাড়খন্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) নেতা হেমন্ত সরেনের জন্য এই জয় একটি শুভসূচনা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন ও সর্বশেষ ২১০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধারাবাহিক পরাজয় হয় জেএমএমের। আর এর ফলে স্বল্প গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়েই হেমন্তের দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনৈতিক ধারা শুরু হলো। সরেন দুটি আসন থেকে নির্বাচন করেন। একাধিক পরাজয়ের পরও হেমন্ত জেএমএমকে ভেঙে যেত দেননি। স্থানীয় ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা এবং নির্বাচনে দুর্দান্ত জয়ের জন্য সরেন অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন হেমন্ত সরেনের জন্য সহজ হবে না। কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) সঙ্গে গড়া বৃহৎ জোটের স্বার্থ এবং চাহিদার প্রতি তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীলতা আনার জন্য তাকে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে মাওবাদী চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
রঘুবর দাস, বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী
২০১৪ সালে বিজেপি যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রঘুবর দাসকে তুলে এনেছিল, তখন অনেকই অবাক হয়েছিলেন। রঘুবর দলের একজন ঝানু নেতা, দলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তিনি একজন সদস্য এবং পাঁচবারের এমএলএ ও সাবেক উপ-মুখ্যমন্ত্রী। মূলত নজর ছিল, একজন অ-উপজাতি হিসেবে উপজাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি রাজ্যকে তিনি শাসন করতে পারবেন কি না।
রঘুবর পূর্ণ মেয়াদেই তাঁর প্রথম সরকার পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল বলছে, জনপ্রিয়তা স্থায়ী কোনো বিষয় না।
রঘুবরের কর্মপন্থা তাকে উপজাতিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। তাঁর কর্মকাণ্ড তাকে তাঁর নিজ দলের নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এর বড় উদাহরণ হলো, দলের প্রভাবশালী নেতা সূর্য রায় স্বতন্ত্রভাবে লড়ে জমশেদপুর পূর্বে রঘুবরকে পরাজিত করেছেন। রঘুবর বিজেপির জোট রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। পরাজয়ের পর দলের ভেতর থেকেই তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঝাড়খন্ডে বিজেপি কি রঘুবরের ওপরই আস্থা রাখবে, নাকি দল অন্য আরেকজনকে দায়িত্ব দেবে তা-ই দেখার বিষয়।