লেক অন্টারিওর তীর ধরে গড়ে ওঠা কানাডার সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত শহর টরন্টো। টরন্টোর শহর বিন্যাসের সঙ্গে ঢাকার অনেক মিল পাই। যেমন লেক অন্টারিও-বুড়িগঙ্গা, আমরা থাকি স্কারবোরো-যাত্রাবাড়ী, কিছুদূর গেলেই ডাউন টাউন-মতিঝিল, আর একটু সামনে ইয়র্ক-পুরান ঢাকা, একেবারে নর্থে বনেদি এলাকা ভন, রিচমন্ড হিল; আমাদের ঢাকার গুলশান, বনানী। ঢাকায় যেমন পানি দেখতে আশুলিয়া যেতাম, এবার আমাদের স্বচ্ছ নীল পানি দেখার জন্য একটু দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।
দুটো গাড়িতে আমরা তিন পরিবার, শহর রাস্তা পেরিয়ে ছুটে চলছি হাইওয়ে ৪১০ ধরে। ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার বেগে সবকিছু পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দুপাশের ঘরবাড়িগুলো হালকা হয়ে সবুজ ফসলি মাঠের শুরু। লাল–হলুদ রঙের বড় বড় খামারবাড়ি, আর চারপাশে ভুট্টা–গমখেত। একপাশে সবুজ ভুট্টা আরেক পাশে হলুদ গমখেতের ক্যানভাস যেন মনে হয় শুধু একজন শিল্পীর জন্য অপেক্ষা। মাঝেমধ্যে হঠাৎ কিছু ঘোড়া, গরুর ছোটাছুটি আমাদের গ্রুপের ছোট সদস্যদের আনন্দ বাড়িয়ে দিল। শহর পেরিয়ে গ্রাম, দুই লেনের রাস্তা থেকে এক লেন, কোলাহল থেকে স্নিগ্ধ নীরবতা।
হঠাৎ আমাদের সব আনন্দ উধাও করে দিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে বইতে লাগল দমকা হাওয়া আর শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। গাড়ির ছাদে যেন আকাশের সব ক্রোধ ভেঙে পড়ছে। এত বৃষ্টি যে গাড়ির ওয়াইপারও আর নিতে পারছে না। কোনোভাবে ইমারজেন্সি লাইট অন করে সাবধানে সামনে এগোচ্ছি। অনেক দিন পর সেই দেশি ঝুমবৃষ্টি, সেই একই গন্ধ, একই রং। কানাডায় সচরাচর এই ক্যাটস অ্যান্ড ডগসের খেলা অনেক কম দেখা যায়। আমি আর নাদিয়া গল্প বানাতে থাকি। কোন কারণে এই বৃষ্টিকে ক্যাটস অ্যান্ড ডগস বলে। গুগলে খোঁজ করে অনেক গল্প থেকে একটা মজার গল্প পেলাম। অনেক অনেক আগে এ রকম দিনে বৃষ্টির তোড়ে ছাদ থেকে কুকুর–বিড়ালেরা পা পিছলে পড়ে যেত, তাই এই ঝোড়ো বৃষ্টির নাম ‘ক্যাটস অ্যান্ড ডগস’।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে সাতরঙা আকাশটা আবার ঝলমল করে উঠল। সবুজ মাঠে রোদ পড়তেই সবকিছু চকচক করতে লাগল। মাঠের পর মাঠ বিছিয়ে রাখা খড়ের গাদাগুলো, রাস্তার পাশে শত শত উইন্ড মিলের পাখাগুলো একসঙ্গে আবার গাইতে লাগল। চলতে চলতে সোজা পিচ ঢালা রাস্তাটা একেবার লেকের পানিতে নেমে গেছে আর আমরাও পৌঁছে গেলাম জাদুর শহর টোবারমুরী। আগে থেকেই আমাদের ফ্লাওয়ার পট আইল্যান্ডে যাওবার বোটের টিকিট কাটা ছিল। টাই টাই সময়ে কোনোভাবে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখেই আমাদের ভোঁ–দৌড়, একটু স্ট্রেচ করারও সময় পেলাম না।
টোবারমুরী থেকে ফ্লাওয়ার পট যাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্যাকেজের বোট ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা একটা এক্সপ্রেস জেটের ট্যুর নিলাম। খোলা মাঝারি আকারের জেট বোট, ৩০-৪০ জন একসঙ্গে ভ্রমণ করা যায়। যাত্রা শুরুর মিনিট পাঁচেক পরে আমরা ‘বিগ টাব হারবার’ পৌঁছালাম। চমৎকার সুন্দর একটা লাইট হাউস আর শত বছরের পুরোনো ডুবন্ত জাহাজ এই হারবারে।
জেট বোটের ওপর থেকে প্রায় ২০ ফুট পানির নিচে দুটো জাহাজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রায় দেড় শ বছর আগে কোনো এক দুর্ঘটনার পর জাহাজ দুটোকে এখানে নিয়ে আসা হয়। আর তারপর থেকে এই কঙ্কালগুলো এখানেই আছে। ডানে–বাঁয়ে, ওপরে–নিচে সবাই এখন ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। শিপরেকের পাশেই আছে সুন্দর একটা লাইট হাউস। পুরোটা সাদা রঙের আর মাথায় মনে হচ্ছে লাল রঙের টুপি পরানো। কায়াকিং, স্নোরকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য অসাধারণ এক জায়গা। ট্রেনিংসহ সব গিয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। এই নীল পানির নিচের সাঁতার কাটার লোভ সামলানো অনেক কষ্টের ব্যাপার হয়ে গেল।
লাইট হাউসটিকে পেছনে ফেলে আমাদের জেট বোট এবার তার আসল রূপে ফিরে যেতে লাগল। প্রচণ্ড গতিতে ঢেউয়ের ওপর বড় বড় ঝাঁপ দিয়ে লেক হিউরন দিয়ে মনে হয় উড়ে যাচ্ছি আমরা। সবার চেহারা হাসিখুশি দেখালেও মনে মনে যে আল্লাহকে ডাকা শুরু হয়ে গেছে, এটা সবার নীরবতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নাদিয়া মজা করে নামীরা নেহানকে বলে উঠল, এ জন্য বলি, একটু বেশি খাওয়াদাওয়া করতে, এখন বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেলে কিন্তু কিছু করার নাই। এই কথা ভাবতে ভাবতেই আমার হাতের ফাঁক গলে ঠিক চড়ুইপাখির মতো মাথার ক্যাপটা বাতাসে উড়ে চলে গেল। হাতে নিয়ে রাখলাম, যাতে মাথা থেকে উড়ে না যায়। এখন হাত থেকেই চলে গেল। বোট একটু ডানে–বাঁয়ে করলেই পানির ছটা এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
দ্বীপের কাছাকাছি আসতেই ফ্লাওয়ার পটটা দেখতে পেলাম। পাথরের লম্বা দুইটা চাই পানির মধ্যে হাজার বছর ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মূল দ্বীপ থেকে আলাদা হয়ে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, অবিকল একটা পটের মতো, আর এ থেকেই এই দ্বীপের নামকরণ। জেট-বোট থেকে নেমেই পানির তীর ধরে হেঁটে যাওয়ার সুন্দর রাস্তা। কখনো একবারে পানির পাশ দিয়ে পাথুরে বিচের ওপর দিয়ে, আবার কখনো বনের ভেতর দিয়ে একেবারে লাইট হাউস পর্যন্ত চলে গেছে। খোলা জায়গা পেয়ে বাচ্চাকাচ্চাগুলো চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করছে আর আমরা নীল পানির ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তুলি। রিলাক্সের জন্য ফ্লাওয়ার পট আইল্যান্ড আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, চুপচাপ কোনো একটা জায়গা ধরে সারা দিন বসে থাকা যায়। পানির ঢেউ এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে, আমি আর নাদিয়া বসে ঢেউ দেখি। ঢেউ আসে, ঢেউ যায় আর আমরা গুনতে থাকি এক দুই তিন…।
ঘণ্টা দুই হাঁটাহাঁটির পর বোটে করে আবার টোবারমুরী এলাম। এত হাঁটাহাঁটির পর ক্লান্ত সবাই এখন খাওয়াদাওয়ার জন্য ব্যাকুল। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দেখি ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস অল ইউ কেন ইট’। সতেরো ডলারে যত খুশি তত খাও। আমাদের যেই পরিমাণ ক্ষুধা লেগেছে এই সাইনবোর্ড দেখে তো চোখের সামনে হাজির বিরিয়ানি দেখতে পাচ্ছি। রাস্তার পাশে তাঁবু টানিয়ে খোলামেলা দোকান।
পাইরেটসের ড্রেস পরে ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করে, মজা করে সবার সঙ্গে ছবি তোলে। খাবার আসতে আসতে কে কতগুলো খেতে পারবে, এই নিয়ে বিশাল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। খাবার চলে এল, দুটো বড় আকারের ফিলে আর সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। একের পর এক রাউন্ড দিয়ে যাচ্ছে আর ঘপাঘপ শেষ। দেশের বিয়েবাড়িতে খাবার শর্ট পড়া শুরু হলে একটা বুদ্ধি ছিল পোলাও বা বিরিয়ানিতে একটু তেল বেশি দিয়ে দিত। ওরাও এখন এই স্ট্যাটিজি শুরু করে দিল। প্রতিবার নিয়ে আসে আর আগের থেকে তেলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, কিন্তু আমরাও হাল ছাড়ব না। টিস্যু দিয়ে তেল মুছে মুছে খাওয়া চলছে। প্রায় ৯-১০ রাউন্ড খাওয়ার পর মনে হলো এবার আমাদের থামা দরকার। আগের বছর যেই ওয়েটারটা আমাদের সার্ভ করেছিল তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না এবার। রাজীব বলে উঠল, ‘আগেরবার যত খাইছিলাম এ জন্য মনে হয় ওর চাকরি গেছে, পরের বার এলে দেখবি এবারের ছেলেটাও নাই।’