হারুন-আর-রশিদ: বন বিভাগের তথ্যমতে, গত ৩৯ বছরে সুন্দরবনে ৭৫টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করা হয়েছে। এভাবে কমতে কমতে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯৮টিতে নেমে এসেছে। ৪৪০ বাঘ থেকে ১৫ বছরে নেমে এখন আছে মাত্র ৯৮টি। খাদ্য সঙ্কট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষও সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য সূত্র (বণিক বার্তা, ২৯ জুলাই ২০১৮)
সুন্দরবনের চার পাশে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন।
ডাঙ্গায় বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর জলে কুমিরের রাজত্ব। এখনো পর্যটকদের কাছে মনোমুগ্ধকর স্থান, যার নাম সুন্দরবন। জানা-অজানা বেশ কিছু সড়কপথ, জলপথ রয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ঘোরার। অবকাশকালে ঘোরার জন্য সুন্দরবনের চেয়ে সুযোগ্য এলাকা বিশ্বে খুবই বিরল। সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত নয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিধায় বন বিভাগের অনুমতি নেয়া আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া সুন্দরবনে ঢোকা দণ্ডনীয় বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও শাসক দলের ছত্রছায়ায় একশ্রেণীর মানুষ অবাধে প্রবেশ করে অবাধে গাছ কেটে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সব উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল ধ্বংস করছে। সুন্দরবনের চার পাশে বহু ঘরবাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। পাশাপাশি শিল্প ও কলকারখানা গড়ে তুলছে একশ্রেণীর মানুষ। প্রশাসনের সহায়তায় এসব কাজ হচ্ছে বলে স্থানীয় নিরীহ মানুষগুলো বলছে। আজ ধ্বংসের মুখে জাতীয় গর্ব ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট! সমুদ্রমুখী সীমানায় এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিস্তৃত। যার বর্তমান আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের আয়তন ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের সীমানায়। বাকি ৩৯৮৩ বর্গকিলোমিটার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবনে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর ও ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ত ছোট ছোট দ্বীপ। মোট বনভূমির ৩১ দশমিক এক শতাংশ অর্থাৎ, ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে নদী-নালা, খাড়ি, বিল মিলিয়ে জলের এলাকা। বনভূমি স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পশু-পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবনের এক দিকে অথৈ জলরাশি, অপর দিকে নির্মল সবুজে ঘেরা। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
কিন্তু ১৯১১ সালে এই সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখ লাখ লোকের জীবিকার উৎস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিগত সিডর, আইলা, ফণী, নার্গিসে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুন্দরবন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রকৃতির শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। এটাই সুন্দরবনের স্বাভাবিক নিয়ম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীববৈচিত্র্যের এই সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র হোটেল, মোটেল, ইকোপার্ক। এ জন্য প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগকে সহায়তা করা, পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ আরো ব্যাপকভাবে জোরদার করা। এসব কাজ বহু আগে থেকেই শুরু করার দরকার ছিল। জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সুন্দরবন উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখছি, দেশের উন্নয়নের কথা বলে সুন্দরবনকে ধ্বংসের ব্যাপক কর্মসূচি শাসক দল হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের মাত্র ৯ কিলোমিটার অদূরে নির্মিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ও রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেয়ার একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
আইন ভেঙে সংবিধান ভেঙে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মাত্র ১৫ ভাগ অর্থ বিনিয়োগ করে ভারত মালিকানা পাবে ৫০ ভাগ। এতে ধ্বংস হবে এ দেশের গর্ব সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি। উন্নয়নের নামে বনের ভেতরে তৈরি হয়েছে সাইলো গুদাম। শুধু তাই নয়- এ দেশের নামীদামি কোম্পানি এবং জাতীয় রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি সুন্দরবনের আশপাশে জমি ক্রয় করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন।
আমরা মনে করি, কোনো ধরনের কৌশলগত সমীক্ষা ছাড়াই সুন্দরবনের সন্নিকটে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সরকারি উদ্যোগে বৈশ্বিক ও স্থানীয় উদ্বেগ এবং পরামর্শ উপেক্ষা করায় আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আসন্ন আজারবাইজানের বাকু মিটিংয়ের আগেই অবিলম্বে রামপাল, তালতলি ও কলাপাড়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সব কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে আশু পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। উল্লেখ্য, আজারবাইজানের বাকুতে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম অধিবেশনের জন্য প্রস্তাবিত অ্যাজেন্ডায় সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার আগেই সুন্দরবনের আশপাশের সংরক্ষিত অঞ্চলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ চলমান সব প্রকল্প স্থগিত করে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষাসহ অন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। এদিকে, তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা বলেছেন, (সূত্র : জাতীয় দৈনিক ১৮ জুন ২০১৯) রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ীর এসব প্রকল্পকে আমরা উন্নয়ন নয় বলি ধ্বংস প্রকল্প। বিশ্ব দরবারে মিথ্যাচার করে আরো তিন শতাধিক বিপজ্জনক প্রকল্প সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বর্তমান সরকার। ওই সংস্থার নেতারা বলেছেন, উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জনগণের অর্থ বরাদ্দ দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এর পাশাপাশি আগামী ২২ জুন রামপাল রূপপুরসহ প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী সব প্রকল্প বন্ধ করে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ সফলের আহ্বান জানান তারা।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, সরকার উন্নয়নের নামে এমন বহু প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য শুধু আর্থিক বোঝাই সৃষ্টি করবে না, বরং প্রাণ প্রকৃতি বিনাশ করে দেশ ও জননিরাপত্তাকে বিপর্যস্তও করবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরকার উন্নয়নের কথা বলে এখনো সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প অব্যাহত রেখেছে। রামপাল প্রকল্প নিয়ে সরকার জনগণের কাছে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, ইউনেস্কোকে দেয়া বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে হেয় করেছে। সুন্দরবন বিভাগের তথ্য মোতাবেক, সুন্দরবনের গহিন অরণ্য ১৪ বছরে ২০ বার আগুনে পুড়েছে। ২০০২ সালের ২২ মার্চ আগুন লেগে ১৫ দিন ধরে আগুনে পুড়েছিল। ওই একটিমাত্র অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ছয় একর বনভূমি। কোটি কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়। ১৯৫৯ সালে হেক্টরপ্রতি সুন্দরী গাছ ছিল ২১১টি, কমতে কমতে ২০২০ সালে তা ৮০তে নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন (সার্ভিসেস সিইজিআইএস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সুন্দরবনের ভূমি ও উদ্ভিদের পরিবর্তনের ধরন নিয়ে করা দুটি গবেষণায় যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তাতে দেখা যায়- সুন্দরবন ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের সুন্দরবনেই ভূখণ্ড কমেছে আর জলাভূমি বাড়ছে। সেই সাথে সুন্দরবনে সুন্দরীসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যাও কমেছে। সুন্দরবনের আয়তন নিয়ে যা বলা হয়, বাস্তবে তার চেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশ সুন্দরবন অংশের মোট আয়তন ৫২ হাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটার, আর ভারতীয় অংশের আয়তন তিন হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন রক্ষা করতে চাইলে সব ঝুঁকি আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি ২০১৪ সালে এপ্রিলে ভারত সফরে যাই এবং ২৭ দিন দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কফি হাউজের সামনে সুন্দরবন রক্ষার্থে যে সমাবেশ করেছিল, সেই সভায় আমিও বক্তব্য রেখেছি। দীর্ঘ বছর ধরে তারাও সংগ্রাম করেছে সুন্দরবন রক্ষার্থে। আমাদেরও সেই একই পথ অবলম্বন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।