বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে উচ্চশিক্ষা দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম করা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে পৃথিবীর নানা দেশে নানা সভ্যতায় গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন হতে পারে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কী? মরক্কোর ফেস নামক স্থানে ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আল কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি?
আবাসিক বিশ্ববিদ্যায় মানে হলো যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়াসহ সেখানেই অবস্থান করে জ্ঞান অর্জন করা যায়। ঐতিহাসিকরা জানান, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় হলো পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতের বিহারে গড়ে ওঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পাটনা থেকে ৮৮ কিমি দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত।
নালন্দা সংস্কৃত শব্দ। ‘নালাম’ শব্দের অর্থ ‘পদ্ম’ অর্থ্যাৎ জ্ঞানের প্রতীক এবং ‘দাঁ’ শব্দের অর্থ ‘দেওয়া’। সে হিসেবে ‘নালন্দা’ শব্দের অর্থ হয় ‘জ্ঞান দেওয়া’। আবার ধারণা করা হয়, ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সাপ ‘নাগা’ থেকেও নালন্দা শব্দের আবির্ভাব হতে পারে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গড়ে তোলা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টিয় শতাব্দীর মধ্যে তৈরি করা হয় এবং ১১৯৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার সঠিক সময় নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে মৌর্য সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে নালন্দাতে প্রথম বৌদ্ধ উপাসনালয় গড়ে তোলেন যা পরে বৌদ্ধ গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই একমত যে রাজা কুমারগুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা মগধে ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয় এতই জনপ্রিয় ছিল যে এখানে বিদ্যা অর্জন করতে তখনকার চীন, তিব্বত, গ্রিস, কোরিয়া, তুরস্ক ও পার্সিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা আসতো। নালন্দা মূলত বৌদ্ধধর্মের চর্চা ও গবেষণার জন্য তৈরি হলেও সেখানে ধনুর্বিদ্যা, রাজ্যশাসনবিদ্যা, সমরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, হিন্দুদর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনেক বিষয় পড়ানো হতো। নালন্দাতে ৬৮টি বিষয় পড়ানো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার নূন্যতম বয়স ছিল ১৬। নালন্দাতে বিখ্যাত শিক্ষকের মধ্যে জীবক, পাণিনি, কুটিলা, বিষ্ণু শর্মা ছিলেন অন্যতম।
কিন্তু এ জ্ঞানপীঠকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। একবার নয়, তিনবার। বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পড়ে নালন্দা। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)। মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানরা নালন্দা আক্রমণ করে। তারা বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরের বংশধররা নালন্দাকে পুণর্গঠন করেছিলেন।
প্রায় দেড় শতাব্দী পর আবার নালন্দা ধ্বংসের মুখে পড়ে। এবার আক্রমণ করেন বাংলার শাসক শশাঙ্ক। মুর্শিদাবাদের শাসক শশাঙ্ক রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন। ফলে রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে ঢুকেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করেন। বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে খণ্ডবিখণ্ড করেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বর্ণনায় শশাঙ্কের আক্রমণ ও নালন্দা ধ্বংসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয়বারের মতো ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। বখতিয়ার খিলজির বিহার অভিযানের ইতিহাস শুধু ঐতিহাসিক মিনহাজের ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ বইতেই লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তবে নালন্দাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি, বড় একটি অংশকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মূলত পনেরশ শতকের দিকে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকোষাধার। শেষবার যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তখন এর গ্রন্থাগারে যত বই সংরক্ষিত ছিলো তা প্রায় তিন মাস ধরে পুড়েছিল।
চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সহায়তায় মাটিতে চাপা পড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্ধারের কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। নালন্দাকে উদ্ধারের পর এর ব্যাপ্তি, ভবনগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। ভবনগুলোর কক্ষ ও সুযোগ-সুবিধা বিচার করে দেখা যায়, প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠে ১০ হাজার শিক্ষার্থী ও ২ হাজার শিক্ষকের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিলো।
স্থাপত্যশৈলীতেও এটি একটি অনবদ্য নিদর্শন। উঁচু ও পুরু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল নালন্দা যা তার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার বিষয়টি গর্ব করে জানান দেয়। মূল ভবনে মোট আলাদাভাবে ৮টি কম্পাউন্ড ও ১০টি মন্দির ছিল। সঙ্গে ছিল ধ্যানকক্ষ ও অনেক পাঠদান কক্ষ। প্রতিটি ভবনের সামনে ছিল জলাধার ও চিত্তাকর্ষক উদ্যান।
বৌদ্ধ শাসনামলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছিল। সম্রাট হর্ষবর্দ্ধনের শাসনকালে আশপাশের গ্রামসহ মোট ২০০টি গ্রাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। প্রায় ১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে গড়ে ওঠা লাল ইটের ভবনের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আজও সে সময়ের উচ্চতর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস জানান দিচ্ছে।
৮০০ বছর পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও চালু করা হয়েছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পুণরায় এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
তথ্য সূত্র:
১. দ্য ইউনিভার্সিটি ইন রুইন্স, বিল রিডিংস, হাভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৬
২. দ্য ফার্স্ট ইউনিভার্সিটিস, ওলাফ পেডারসেন, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৮
৩. সি-য়ু-কি: পশ্চিম বিশ্বের বৌদ্ধ নথি, হিউয়েন সাং, ১৯০৬
৪. উইকিপিডিয়া