আফ্রিকার খুব পরিচিত প্রাণীগুলোর মধ্যে জিরাফ অন্যতম। নামটি শুনলেই আমাদের মনের অজান্তে ফুটে উঠে একটি লম্বা প্রাণীর ছবি। এদেরকে এককথায় বলা যায়, আফ্রিকার জঙ্গলের টাওয়ার। চলুন দেখে নেই স্থলভাগের সবচেয়ে লম্বা প্রানী এই জিরাফ সম্পর্কে জানা অজানা বিভিন্ন তথ্য।
জিরাফের আকার ও আকৃতি: জিরাফ বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা প্রাণী। একটি পুরুষ জিরাফ লম্বায় প্রায় ১৮ ফুট হয় এবং স্ত্রী জিরাফ লম্বায় হয় প্রায় ১৪ ফুট। স্ত্রী জিরাফের ওজনে হয় ১,৫০০ পাউন্ড (৬৮০ কেজি) এবং পুরুষ জিরাফের ওজন হয় ৩,০০০ পাউন্ড (১,৩৬০ কেজি) পর্যন্ত। এদের গলা লম্বায় প্রায় ৬ ফুট হয় যা ওজনে ৬০০ পাউন্ড। আর পায়ের দৈর্ঘ্যও প্রায় ৬ ফুট।
এই অতিকায় শরীর হওয়ার কারনে জিরাফের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও অনেকটা বড়। এদের জিহ্বা লম্বায় ২১ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়ে এবং পায়ের পাতা ১২ ইঞ্চি। এদের হৃৎপিন্ড ওজনে ২৫ পাউন্ড (১২ কেজি) পর্যন্ত হয় এবং প্রায় ৫৫ লিটার বায়ু ধারন করতে পারে (মানুষেরা ৬ লিটার) – San Diego Zoo। অনেক জিরাফের মাথায় দুইটি বা চারটি ভোঁতা শিং থাকে। এদের গায়ে আঁকাবাঁকা দাগ থাকে। তবে দুটি জিরাফের গায়ের দাগ কখনোই একরকম হয় না।
জিরাফের আবাস্থল: জিরাফরা সাধারণত বাস করে আফ্রিকার তৃণভূমিময় সাভানা অঞ্চলে। এরা অর্ধ-শুষ্ক এবং খোলা ভূমি পছন্দ করে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় বড় গাছ এবং বিভিন্ন ঝোপ ঝাড়। আর ঠিক এই কারনেই সাভানা এদের জন্য উপযুক্ত স্থান। বনের বিশেষ বিশেষ জায়গায় এদেরকে দলবেঁধে চলাফেরা করতে দেখা যায়।
জিরাফের স্বভাব: জিরাফেরা এতটাই সামাজিক প্রাণী যে, এদের নিজস্ব কোন এলাকা থাকে না। এরা মূলত নীরিহ স্বভাবের প্রাণী। তবে আক্রান্ত হলে যুদ্ধংদেহী রূপ ধারণ করে। জিরাফ মূলত সিংহ, বন্য কুকুর ও হায়েনা দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রতি বছর সিংহের আক্রমণে বেশ কিছু জিরাফ মারা যায়। তবে একটি পূর্ণবয়স্ক জিরাফকে সিংহ খুব সহজে আক্রমণ করতে চায় না, কারণ জিরাফের লাথির আঘাতে সিংহ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে অহরহ। তাই শিশু ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল জিরাফরাই সিংহের শিকারে পরিণত হয়। আক্রমণের ভয়ে জিরাফ কখনো বসে ঘুমায় না বা বিশ্রাম নেয় না। কারণ জিরাফের বসতে যেমন সময় লাগে প্রচুর, তেমনি বসা থেকে দাঁড়াতেও অনেক সময় নেয়। তবে দলগতভাবে থাকা অবস্থায় কিছু কিছু জিরাফ মাঝে মাঝে বসে বিশ্রাম নেয়। এরা খুব নিচু আওয়াজে এরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সাধারণত এরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে না। তবে খেলাধুলা করার সময় কিংবা খুব বেশি রাগান্বিত হলে পুরুষ জিরাফরা মাঝেমধ্যে এক অন্যের সাথে লড়াই করে।
জিরাফের খাদ্যাভ্যাস: জিরাফরা তৃণভোজী প্রাণী। এদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে গাছের পাতা। বিশেষ করে মিমোসা এবং অ্যাকাশিয়া গাছের পাতা, বীজ, ফল, কুঁড়ি এবং শাখা এদের খুব প্রিয়। যদিও এই গাছ বেশ উঁচু হয়, কিন্তু লম্বা গলা এবং জিহ্বার কারনে জিরাফ খুব সহজেই এই গাছের পাতা খেতে পারে। যে কারণে যেসব এলাকায় মিমোসা এবং অ্যাকাশিয়া গাছ বেশি দেখা যায়, সেখানে জিরাফের দেখা মেলে বেশি বেশি। একটি জিরাফ সপ্তাহে ১০০ পাউন্ড পর্যন্ত পাতা খেয়ে থাকে – San Diego Zoo।
খুব বেশি খেলেও জিরাফের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা উটের মতো পানি না খেয়ে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে একটানা এক সপ্তাহ পানি না খেলেও এদের কোনো সমস্যা হয় না। গাছের পাতায় যে পানি থাকে, তাতেই তাদের পানির চাহিদা মিটে যায়।
আরো পড়ুন: মেগালোডন পরিচিতি: মেগালোডন সম্পর্কে জানা অজানা বিভিন্ন তথ্য
জিরাফের প্রজনন: মিলনের পর, স্ত্রী জিরাফ প্রায় ১৪ মাস ধরে গর্ভাবস্থার থাকে। মা জিরাফ দাড়িয়ে প্রসব হওয়ার কারনে, জন্মের সময় বাচ্চা জিরাফটি বেশ খানিকটা উপর থেকে মাটিতে পড়ে যায়। এই পতন ৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে – National Geographic। জিরাফ বাচ্চাদেরকে বাছুর বলা হয়।
জিরাফের প্রজনন: জন্মলগ্নেই এরা প্রায় ৬ ফুট লম্বা হয় এবং ওজনে হয় ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড (৪৫ থেকে ৬৮ কেজি) – San Diego Zoo। জন্মের মাত্র এক ঘন্টা পরেই, এরা দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারে। এরা ১ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খায় এবং ৩ থেকে ৬ বছরের মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক হয়ে যায় – University of Michigan। বন্য পরিবেশে এরা ১০ থেকে ১৫ বছর বাঁচে। আর বন্দীদশায় বাঁচে ২০ বছর পর্যন্ত।
বিলুপ্তির তালিকায় জিরাফ: সুন্দর এই প্রাণীটিও বিলুপ্তির লিস্টে উঠে গেছে। ৩০ বছর আগে যেখানে ১৫০,০০০ টি জিরাফ ছিল সেখানে বর্তমানে জিরাফের সংখ্যা মাত্র ১০০,০০। চোরাশিকার এবং আবাসনের ক্ষতিই কারনেই জিরাফেরা আজকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। কথিত আছে, জিরাফের লেজ দিয়ে তৈরি ব্রেসলেট সৌভাগ্যের প্রতীক এবং লেজের পশম জপমালার সুতা হিসেবেও ব্যবহার করা হয় – African Wildlife Foundation। এছাড়া কৃষি জমির প্রসারনের কারনে জিরাফের খাদ্যের উৎসও কমে গেছে। আশাকরি, যথাযথ পদেক্ষেপ গ্রহণের ফলে সুন্দর এই প্রাণীটি বিলুপ্তির তালিকা থেকে নিজের নামে কাটতে পারবে।