ইমরান হোসাইন ইমু: হিমালয় পর্বতমালার পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট ও কে-টু র পরের অবস্থানে রয়েছে অনুপম সৌন্দর্যের গিরিবধূ কাঞ্চনজঙ্ঘা। এটি পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, যার উচ্চতা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট। ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার রয়েছে চমকপ্রদ এক ইতিহাস! কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য এবং টাইগার হিলের চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য প্রতিবছর হাজারো পর্যটক ভিড় করেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব সৌন্দর্য তেঁতুলিয়ায় বসে দেখা যায় অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্ট দেখা যায় বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। রাতে দেখা যায় শিলিগুড়ির উজ্জ্বল আলো। পাহাড়েরই অপর ঢালে স্বপ্নপুরী দার্জিলিং। বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর দিনের প্রথম সূর্যোদয়ের সূর্যকিরণের ঝিকিমিকি দৃশ্য সত্যিই মুগ্ধতার মোহ ছড়ায়।
অনুপম সৌন্দর্যের কাঞ্চনজঙ্ঘা: কাঞ্চনজঙ্ঘা শব্দটি শুনে তৎসম কাঞ্চন জঙ্ঘা মনে হলেও আসলে নামটি সম্ভবতঃ স্থানীয় শব্দ ‘কাং চেং জেং গা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ তেনজিং নোরগে তার বই, ম্যান অফ এভারেস্ট (Man of Everest)-এ লিখেছেন ‘ তুষারের পাঁচ ঐশ্বৰ্য’। এটির পাঁচ চূড়া আছে। তাদের চারটির উচ্চতা ৮, ৪৫০ মিটারের ওপরে। এ ঐশ্বৰ্য ঈশ্বরের পাঁচ ভান্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে, এগুলো হলো- স্বর্ণ, রূপা, রত্ন, শস্য, এবং পবিত্র পুস্তক।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পাশাপাশি নীলফামারীর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও খালি চোখেই হিমালয় পর্বতের কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া দেখা যায়। হিমালয়ের দ্বিতীয় ও বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গের মোহনীয় সে দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। তাই জেলা দু’টি ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন সীমান্তবর্তী খোলা উঁচু স্থানগুলোতে।
দর্শনার্থীরা জানিয়েছেন, আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে তেঁতুলিয়ায় যেতে হতো। গত কয়েক বছরে ভালোভাবে দেখাও মিলছিলো না। কিন্তু এখন নীলফামারীর চিলাহাটি, ডিমলার ঝুনাগাছ চাপানী ও নীলফামারী সদরের ইটাখোলার ফাঁকা স্থানে দাঁড়ালেই কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফশুভ্র গায়ে সূর্যকিরণে চকচকে উজ্জ্বল পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার একাধিক রূপ দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখার জন্য দুরবিন বা বাইনোকুলার সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে না। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ সৌন্দর্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়, সর্বোত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়ার শহরের উপকন্ঠে মহানন্দার তীর ঘেঁষা সরকারী ডাকবাংলো চত্ত্বর থেকে। এমনকি দার্জিলিংয়ের সবুজে ঘেরা পাহাড় শ্রেণিরও স্পষ্ট দেখা মেলে। রাত হলে পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা শহরের আলোও ঠিকরে আসে।
যিনি কখনওই চর্মচক্ষে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেননি, তার জন্য প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখাটা যেন অনেকটা জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ার মত। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি! সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও চোখ ক্লান্ত হয় না। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলে দর্শকের চোখ জুড়িয়ে রাখে বহুরূপী কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঊষালগ্নে মনে হয় যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার শাদা বরফ কাঁচা সোনায় ছেয়ে গেছে। বেলা বাড়লে কাঁচা সোনা শরতের মেঘের বসন নেয়। দিনের মধ্যভাগে মনে হয় যেন এক খন্ড প্রকান্ড মেঘ উত্তরের আকাশটা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিনে কোন নড়চড় নেই। বিকেলে যেন বরফ লজ্জায় রাঙ্গা হতে শুরু করে। আর গোধূলি বেলায় পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা আবীরখেলায় মেতে ওঠে চপল কিশোরীর মত।
রাতেও দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। জোছনা রাতে যখন চারদিক উদ্ভাসিত হয়, তখন শাদা বরফ থেকে চাঁদের মৃদু আলো প্রতিফলিত হয় বরফ থেকে দর্শনার্থীর হৃদয় পর্যন্ত। জোছনারাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র বরফে প্রতিফলিত রূপালি চাঁদের আলোর স্বর্গীয় শোভা দেখে হয়ত এখনকার সৌন্দর্য পিপাসীরা পাগলই হয়ে যাবেন!
তিনদিকে ভারতের ভূমিতে ঘেরা পঞ্চগড় জেলা কেবল কাঞ্চনজঙ্ঘার জন্যই বিখ্যাত নয়, স্বল্পখ্যাত এই জেলায় দেখবার আরও অনেক কিছুই আছে। দেশের একমাত্র রক্স মিউজিয়াম, ভিতরগড় দূর্গনগরী, মহারাজার দিঘী, চা বাগান, বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর, ডাকবাংলো, কাজলদিঘী, বার আউলিয়ার মাজার, শাহী মসজিদ, বোদেশ্বরী মন্দির, ঠাকুরবাড়ি ইত্যাদি।