করিম চৌধুরী
হ্যালো! উই আর নট অ্যাভেইলেবল নাও। প্লিজ, লিভ ইউর নেম অ্যান্ড ফোন নাম্বার আফটার দ্য বিপ। উই উইল কল ইউ ব্যাক। থ্যাংক ইউ।
আমেরিকায় সব বাসার ল্যান্ড ফোনে এ মেসেজটি সেট করা থাকে। বাসায় ফিরে ফোনের দিকে তাঁকালেই দেখা যায়, ফোন সেটে লালবাতি জ্বলে আছে। অর্থাৎ কেউ কল করে মেসেজ রেখেছেন। একাধিক মেসেজও থাকতে পারে।
ফোন সেটের লিসেন বাটন টিপলেই একে একে সব ভয়েস মেসেজ শোনা যায়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কল ব্যাক করা যায়।
আমেরিকায় মোবাইল ফোনকে সেলুলার বা সেল ফোন বলে। সেল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা আমেরিকায় কম। আমি যে সময়ের কথা লিখছি সে সময় সেল ফোনের ব্যবহার খুব সীমিত ছিলো। দোকানপাট, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, সুপারস্টোর, গ্যাস স্টেশন, বাসা-বাড়ি সব ক্ষেত্রে ল্যান্ড ফোন আছে।
রাস্তার পাশে একটু দূরে দূরে পে ফোন বুথ। আমেরিকায় বেশির ভাগ অফিসে ফোন করতে টাকাও লাগে না। প্রথমে ১৮০০ প্রেস করে কম্পানির নাম্বার টিপলেই কথা বলা যায়। কোনো পয়সা খরচ হয় না। এটাকে বলে টোল ফৃ নাম্বার। কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতেই কম্পানিগুলো এ সুবিধা দেয়।
আমেরিকায় ল্যান্ড ফোন ব্যবস্থা আমাদের দেশের ছয়টি মোবাইল ফোন অপারেটরের চেয়েও শক্তিশালী। কাউকে ফোন করে লাইন পাওয়া যাবে না, এটা অবিশ্বাস্য। লাইন কখনো এনগেজডও থাকে না। সব ল্যান্ড ফোনে দুই থেকে চারটি লাইন আছে। কারো সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কেউ কল করলে প্রথম কলারকে হোল্ড ( Hold) রেখে দ্বিতীয় কল রিসিভ করে কথা শেষ করে ফের হোল্ড চেপে প্রথমজনের সঙ্গে কথা বলা যায়।
যথেষ্ট ধনী, কম্পানির সিইও, প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিসহ বিশেষ উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিরা সেল ফোন ব্যবহার করেন। দু-একজন যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়।
আমি যে দেশে বেশি সময় থাকতাম, সে দেশে কিছু আপা ও ভাবি বানাতাম। এতে সুবিধা ছিল। রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। বিদেশে বেশির ভাগ বাংলাদেশি মেস করে থাকেন। একেক দিন একেকজনের রান্নার দায়িত্ব । আমি অল্প কয়েক দিন মেস লাইফ লিড করেছিলাম। কিন্তু অ্যাডজাস্ট করতে পারলাম না। রান্না নিয়ে অনেক ঝামেলা হতো। তাই একাই থাকতাম।
জুলাই মাসের চার তারিখে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। কয়েকদিন আগে থেকেই চারদিকে সাজ সাজ রব। ইস্ট রিভারে ফায়ার ওয়ার্কস দেখার জন্য সবার আগ্রহের শেষ নেই ।
প্রচন্ড গরম পড়েছিলো সেদিন। ইওরোপ-আমেরিকার তীব্র শীতের কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ওই সব শীতপ্রধান দেশে যে এত গরম, তা ওইসব দেশে না গিয়ে বা গল্প-উপন্যাস না পড়ে অনুমান করা অসম্ভব।
কোকের সঙ্গে বরফ আর লেবু মিশিয়ে খেতে খেতে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম। ক্লাসিফায়েড বিভাগে পেয়িং গেস্ট শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপনে আমার চোখ আটকে গেল। বিজ্ঞাপনের ভাষাটি বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল।
“নির্ঝঞ্ঝাট ছোট পরিবারের সঙ্গে কুইন্সের উড সাইডে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে শেয়ার করতে ইচ্ছুক শান্তিপ্রিয়, রোমান্টিক ও শিক্ষিত দম্পতিকে একটি রুম ভাড়া দেয়া হবে। কর্মজীবী সিঙ্গল মহিলা কিংবা ছাত্রী হলেও আপত্তি নেই। কোনো অবস্থায়ই ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া হবে না।”
নিচে ফোন নাম্বার।
নিউ ইয়র্কের পাঁচটি বরো। কুইন্স, ব্রুনক্স, ব্রুকলিন, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড এবং ম্যানহাটান। ম্যানহাটান নিউ ইয়র্কের মূল সিটি। যাকে বলা হয় নিউ ইয়র্ক সিটি।
টাইমস স্কয়ার, ইউএন বিল্ডিং, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ক্রাইসলার বিল্ডিং, বড় বড় পত্রিকা আর টিভির হেড কোয়ার্টার, বিভিন্ন দূতাবাসের কনসুলেট অফিস,বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রধান অফিস, বেলভিউ হসপিটাল, পাবলিক লাইব্রেরি, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, ওয়াল স্টৃট সব কিছুই ম্যানহাটানে অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক সিটিতে। এ সিটিকে তাই বলা হয় ক্যাপিটাল অফ দি ওয়ার্ল্ড। নিউ ইয়র্ক সিটির পশ্চিম দিকে হাডসন নদী এবং পূর্ব দিকে ইস্ট রিভার বা পূর্ব নদী। নিউ ইয়র্ক সিটির পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গেছে বলেই এ নদীর নাম ইস্ট রিভার। ইস্ট রিভারের এপারে ম্যানহাটান, ওপারে লং আইল্যান্ড সিটি।
কত রাতে জাতিসংঘ ভবনের সামনের সিড়িতে বসে ইস্ট রিভারের পানি ছুয়েছিলাম, পা ধুয়েছিলাম। বেলভিউ হসপিটালের সামনের সিড়িতে কত বিকেল কাটিয়েছিলাম পানিতে ভাসমান প্লেন দেখতে। ছোট প্লেনগুলো ইস্ট রিভারের পানিতে ল্যান্ড করে। আবার পানি থেকে উড়ে নিউ ইয়র্ক সিটির অ্যারিয়াল ভিউ (Aerial View) অর্থাৎ ওপর থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি বা ম্যানহাটান দেখা) দেখে আবার ইস্ট রিভারের পানিতে ল্যান্ড করে।
বিজ্ঞাপনটি বার কয়েক পড়ে মনে হলো একজন আপা বা ভাবি পাওয়া যেতে পারে। ফোনটা টেনে নিয়ে কোলের ওপর রেখে নাম্বার টিপতেই ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠে ভেসে এলো,
-হ্যালো, গুড আফটারনুন।
আমি উৎফুল্ল ভাবে বললাম,
– গুড আফটারনুন। ডু ইউ স্পিক বাংলা?
-ইয়েস, আই ডু।
-আসসালামু আলাইকুম। পত্রিকায় প্রকাশিত একটা বিজ্ঞাপন দেখে আমি ফোন করেছি। আমি কি অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম?
-না, না, তা কেন? বিজ্ঞাপন যখন দিয়েছি তখন ফোন করতেই পারেন। এনিওয়ে, আপনারা কি আমাদের বাসায় আসতে চান?
-আপনারা মানে?
-মানে আপনি, আপনার স্ত্রী…
সরি, আমি সিঙ্গল।
-ও, আপনি ব্যাচেলর?
-জি।
-সরি, আমরা তো বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছি ব্যাচেলরদের…
-জ্বি, তা জেনেই আমি ফোন করেছি।
-কি ব্যাপার, বলুন তো!
-একজন বাড়ির মালিক হিসেবে আপনার মতে ব্যাচেলরদের ভাড়া না দেয়ার প্রধান কারণটা কি? কাইন্ডলি যদি বলতেন তো খুশি হতাম।
-আসলে সিদ্ধান্তটি আমার কর্তার।
-তাই নাকি? বাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত যদি আপনার স্বামীর একক সিদ্ধান্ত হয় তাহলে বড় বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তিনি হিটলার-মুসোলিনির বড় ভাই।
-শুনেছি কিছু মানুষ অন্যের ব্যাপারে নাক গলায়। আপনি দেখছি পুরো শরীরটাই গলিয়ে দিচ্ছেন।
-এরপরও তো আপনারা ভাড়া দিচ্ছেন না ভাই।
-আসলে হয়েছে কি জানেন, ব্যাচেলর ছেলেদের দায়িত্বজ্ঞান একটু কম। সময় মতো বাসায় ফেরে না। হাই ভলিউমে গান শুনতে চায়। অনেকের গার্ল ফ্রেন্ড থাকে। কেউ কেউ ডৃংক করেন। তা ছাড়া নিউ ইয়র্কে ফ্যামিলি বাসায় ব্যাচেলর ভাড়া থাকার কারণে অনেক সংসার ভেঙে গেছে। কিছু সংসারে আছে ধূমায়িত অসন্তোষ। ব্যাচেলর ভাড়াটিয়ার সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর পরকীয়ার কাহিনী তো প্রায়ই কমিউনিটির পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন?
-তা দেখেছি বটে। তো, আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে আপনার কর্তা মহাশয় আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। আর আপনি কর্তাকে খুব বিশ্বাস করেন।
-তার মানে?
-আপা, তার মানে এই যে, আপনার বাসায় কোনো ব্যাচেলর ছেলে থাকলে তার সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর পরকীয়ার সম্ভাবনা আছে। অথচ একই বাসায় কোনো ছাত্রী বা মহিলা থাকলে গৃহকর্তার সঙ্গে পরকীয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনার কথা এবং বিজ্ঞাপনের অর্থ কিন্তু তাই বোঝায়।
-এক্সকিউজ মি, আমার একটা কল আসছে। আপনার ফোন নাম্বারটা দিন। আমি আপনাকে কল ব্যাক করবো।
যদিও আমেরিকার সব ফোনেই নাম্বার ওঠে। তবু তিনি আমার নাম্বার চাইলেন।
নাম্বার বলার পর তিনি আমার নাম জানতে চাইলেন। মহা ফ্যাসাদে পড়লাম। আমেরিকায় যে কাউকে হ্যারাস করলে কঠোর শাস্তির বিধান আছে। তাৎক্ষণিকভাবেই চালাকি করে বললাম, আকাশ।
অপ্রত্যাশিত কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই অন্য নাম বলা।
পরদিন সন্ধ্যায় তিনি ফোন করলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম শিরিন। কুশলাদি জানতে চাইলেন। আমার ব্যাপারে ওনার কর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে তাও জানালেন আনন্দের সঙ্গে।
এরপর থেকে প্রতিদিন আমরা ফোনে কথা বলতাম। তিনি আমাকে আকাশভাই বলে ডাকতেন। আমি ডাকতাম শিরিন আপা। ফোনে কখনো আমাকে না পেলে পরেরবার ধমক দিয়ে বলতেন, রাত দুপুরে কোথায় থাকেন আকাশ ভাই? ফোন করে পাওয়া যায় না। উচ্ছৃঙ্খলতা করলে কিন্তু বোনের কাছে জায়গা নেই।
বয়সে শিরিন আপা আমার সমবয়সী ছিলেন বলে অল্প দিনেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিলো। কয়েকমাস পরে থ্যাংকসগিভিং ডে-তে তিনি আমাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ম্যানহাটান থেকে সাবওয়ে এফ ট্রেন ধরে পনের মিনিটেই রুজভেল্ট এভিনিউতে পৌঁছা যায়। রুজভেল্ট এভিনিউয়ের একদিকে উড সাইড আর অন্যদিকে বাংলাদেশিদের কোলাহলপূর্ণ এলাকা জ্যাাকসন হাইটস।
ডোর বেল চাপতেই শিরিন আপা দরজা খুলে দিলেন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ স্লিম ফিগারের আকর্ষণীয় আপা আমাকে ভেতরে যাওয়ার আহ্বান জানালেন।
বাসায় তাঁর হাজব্যান্ড ও চৌদ্দ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে শাফিন আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলো।
অনেক গল্প হলো। রাতে একসঙ্গে খাওয়া হলো। এরপর নিউ ইয়র্কের জীবনে আমাকে আর বাংলা খাবারের টেনশন করতে হয়নি।
শিরিন আপার বাড়ি বরিশাল। প্রতিদিনই ফোন করে আপা খাওয়ার জন্য বলতেন। কখনো যেতাম, কখনো যেতাম না। তবে প্রতি রোববার নিয়মিত যাওয়া হতো।
কখনো আমার শার্ট বা প্যান্টের বোতাম খুলে গেলে বা লুজ হলে তাও নিয়ে যেতাম আপার কাছে। আপা যত্ন করে ঠিক করে দিতেন। আপার হাজব্যান্ড আফজাল ভাই আমাদের এই নিটোল সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলেন।
আমি দেশে ফিরে আসবো শুনে শিরিন আপা বলেছিলেন, তুমি যেতে চাও বাধা দেবো না। তবে দেশে গিয়ে তুমি অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। বিশ বছর ইওরোপ-আমেরিকায় থেকে দেশে গিয়ে অথৈ সাগরে পড়বে। সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারো।
কিন্তু আমি চলে এলাম।
নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকায় আমি লিখতাম। শিরিন আপা সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এরও পাঠক ছিলেন। আপা আমাকে বলেছিলেন, তাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে। বলেছিলাম, আমি গল্প লিখতে জানি না আপা।
আপা এখন ওয়াশিংটনে থাকেন। মাঝে মধ্যে ফোন করে আমার খোঁজ নেন। গত বছর দেশে এসে জেমিমা ও তার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। আমি ঢাকা যেতে পারিনি সে সময়। জেমিমার জন্য গিফট এনেছেন আর আমার জন্য টাই। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে আজ ২০১৯। তেইশ বছর বিদ্যমান এই সম্পর্ক! নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এমনি।
হ্যাঁ, শিরিন আপা, আপনার কথাই ঠিক। দেশে এসে আমি অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি। বাট, আই উইশ ইউ গুড লাক। হ্যাভ এ গুড লাইফ ইন দি ইউএসএ।