ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মহামহিম স্রষ্টার কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের নামই হলো ইসলাম। পৃথিবীতে ইসলাম আগমনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মানবসমাজে বিরাজিত অশান্তি, হানাহানি, বিবাদ-বৈষম্য, শক্তির দাপট, আত্মম্ভরিতা আর অমানবিকতার সব আঁধারকে দূরীভূত করে প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতির আবাসভূমি গড়ে তোলাই ছিল ইসলামের মূল লক্ষ্য। মহান আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী- ‘লিয়ুখরিজান্নাসি মিনায্ যোলোমাতি ইলান্নুর।’ অর্থাৎ মানবসমাজকে যাবতীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে সত্য, ন্যায় ও ইনসানিয়াতের আলোকবর্তিকার দিকে পথনির্দেশনা প্রদান ও নিয়ে যাওয়াই ছিল এর অভীস্ট লক্ষ্য। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করা আতঙ্ক, ভয়ভীতি, সন্ত্রাস ও মানবতাবিধ্বংসী যাবতীয় কর্মের মূলোৎপাটনের নিমিত্তে এক বর্ণনাতীত জেহালতের যুগে সভ্যতা ও মানবিকতার পরম সুহৃদরূপে আবির্ভূত হয়েছিল ইসলাম। সমাজের আতঙ্ক দূরীকরণে এসেছিল যেই কালজয়ী ইসলাম, কালক্রমে ইসলামকেই চতুরতার সঙ্গে আতঙ্কজনক করে ফেলা হলো। নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে ও কিছু বিভ্রান্ত বনি আদমের ইসলাম বিকৃতির কারণে কোনো রকম বাছবিচার না করেই ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হলো তথাকথিত মানবদরদিরা- চরম অসহায়ত্বের সঙ্গে সমগ্র বিশ্ববিবেক যার সর্বশেষ জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করল নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে। মহান স্রষ্টার আলোকিত উপাসনালয়ে তাবত পৃথিবীর সব অন্ধকার যেন সেদিন নেমে এসেছিল, ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত এক বিকৃত মস্তিস্কের টারেন্ট নামক টেররের নির্মম বুলেটে নিমিষেই ঝরে গেল অর্ধশত সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মূল্যবান জীবন।
ইসলামোফোবিয়া মানেই হলো ইসলামের প্রতি ভীতি, ইসলামের অনুপম জীবনাদর্শকে ভয় পাওয়া বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলমানদের কাছ থেকে কোনো প্রকার ক্ষতি বা আঘাতের আশঙ্কা করা। মূলত এটি এক বিভ্রান্ত মতবাদ বলেই প্রত্যাখ্যাত। কেননা কাউকে ভয় দেখানো, সমাজে ভীতি ছড়ানো বা মানবসমাজের ক্ষতিসাধন- এর কোনোটাই শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের আদর্শ নয়। কিন্তু তারপরও ইসলাম সম্বন্ধে অবিরাম অপপ্রচারের অপপ্রয়াসে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অমুসলিম নাগরিকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে মানববিধ্বংসী অপতৎপরতার জঘন্য নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠছে। ক্রাইস্টচার্চের চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড তারই সর্বশেষ স্মারক হয়ে আছে। দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইসলামের রক্ষকরাও আজ ইসলাম ও তার বিশ্বজনীন মানবতাবাদী মহত্তম আদর্শ সম্পর্কে অপরাপর সব ধর্মমতের মানুষকে অবহিতকরণে তাদের উদ্যোগ ও কর্মপন্থা যে নিতান্তই অপ্রতুল- সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বিশ্বসভ্যতার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে যেই ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটেছিল, তা তার নিজস্ব অপ্রতিরোধ্য গতিতেই সম্মুখপানে নিরন্তর ছুটে চলবে- তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। বরং কবির ভাষায় যদি বলি- ‘ইসলাম যিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কি বাদ।’ অর্থাৎ প্রতিটা কারবালার পরেই ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করে; নবআঙ্গিকে আরও বিস্তৃত পরিসরে তার সুমহান আদর্শকে তুলে ধরে এবং পরম স্রষ্টার মনোনীত জীবন বিধান হিসেবে তা শ্রেষ্ঠত্বের পানেই ছুটে চলে। বিশ্বের একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে যে পরিসংখ্যান আমাদের হাতে পৌঁছেছে তা হলো- ক্রাইস্টচার্চের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৫০ জন শাহাদতবরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী তারা শাহাদতের মর্যাদা পাবেন এবং প্রতিশ্রুত স্বর্গীয় সব নাজ-নিয়ামতের অধিকারীও হবেন। কিন্তু তার বিপরীতে ইহলোকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি- এ ঘটনায় ৫০ জনের শাহাদতের পর এ যাবৎ সাড়ে তিনশ’ অমুসলিম ইসলাম কবুল করে মুসলমানিত্ব গ্রহণ করেছেন; ইসলাম কবুলের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে দিনের কার্যসূচির শুরুতেই প্রথা ভেঙে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও অলৌকিক সিদ্ধান্তে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়েছে- যার ফলে ইসলাম সম্বন্ধে সাধারণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাঝে আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং বিপুল তাড়না, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মুসলমানদের একান্ত আপন করে নিচ্ছে। শ্বেত-শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত নূরানি চেহারার ইমাম এমন মাহেন্দ্রক্ষণে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন, মন্ত্রিপরিষদ ও অন্যান্য সদস্যের বিপুল উপস্থিতিতে যে তেলাওয়াতটুকু করলেন- ‘য়া আইয়ুহাল্লাযিনা আমানুস্তাইনু বিস্ সাবরি ওয়াস্ সালাত ইন্নাল্লাহা মাআস্ সাবিরিন, ওয়ালা তাকুলু লিমাইয়ুকতালু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াত বাল আহয়াউন ওয়ালা কিল্লা তাশউরুন।’ অর্থাৎ হে বিশ্বাসীরা, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন। আর তাদের তোমরা মৃত বলো না, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে; বরং তারা জীবিত এবং তোমরাই তা উপলব্ধি করতে পারো না। এ তেলাওয়াত ও তার ইংরেজি অনুবাদ শুনে পার্লামেন্টে উপস্থিত সবাই মহান আল্লাহর পবিত্র বাণীর গভীর তাৎপর্য উপলব্ধির প্রয়াস পেয়েছেন। পৃথিবীর নানা দেশে আজ মুসলিমদের নামাজ আদায় ও অন্যান্য ইবাদত পালনের সময় অমুসলিমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মসজিদ ও নামাজিদের পাহারা দিচ্ছেন- এ যেন মানবতারই পরম বিজয়!
আল নূর মসজিদের নিরীহ সেজদারত মুসলমানদের হত্যা করে ইসলামের আলোকবর্তিকা নির্বাপিত করা যায়নি। বরং তা আরও বহুগুণে আলোকোজ্জ্বল হয়ে দুনিয়ার দিজ্ঞ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ছে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘য়ুরিদুনা লিয়ুতফিউ নুরাল্লাহি বিআফওয়া হিহিম ওয়াল্লাহু মুতিম্ মুনুরিহিম ওয়ালাও কারিহাল কাফিরুন।’ অর্থাৎ তারা চায় আল্লাহর নূরকে ফুৎকার দিয়ে নিভিয়ে দিতে। কিন্তু মহান আল্লাহ তার নূরকে অধিকতর ঔজ্জ্বল্য দান করবেন, যদিও অবিশ্বাসীরা তা পছন্দ করবে না। নিউজিল্যান্ড ঘোষিত ইতিহাসের কালো দিনের পাষণ্ড খুনি টারেন্টকে জনৈক চায়নিজ নওমুসলিমের প্রদত্ত পত্রে আমরা দেখতে পাই- ‘টারেন্ট, তোমার প্রশংসা করি, কারণ বিশ্বকে তুমি দেখিয়ে দিয়েছ যে, মসজিদে কোনো তালা নেই, আটকানো দরজা নেই। আমাদের মসজিদ এমনই। কেননা সেখানে সব মানুষকে স্বাগত জানানো হয়। তোমার প্রশংসা করি। কেননা তুমি সব ধর্মমতের মানুষকে একত্র করে মুসলিমদের পাশে দাঁড় করিয়েছ। তুমি অনেক হৃদয় ভেঙেছ, বিশ্বকে কাঁদিয়েছ আর তুমি ব্যর্থ হয়েছ। কিন্তু তুমি আমাদের পরস্পরকে আরও কাছে এনে দিয়েছ, আমাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছ এবং আমাদের মধ্যকার বিভেদের দেয়ালকে ভেঙে দিয়েছ। আগামী সপ্তাহে আরও বেশি মানুষ মসজিদে আসবে, তাদের বিশ্বাসের শক্তি আরও মজবুত হবে এবং তাদের হারানো ভাইবোনদের থেকে তারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে। আগামী সপ্তাহে আরও বেশি অমুসলিম মসজিদের গেটে সতেজ ফুল ও সুন্দর হাতের লেখা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিয়ে হাজির হবে; তারা হয়তো জানতই না যে, এখানে মসজিদ ছিল। কিন্তু এখন জানবে, এর কারণ তুমি। ধ্বংসাত্মক লিপ্সা তোমার হয়তো পূর্ণ হয়েছে; কিন্তু আমাদের মাঝে ঘৃণা, ভয় ও হতাশা জাগাতে তুমি ব্যর্থ হয়েছে; কেননা হীন অপচেষ্টা আর বিভ্রান্ত পরিকল্পনা তোমার অংশ; কিন্তু তা দিয়ে মুসলিম ও অমুসলিমের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিতে তুমি সত্যিই ব্যর্থ হয়েছ।’
২৭ বছরের বিভ্রান্ত টারেন্টের জঘন্য কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিশ্ববিবেক ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মানবতা পথ খুঁজে পেয়েছে; এসবের মধ্য দিয়ে কোরআনে কারিমের সেই ঘোষণারই বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে- ‘ইযা জাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু ওয়া রাআইতান্নাসা য়াদখুলুনা ফি দিনিল্লাহি আফওয়াজা।’ অর্থাৎ যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন তুমি দেখবে, দলে দলে লোকেরা ইসলামের পতাকাতলে একত্র হতে চলেছে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, ‘সম্প্রীতির জন্য হিজাব’ এই ঘোষণা দিয়ে নিউজিল্যান্ডের সব নারী ২২ মার্চ শুক্রবার হিজাব পরিধান করে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও একই সঙ্গে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবে। এসবের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া থেকে উত্তরণ ও সম্প্রীতির বিশ্ব গড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়