স্বপ্নের লন্ডন নগরী
HimalayApr 03, 2019পর্যটন
হিমালয় ডেস্কঃ ব্রিটেনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নান্দনিক নিদর্শন, বিভিন্ন সংগ্রহশালা এবং সর্বোপরি কসমোপলিটান সংস্কৃতি উপভোগ করার সুবিধা। এর ফলে ব্রিটেন ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের কাছে এক আকর্ষণস্থলে পরিণত হয়েছে।
লন্ডন: লন্ডন সবার কাছেই এক স্বপ্নের নগরী। টেমস নদীর তীরে অবস্থিত লন্ডনে কি নেই! লন্ডনের দর্শনীয় স্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য সহ নান্দনিক নিদর্শন এবং সংস্কৃতি উপভোগ করতে চাইলে অরিজিনাল লন্ডন ট্রান্সপোর্ট সাইটসিইং ট্যুর নিলে সুবিধা হয়। এতে করে বিলাসবহুল গাড়িতে করে লন্ডনের প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থান সহ স্থাপত্য নিদর্শনগুলো ঘুরে দেখিয়ে দেবে নীল ব্যাজ পরা টুরিস্ট বোর্ড অনুমোদিত গাইডেরা। ট্যুরের জন্য পরিবহনগুলো ‘পিকাডালি মার্কাস’, ‘ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট’ এবং ‘মার্বেল আর্ট’ থেকে যাত্রা শুরু করে থাকে। শুধুমাত্র বড় দিন ছাড়া বছরের বাকি ৩৬৪ দিন এ ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে।
টেমস নদী: লন্ডনের টেমস নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে জলপথে বেড়াতে হবে। আর এজন্য ‘ওয়েস্ট মিন্সটর’, ‘চাকিং ক্রস’ এবং ‘টাওয়ার অফ লন্ডন’ এই তিনটির যে কোন একটি ঘাট থেকে প্রমোদতরীতে আপনাকে উঠতে হবে। বিশেষ বিশেষ প্রমোদতরীতে মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজ এবং ডিস্কোর ব্যবস্থা রয়েছে।
টাওয়ার অফ লন্ডন: ইংল্যান্ডের রত্নময় ইতিহাসের শিলা সাক্ষী হচ্ছে ‘টাওয়ার অফ লন্ডন’। টাওয়ার অফ লন্ডন মূলত বেশ কয়েকটি টাওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত মধ্য লন্ডনের একটি অন্যতম ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থান। মূল লন্ডন শহরের সামান্য বাইরে টেমস নদীর তীরে এই টাওয়ার অফ লন্ডন অবস্থিত। এখানেই রক্ষিত আছে কোহিনূর।
বাকিংহাম প্যালেস: ইংল্যান্ডের রানীর বাসভবন হচ্ছে ‘বাকিংহাম প্যালেস’। এই প্রসাদের অন্তঃপুরে প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু শুধুমাত্র ‘কুন্ঠনস’ গ্যালারিটি টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
ব্রিটিশ মিউজিয়াম: লন্ডনের গ্রেট রাসেল স্ট্রিটে ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’ অবস্থিত। মিউজিয়ামটি স্থাপিত হয় ১৭৫৩ সালে। পদার্থবিজ্ঞানী স্যার হ্যান্স স্লোয়েনের সংগৃহীত জিনিষপত্রের উপর ভিত্তি করেই এই জাদুঘরটি শুরুতে গড়ে উঠে। স্যার হ্যান্স ৭১ হাজারের বেশি বস্তু সামগ্রী সংগ্রহ করে জাদুঘরটিতে প্রদান করেছিলেন। বর্তমানে এখানে রয়েছে গ্রীক ও মিশরীয় নিদর্শন, মুদ্রিত পুস্তক, ইউরোপীয় হস্তলিপি, প্রাচীন কীর্তি, প্রাচ্য হস্তলিপি, গ্রীক ও রোমান পুরাতন কীর্তি, মুদ্রা ও মেডেল, ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় মধ্যকালের নিদর্শন সমূহ এবং যাবতীয় প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতার এক বিশাল সংগ্রহ। ইংল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের হস্তাক্ষর সংরক্ষিত আছে এখানে। এখানে প্রবেশের জন্য কোন ফী প্রদান করতে হয় না।
ব্রিটিশ লাইব্রেরি: লন্ডনের গ্রেট রাসেল স্ট্রিটে ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ লাইব্রেরি’ অবস্থিত। এখানে রয়েছে গ্রীক, মিশরীয় ও যাবতীয় প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতার এক বিশাল সংগ্রহ। ১৭ কোটি বস্তু নিয়ে এটি বিশ্বের বৃহত্তম লাইব্রেরি এবং সেই সাথে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ বই নিয়ে শুধুমাত্র বই সংগ্রহের দিক দিয়ে এর অবস্থান সাড়া বিশ্বে ২য়। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে বইের সংখ্যা এর চেয়ে বেশী। ব্রিটিশ লাইব্রেরির নিচতলার বিশেষ কক্ষে বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৭২ পর্যন্ত মূল্যবান সব খবরের কাগজ আছে রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ইতিহাসখ্যাত ‘ম্যাগনাকার্টা’। ১২১৫ সালে ল্যাটিনে লেখা এই ডকুমেন্টই ছিল ইংল্যান্ডের কোন রাজার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে রচিত প্রথম দলিল (রাজা জনের বিপক্ষে)। এক অর্থে গণতন্ত্রে উত্তরণের বুনিয়াদ ছিল এই ম্যাগনাকার্টা। প্রথম সার্থক ইংরেজ কবি খ্যাত জিওফ্রে চসার রচিত ক্যান্টর-বেরি টেলসের পাণ্ডুলিপি রয়েছে এখানে। সেই সাথে ১৬২৩ সালে ছাপা শেক্সপিয়ারের প্রথম ফোলিও, জেন অস্টেন, রুড-ইয়ার্ড কিপলিং, শার্লট ব্রন্টি, লুই ক্যারল, চার্লস ডিকেন্স, জর্জ ইলিয়ট, ভার্জিনিয়া উলফ, টমাস হার্ডি প্রমুখ সাহিত্যিকের নানা রচনার পাণ্ডুলিপি রয়েছে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রয়েছে হাজার বছর আগের হাতে লেখা কোরান শরীফ। এই কোরান শরীফ সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা, এতে কোন কারুকার্য নেই। সেই সাথে আছে অটোম্যানদের সময়কার কারুকার্য-শোভিত কোরান শরীফ। নানা যুগের বাইবেল এবং গসপেলের সংগ্রহ আছে এই লাইব্রেরিতে। ১৭০০ বছর আগের বিখ্যাত কোডেক্স দেখতে পাবেন এখানে, যা ছিল গ্রীকে লেখা নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম সম্পূর্ণ রূপ। ১৪৫০ সালের জার্মানির মেইনে জনার গুটেনবার্গের ছাপাখানায় মুদ্রিত বাইবেলটি বিশ্বের প্রথম ছাপা বই, যা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল: মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর স্মরণে নির্মিত স্মৃতি সৌধটি ‘অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল’ নামে পরিচিত। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ পাউন্ড এবং সময় লেগেছিল ২০ বছর। স্মৃতি সৌধটি ১৭৫ ফুট উঁচু। এর সামনে পাথরের উপর ‘অ্যালবার্ট হল’ অবস্থিত।আটি কাঁচের গম্বুজ দিয়ে আচ্ছাদিত। আতে দশ হাজার লোকের বসবার স্থান রয়েছে। এটি নির্মাণে ৩ বছর সময় লেগেছিল এবং এর জন্য খরচ হয়েছিল ২ লক্ষ পাউন্ড।
শার্লক হোমস মিউজিয়াম: সাহিত্যিক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি শার্লক হোমসকে কেন্দ্র করে লন্ডনের বেকার স্ট্রীটে ‘দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়াম’টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গোয়েন্দা কাহিনীর প্রধান চরিত্র শার্লক হোমস ও তাঁর সহকারী ডাঃ ওয়াটসনের বাসস্থান স্যার ডয়েল যেভাবে ২২১বি- বেকার স্ট্রীটের বর্ণনা দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই সাজানো হয়েছে মিউজিয়ামটি। এছাড়াও স্যার ডয়েলের বর্ণনার সাথে মিল রেখে শার্লক হোমসের ব্যবহার্য জিনিস-পত্র দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এই মিউজিয়ামের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে শার্লক হোমসের মূর্তি। এছাড়াও শার্লক হোমসের বিভিন্ন ধরণের স্মারক বিক্রয় করা হয়। এই মিউজিয়ামটি শার্লক হোমস ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়।
লন্ডন অ্যাকুয়ারিয়াম: ‘লন্ডন অ্যাকুয়ারিয়াম’ ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অ্যাকুয়ারিয়াম। এই অ্যাকুয়ারিয়ামে পানির পরিমাণ দুই মিলিয়ন লিটারেরও বেশি এবং এতে চারশোর বেশি জলজ প্রাণী বিচরণ করে। জীব-জগতের বিপুল বৈচিত্র্য বিষয়ে শিক্ষামূলক নানা কর্মসূচি এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ‘লন্ডন অ্যাকুয়ারিয়াম’ কর্তৃপক্ষ বিপন্ন-প্রায় বিভিন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ ও এদের উপর গবেষণা করে থাকে। এই অ্যাকুয়ারিয়ামের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে হাঙ্গর ও ক্লাউন ফিস।
লন্ডন আই: একশো পঁয়ত্রিশ মিটার উঁচু লন্ডন আই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অবর্জাভেশন হুইল। এটি ২০০০ সালে স্থাপিত হয়। এখানে প্রতি বছর গড়ে সাড়ে মিলিয়নের বেশি দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ঘূর্ণায়মান লন্ডন আই’র সর্বোচ্চ স্থানটিতে অবস্থানকালে পঁচিশ মাইল দূরবর্তী স্থান পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়। ব্রিটেনের রাণীর গ্রামের বাড়ী ‘উইন্ডসর ক্যাসেল’ও দেখা যায় লন্ডন আই থেকে। প্রতিবার ঘূর্ণনকালে একসঙ্গে আটশো ব্যক্তি লন্ডন আইতে উঠতে পারেন। লন্ডন আইয়ের ওজন একুশ হাজার টন।
মাদাম তুসো: মাদাম তুসো জাদুঘর ব্রিটেনের লন্ডন নগরে অবস্থিত মোম দিয়ে তৈরি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মূর্তির সংগ্রহশালা। মাদাম ম্যারি তুসো নামের এক ফরাসী মহিলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাই পরবর্তীকালে মাদাম তুসো জাদুঘর নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। শুধুমাত্র মোম দিয়ে গঠিত জাদুঘরটিতে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, তারকা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খ্যাতনামা খুনি ব্যক্তিদের মূর্তিও সযত্নে রক্ষিত আছে।
লন্ডন জু: বাঘ, সিংহ, ক্যাঙ্গারু, হরিণ, অজগর, তোতা, পেঙ্গুইন, জিরাফের মতো প্রাণী ছাড়াও দুর্লভ ও বিচিত্রসব জীব-জন্তুর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে ‘লন্ডন জু’-তে। এছাড়াও লন্ডন জু কর্তৃপক্ষ নানান কারণে বিপন্ন-প্রায় প্রাণীকুলের সংরক্ষণের কাজ করে থাকে।
সায়েন্স মিউজিয়াম: বিজ্ঞানকে জীবনের কাছে এবং জীবনকে বিজ্ঞানের কাছে নিয়ে যেতে চায় লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামটি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক প্রদর্শনী-সংগ্রহশালা। মিউজিয়ামটির বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ‘আইএমকএএক্স থ্রিডি সিনেমা’ ও ‘বিজ্ঞানের বিষয়-ভিত্তিক নাটিকা’ সমূহ।
ডায়ানা মেমোরিয়াল ফাউন্টেইন: সুবিখ্যাত হাইড পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ডায়ানা প্রিন্সেস অফ ওয়েলস মেমোরিয়াল ফাউন্টেইন স্থাপিত। রাজকুমারী ডায়ানার স্মরণে গ্রানাইট-নির্মিত জলধারাটি উদ্বোধন করেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। উদ্বোধনের পর থেকে এ-জলধারাটি দেখার জন্য প্রতিদিন শত-শত ডায়ানা-প্রেমী হাইড পার্কে আসেন।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম: লাইফ অ্যান্ড আর্থ সাইন্সের সংগ্রহশালা হচ্ছে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামটির বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ডাইনোসার ও নীল তিমির নমুনা ও কঙ্কাল, প্রাগৈতিহাসিক জীবাশ্ম ও দুষ্প্রাপ্য শিলা।
ন্যাশনাল গ্যালারী: পশ্চিম ইউরোপীয় চিত্রকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা হচ্ছে ন্যাশনাল গ্যালারী। এই গ্যালারীর বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ভ্যানগগের সানফ্লাওয়ার, বতিচেল্লির ভিনাস অ্যান্ড মার্স, রাফায়েলের দ্য ম্যাডোনা অফ দ্য পিঙ্কস, লিওনার্দো ভিঞ্চির দ্য ভার্জিন অফ দ্য রকস, পিয়েরো দেল্লার দ্য ব্যাপটিজম অফ ক্রাইস্ট।