হিমালয় ডেস্কঃ আল্লাহ তাআলা মানুষকে দুই ভাগে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ আর নারী। এভাবে সৃষ্টি করা আল্লাহ তাআলার হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তবে আল্লাহ তাআলা কাউকে শুধু কন্যা সন্তানই দান করেন। আবার কাউকে পুত্র সন্তান। কাউকে আবার পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন। কাউকে কাউকে আবার কোনো সন্তানই দান করেন না। এ বণ্টনও আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের ভিত্তিতেই হয়। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَأَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا. তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা করে দেন বন্ধ্যা। -সূরা শুরা (৪২) : ৪৯-৫০ অর্থাৎ তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা। তার না পুত্র সন্তান জন্ম হয়, না কন্যা সন্তান। শত চেষ্টা-তদবির করলেও তার সন্তান হয় না।
এ সবই আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। যার জন্য তিনি যা উপযোগী মনে করেন তাকে তা দান করেন। কন্যা সন্তানও আল্লাহ তাআলার নিআমত। পুত্র সন্তানও আল্লাহ তাআলার নিআমত। কন্যা সন্তানেরও প্রয়োজন আছে, পুত্র সন্তানেরও প্রয়োজন আছে। পুরুষ মহিলার মুখাপেক্ষী, মহিলা পুরুষের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তাআলা স্বীয় বিশেষ হিকমতে পৃথিবীতে এমন এক জীবনব্যবস্থা দান করেছেন যেখানে উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। উভয়েই একে অপরের মুখাপেক্ষী। উভয়ের সৃষ্টি ও জন্মগ্রহণ আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। যখন আমরা নিজেদের অবস্থার পর্যালোচনা করি, তখন কিছু মুসলমানকে দেখতে পাই, যখন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে খুব আনন্দ প্রকাশ করেন।
উৎসাহের সাথে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয় মানুষদেরকে ‘ছেলে হওয়ার’ খবর জানান। খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করেন। খুব গুরুত্ব ও জাকজমকের সাথে আকীকার আয়োজন করেন। সব জায়গায় ‘ছেলে হওয়ার’ আলোচনা করেন এবং তার লালনপালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছেলে সামান্য অসুস্থ হলেই দৌড়ে কখনো ডাক্তারের কাছে যান। কখনো হাসপাতালে কখনো কবিরাজের কাছে। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণে অসন্তুষ্ট হওয়া অনেক মানুষই কন্যা সন্তান জন্ম নিলে কোনো খুশি প্রকাশ করে না। কারো সাথে ‘মেয়ে হওয়ার’ কথা আলোচনা করা হয় না। আর যদি কেউ জিজ্ঞাসাও করে বসে, তবে কোনো উত্তর দেওয়া হয় না। আর যদি বলেও তবে খুবই নিচু আওয়াজে, একেবারে অসহায় হয়ে বলে- ‘আমার মেয়ে হয়েছে’। অনেক সময় কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে স্বামী তার স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হয়। স্ত্রীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু মানুষের তো এটুকু বুঝ থাকা দরকার যে, এ মহিলার ইচ্ছাধীন কী আছে? না পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট করা তার ইচ্ছাধীন, না কন্যা সন্তান। তার ইচ্ছাধীন তো কিছুই নেই। বরং এসব তো আল্লাহ তাআলার হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের বিষয়। আর তিনিই তো ¯্রষ্টা। তিনি ছেলে দান করতে চেয়েছেন, ছেলে হয়েছে, মেয়ে দান করতে চেয়েছেন, মেয়ে হয়েছে। সুতরাং স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হওয়া এবং তার সাথে কথা বন্ধ করে দেওয়া কতটা বাড়াবাড়ি! অনেক মানুষ এমন আছেন, তাদের যদি কন্যা সন্তান হয়, তারা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন থেকে লুকিয়ে চলাফেরা করে, যেন কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে তারা আবার এ প্রশ্ন না করে বসে তোমার ঘরে কী হয়েছে? আর এ উত্তর দিতে হয়, আমার ঘরে কন্যা সন্তান হয়েছে। কন্যা সন্তান হলে তালাকের ধমকি এ ধরনের ঘটনাও শুনেছি, কারো এক-দুটি কন্যা সন্তান হওয়ার পর স্বামী তার স্ত্রীকে এ কথা বলে দিয়েছে, যদি এবারও তোমার মেয়ে হয় তাহলে তোমাকে তালাক দিয়ে দিব। নাউযুবিল্লাহ কেমন ধৃষ্টতা ও বাড়াবাড়ি!
যেন কন্যা সন্তানের স্রষ্টা এই নারী নিজে!! পুত্র বা কন্যা হওয়া যেন তার ইচ্ছাধীন!!! মোটকথা, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষ এমন আছে, যারা মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট হয়। একে নিজের জন্য কলঙ্ক মনে করে। অপমানের কারণ মনে করে। আর ছেলেকে সম্মান ও গৌরবের কারণ মনে করে। ছেলে হলে খুশি হয়, আনন্দ প্রকাশ করে, আর মেয়ে হলে করে না। কোনো মুমিনের জন্য এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ নাজায়েয ও গোনাহের কাজ। এমনকি আল্লাহ তাআলার হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের উপর আপত্তি করার নামান্তর। এটি জাহেলী যুগের কাফিরদের কর্মপন্থা কুরআনে কারীমে এ কাজকে কাফিরদের কাজ বলে উল্লেখ করেছে। ইসলামপূর্ব জাহেলী আরবে নিয়ম ছিল, যদি তাদের কন্যা জন্মলাভ করত,
তাহলে তারা কন্যা হওয়াকে নিজের জন্য অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। সন্তান জন্মের কিছুদিন পূর্ব থেকেই তারা মানুষের আড়াল হয়ে যেত, মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়াতো যে, জানা নেই আমার ঘরে কী সন্তান জন্মলাভ করবে। পরে যদি ছেলে সন্তান হতো এটাকে তার জন্য সম্মানের বিষয় মনে করত। আর যদি মেয়ে সন্তান হত তাহলে তারা সেটাকে অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। আল্লাহ তাআলা সূরায়ে নাহলে তাদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- وَ اِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰی ظَلَّ وَجْهُهٗ مُسْوَدًّا وَّ هُوَ كَظِیْمٌ یَتَوَارٰی مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِهٖ اَیُمْسِكُهٗ عَلٰی هُوْنٍ اَمْ یَدُسُّهٗ فِی التُّرَابؕ اَلَا سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখম-ল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনোস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানী হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে দিবে। লক্ষ্য কর, সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল।
-সূরা নাহল (১৬) : ৫৮-৫৯ কন্যা সন্তান ‘সুসংবাদ’ লক্ষ্য করুন, আয়াতে কন্যা সন্তানের জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলা হচ্ছে। তাদের জাহেলী কর্মকা- ও মানসিকতার শুধু নিন্দাই করা হয়নি বরং তারা যেটাকে দুঃসংবাদ মনে করছে সেটাকে ব্যক্তই করা হয়েছে ‘সুসংবাদ’ বলে। সাথে সাথে মুমিনদের মাঝেও যেন এ জাহেলী মানসিকতার লেশমাত্র না থাকে সেজন্য আল্লাহ আয়াতের শেষে বললেন, (তরজমা) লক্ষ্য কর সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল । একটি শিক্ষণীয় ঘটনা জাহেলি যুগে অনেকে নিজের দশ দশটি কন্যা সন্তানকেও জীবিত কবর দিয়েছে। হাদীস শরীফে এক ব্যক্তির একটি আশ্চর্য ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে (ঘটনাটি শুনে চোখে পানি ধরে রাখা মুশকিল)। এক ব্যক্তি মুসলমান হয়েছেন। মুসলমান হওয়ার পর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের জাহেলী যুগের ঘটনা শুনিয়েছেন।
হে আল্লাহর রাসূল! আমার একটি কন্যা সন্তান ছিল। সে দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কিন্তু তার জীবিত থাকার বিষয়টি আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি একদিন তাকে তার মায়ের কাছ থেকে কোনো এক বাহানায় নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, চলো একটু ঘুড়ে আসি। পরে আমি তাকে এক খোলা প্রান্তরে নিয়ে গেলাম। সেখানে পূর্বেই আমি একটা গর্ত করে রেখেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম, আমি এ কূপটি খনন করব যেন পানি পাওয়া যায়। আমি তোমাকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছি, তুমি বালতিতে মাটি ভরে দিবে আর আমি তা উপরে তুলে নিব। আমার মেয়ে আমার কথা মেনে নিল। সে নিচে নেমে গেল। কিন্তু যখনই সে নিচে নামল আমি তার উপর মাটি দিতে শুরু করলাম। মেয়েটি আমাকে বলল, আব্বা! আপনি কী করছেন? আমার উপর মাটি দিচ্ছেন!
কিন্তু আমি এতটাই কঠিন দিলের ছিলাম যে, তার কথায় আমার কোনো আছর হল না। আমি মাটি দিতেই থাকলাম। প্রথমে মাটি তার হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে নিল। পরে পেট, এরপর বুক, তারপর ঘাড়, অবশেষে মাথা পর্যন্ত ঢেকে নিল। এমনকি মাটি যমিনের সমান হয়ে গেল। আমার মেয়েটি চিৎকার করছিল, আমাকে ডাকছিল। এক সময় তার চিৎকার ও ডাকাডাকি শেষ হয়ে গেল। আমি তাকে এভাবে জীবিত দাফন করে ফিরে এলাম। তিনি বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ঘটনা শুনিয়েছি তখন তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, এ কেমন পাষ-তা! (আলওয়াফী বিলওয়াফায়াত ২৪/২১৫, কায়েস ইবনে আছেম ইবনে সিনান ইবনে খালেদ-এর জীবনী দ্রষ্টব্য) ইসলাম এই জুলুম-প্রথার অবসান ঘটিয়েছে।
তাই এ প্রথার সাথে মুসলমানের কোনোরূপ সামঞ্জস্য থাকা উচিত নয়। কন্যা সন্তান হলে কোনোরূপ অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। মুসলমানদের এ কাজ পরিহার করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনিভাবে কন্যা সন্তান হওয়াকে আল্লাহর রহমত বলেছেন এবং কন্যা সন্তানের সাথে তিনি যে ভালোবাসা, মহব্বত ও স্নহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন- এ আমাদের আদর্শ। আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপন্থা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যাদের সাথে অত্যন্ত মহব্বত ও ¯স্নেহের আচরণ করতেন। তাঁর চারজন কন্যা সন্তান ছিলেন। ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহা, যয়নব রাযিআল্লাহু আনহা, রুকাইয়া রাযিআল্লাহু আনহা, উম্মে কুলসুম রাযিআল্লাহু আনহা। প্রথম তিন মেয়ের ইন্তিকাল আগে হয়ে যায়।
হযরত ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার ইন্তিকাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের ছয় মাস পরে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফরে যেতেন, সবশেষে ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার সাথে দেখা করে যেতেন। আবার যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন, সর্বপ্রথম ফাতেমা রাযিআল্লাহু আনহার সাথে দেখা করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের আমলের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের সম্মান, তার প্রতি ¯স্নেহ ও মহব্বতের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেন আমরাও তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে নিজের কন্যা সন্তানের সাথে তেমন আচরণ করতে পারি, যেমনটি তিনি তার কন্যাদের সাথে করে দেখিয়েছেন। কন্যার লালনপালন জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যা সন্তানের লালনপালনের যে পরিমাণ ফযীলতের কথা বলেছেন, পুত্র সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ বলেননি।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- لاَ يَكُونُ لأَحَدِكُمْ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِنّ إِلاّ دَخَلَ الجَنّةَ. যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে। আর সে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করেছে তাদেরকে নিজের জন্য অসম্মানের কারণ মনে করেনি সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১২ অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوْ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَأَحْسَنَ صُحْبَتَهُنّ وَاتّقَى اللّهَ فِيهِنّ فَلَهُ الجَنّةُ. যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে অথবা দু’জন কন্যা সন্তান বা বোন আছে। সে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাত।
-জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬ দেখুন, এ ফযীলতের কথা পুত্র সন্তানের বেলায় বলা হয়নি। বরং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। এজন্য আমাদের উচিত কন্যা সন্তানের লালনপালন সন্তুষ্টচিত্তে করা। কন্যা সন্তান জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় হযরত আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ ابْتُلِيَ بِشَيْءٍ مِنَ البَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنّ كُنّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النّارِ. যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সাথে তা সম্পাদন করেছে সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৩ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়া দেখুন! জান্নাতে প্রবেশ করার মাধ্যমও হল কন্যা সন্তানের লালনপালন করা। আবার জাহান্নাম থেকেও মুক্তি মিলবে কন্যা সন্তানের উত্তমরূপে প্রতিপালন করার দ্বারা।
এর চেয়ে বড় আরেকটি ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আনাস রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الجَنّةَ كَهَاتَيْنِ، وَأَشَارَ بِإصْبعَيْهِ. যে ব্যক্তি দুইজন কন্যা সন্তানকে লালনপালন ও দেখাশুনা করল [বিয়ের সময় হলে ভাল পাত্রের কাছে বিবাহ দিল] সে এবং আমি জান্নাতে এরূপ একসাথে প্রবেশ করব যেরূপ এ দুটি আঙুল। তিনি নিজের দুই আঙুল মিলিয়ে দেখালেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৪ কন্যা সন্তান প্রতিপালনের তিনটি ফযীলত সকল ফযীলতের সারমর্ম হল তিনটি জিনিস। এক. আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। দুই. জান্নাত দান করবেন। যা নিআমত ও আরাম আয়েশের স্থান। তিন. আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য দান করবেন। যা সফলতার সর্বোচ্চ চূড়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ তিনটি ফযীলত বর্ণনা করেছেন কন্যা সন্তান লালনপালনকারীদের জন্য।
কন্যা সন্তানের জন্মে অধিক আনন্দ প্রকাশ করা ইসলামের শিক্ষা হল, কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আনন্দ প্রকাশ করা; তাইতো কন্যা জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর সুসংবাদ শুনে মানুষ আনন্দই প্রকাশ করে। এজন্য অনেক উলামায়ে কেরাম লেখেন, যেহেতু কন্যা সন্তান জন্মানোর কারণে নিজেকে ছোট মনে করা, একে অপমান ও অসম্মানের কারণ মনে করা কাফিদের কর্মপন্থা, তাই মুসলমানগণের উচিত, তারা কন্যা সন্তানের জন্মের কারণে অধিক খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করবে। যাতে কাফিরদের এ নিচু রীতির প্রতিবাদ হয় এবং এ রীতি যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়। কন্যা সন্তানের হকসমূহ কন্যা সন্তানের লালনপালনের ফযীলত বর্ণনার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যা সন্তানের হকসমূহও বর্ণনা করেছেন। জাহেলী যুগে এ হকসমূহ থেকে কন্যা সন্তানকে বঞ্চিত করা হত। আজকালও তাদের হকসমূহ আদায়ের ব্যাপারে অবহেলা করা হয়। এজন্য তাদের হকগুলো বুঝে নেওয়া জরুরি।
যেন এ ব্যাপারে আমাদের অবহেলা না হয়। ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা কারো পুত্র সন্তানের প্রতি ভালবাসা বেশি আবার কারো কন্যা সন্তানের প্রতি। অধিকাংশ লোকের পুত্র সন্তানের তুলনায় কন্যা সন্তানের প্রতি ভালবাসা কম থাকে। ভালবাসা ও মহব্বতের সম্পর্ক হল অন্তরের সাথে। এতে মানুষের ইচ্ছার দখল নেই। এজন্য এ ক্ষেত্রে সমতা রক্ষার বিষয়ে মানুষ বাধ্যও নয়। তবে ভালবাসা প্রকাশ মানুষের ইচ্ছার অধীন। এ ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। অনেকে ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কমবেশি করে। তারা ছেলেকে বেশি বেশি খাওয়ায়, বেশি বেশি ঘুরতে নিয়ে যায়। আর মেয়েকে জিজ্ঞাসাও করে না। এভাবে সে মেয়ের সাথে ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে কমবেশি করে। যেহেতু ভালবাসা প্রকাশ করা মানুষের ইচ্ছাধীন বিষয় তাই এ ক্ষেত্রে কমবেশি করা অন্যায়। সুতরাং কখনো মা-বাবা কথায় ও কাজে এমন ভাব প্রকাশ করবে না, যাতে সন্তানরা বুঝতে পারে, মা-বাবা অমুককে বেশি ভালবাসেন, অমুককে কম ভালবাসেন।
এমনটা করবে না। যদি মা-বাবা এমনটা করেন তাহলে তা হবে অন্যায় এবং কিয়ামতের দিন এর জন্য পাকড়াও করা হবে। সন্তানদের দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা যেমনি ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা উচিত তেমনি কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষার হুকুম রয়েছে। তাই মা-বাবা যদি তাদের জীবদ্দশায় সন্তানদের মাঝে টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় অথবা খাদ্যবস্তু বণ্টন করেন তবে সে ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা জরুরি। মেয়েকেও সেই পরিমাণ দিবে, যে পরিমাণে ছেলেকে দিয়েছে। মা-বাবা যখন প্রয়োজনের বাইরে অথবা খুশি হয়ে সন্তানদের কিছু দিবে সে ক্ষেত্রেও এ সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। যেমন, ঈদের সময় ঈদের বকশিশ অথবা সফর থেকে ফিরে এসে সন্তানদের হাদিয়া দেওয়া ইত্যাদি। প্রয়োজনের বিষয়টি ভিন্ন কিন্তু বাবা-মা যদি প্রয়োজনে কোনো সন্তানের জন্য কিছু ব্যয় করেন যেমন, অসুস্থতার জন্য খরচ করছেন, কারো শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করছেন, ছেলে অথবা মেয়ে কেউ সফরে যাচ্ছে, কারো সফর ছোট কারো সফর বড়, কারো সফরে বেশি টাকার প্রয়োজন আবার কারো কম, এমনিভাবে প্রয়োজনের সময় সন্তানদের জন্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে কমবেশি করার মধ্যে কোনো গোনাহ নেই। বরং যার যতটুকু প্রয়োজন তাকে ততটুকু দিতে পারবে। বিয়ের কারণে মেয়ের হক শেষ হয়ে যায় না আমাদের সমাজের অবস্থা তো এমন যে, প্রথমত মেয়েদেরকে ধন-সম্পদ ও জায়গা-জমি দেওয়াই হয় না।
আর যদি তাকে বলা হয়, তুমি তো সবকিছু ছেলেদেরকেই দিয়ে দিয়েছ, মেয়েদেরকে তো কিছুই দিলে না! উত্তরে বলা হয়, তাদের বিয়ে-শাদী তো দিয়েছি। মেয়ের বিয়েতে যে যৌতুক দিয়েছি তাতে তার হক আদায় হয়ে গেছে। (যৌতুক দেওয়া শরীয়তসম্মত নয়।) স্মরণ রাখুন! এটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। যেমন মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়ার দ্বারা পিতার মীরাছ থেকে মেয়ের হক শেষ হয়ে যায় না তেমনি যৌতুক দেওয়ার কারণে মেয়েকে ধন-সম্পদ ও জায়গা-জমি থেকে বঞ্চিত করাও ঠিক নয়। পিতা যেমন মেয়ের বিয়েতে খরচ করে তেমনি ছেলের বিয়েতেও খরচ করে। বরং সাধারণত ছেলের বিয়েতে মেয়ের বিয়ের চেয়ে বেশি খরচ করা হয়। অথচ বিয়ে-শাদীর খরচের ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা উচিত। এর সহজ একটি পদ্ধতি হচ্ছে, আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় অর্থের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক করে নিবে যে, আমি আমার প্রত্যেক ছেলেমেয়ের বিয়েতে এ পরিমাণ টাকা ব্যয় করব। বিয়ের খরচাদি করার পরও যদি নির্ধারিত পরিমাণ থেকে কিছু টাকা বাকি থেকে যায় তবে তাকে দিয়ে দিবে।
এমনটি করবে না, এক সন্তানের বিয়েতে বেশি খরচ করবে আর অন্য সন্তানের বিয়েতে কম খরচ করবে। এটাও এক প্রকার অন্যায় ও নাইনসাফী। সারকথা পুরো আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে : এক. কন্যা সন্তান হলে পেরেশানি, রাগ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা না জায়েয। এটা ইসলামী কর্মপন্থা নয়। ইসলাম এ বিষয়ের নিন্দা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে এর ভ্রান্ততা সাব্যস্ত করেছেন। তাই মুসলমানদের এ ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত থাকা উচিত।
যখন কারো কন্যা সন্তান হয় তখন সে যেন ঐ রকম খুশিই প্রকাশ করে, যেমনটি ছেলে সন্তান হলে করা হয়। দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যা সন্তান লালনপালনের যে ফযীলত ও সাওয়াবের উল্লেখ করেছেন এর উপর বিশ্বাস রাখবে এবং এর উপরই সন্তুষ্ট থাকবে। এ কথা ভাববে যে, এই এক মেয়েই আমার জান্নাতে যাওয়ার কারণ হতে পারে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হতে পারে। তাই পূর্ণ খুশি ও সন্তুষ্টির সাথে যেভাবে ছেলেদের লালনপালন করা হয় ঠিক সেভাবেই মেয়েদেরও লালনপালন করবে। ইমান২৪.কম এর সৌজন্যে।