করিম চৌধুরী: ছাত্রজীবনে তিন চারটি দৈনিক পত্রিকা পড়তাম। আমাদের ছাত্রজীবনে পত্রিকায়ই ছিলো দৈনিক ৫/৬টি । ১৯৮৮ সালের কথা । সাপ্তাহিক যায়যায়দিন তখন নিষিদ্ধ । মিনার মাহমুদ-এর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বিচিন্তা তখন কিছুটা জনপ্রিয়। মিজানুর রহমান মিজান সম্পাদিত সাপ্তাহিক খবর তখন দৈনিক রূপে প্রকাশিত হচ্ছে। আমি দৈনিক খবর-এর পাঠক ছিলাম না। আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা ছাত্রলীগ করতো তারা সবাই দৈনিক খবরের পাঠক ছিলো ।
এক সিনিয়র ভাই/ বন্ধু, যিনি জেলা ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা, মি. আতিক উল্লাহ খোকন, তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সন্ধ্যার পর তুই একটু বাসায় আসিস। দরকার আছে। আতিক ভাইয়ের বাসা ঝাউতলা । শহীদ শামসুল হক সড়কে । আতিক ভাই এখন কুমিল্লা শহরের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ।
বাসায় গেলে তিনি আমাকে দুটো দৈনিক খবর হাতে দিয়ে বললেন, তুইতো অনেক পত্রপত্রিকা পড়িস। দু’দিনের এই দুটো খবর পত্রিকা দেখে আমাকে বলতো সমস্যাটা কোথায়? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগছে। কোথায় যেন একটু গ্যাঞ্জাম।
রাত তিনটা পর্যন্ত গভীর মনোযোগে পত্রিকা দুটো পড়ে সিনিয়র ভাইকে রিপোর্ট দিলাম যে, আগের দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত চল্লিশটা বড় নিউজ পরের দিনের পত্রিকায় হুবহু ছাপা হয়েছে। শুধু পৃষ্ঠা ও কলাম পরিবর্তন করে। দৈনিক খবরের ওই দুটো সংখ্যা ছিল ২২ ও ২৩ মে ১৯৮৮।
আমি তখন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তির অপেক্ষায় আছি ।
আমি সব সময়ই দুরন্ত আর প্রতিবাদী চরিত্রের । নিউজগুলো মার্ক করে পত্রিকা দুটো নিয়ে পরদিন ঢাকা ‘দৈনিক খবর’ অফিসে গেলাম । তখন খবর অফিস ছিল ১৩৭ শান্তিনগর।
দোতলায় এক ভদ্রলোককে বললাম, সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভদ্রলোক পাঁচ সের ওজনের এক বিশাল খাতা আমার সামনে মেলে ধরে নাম, ঠিকানা ও সাক্ষাতের কারণ লিখতে বললেন।
ভাবলাম, আরে, বিরাট ব্যাপার-স্যাপার তো! কারণ লিখলাম, খবর পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
এবার ওই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে চাপাবাজি শুরু করলেন। কি অভিযোগ আমাকে বলেন, সম্পাদক এখন ব্যস্ত, বম্বে থেকে লোক এসেছে, দেখা করা সম্ভব না।
ছোটবেলা থেকেই আমার ঘাড়ের রগ ত্যারা ।
বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। আমার সময় আছে। আমি সিঁড়িতে বসে থাকবো। সম্পাদক অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়িতেই কথা বলবো।
উল্লেখ্য, ওই ভদ্রলোক আমাকে বসতে বলেননি, এমনকি তার সামনে ভিজিটর্স চেয়ার নেই।
আমার এই নাছোড়বান্দা আচরণে শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের রুমে প্রবেশ করার অনুমতি তিনি দিলেন।
রুমে ঢুকেই দেখি টেবিলে কনুই ঠেস দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত থুতনিতে লাগিয়ে সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান বসে আছেন। তার চোখে একটা রেকট্যাংগুলার ফ্রেমের ছোট চশমা। চশমাটা নাকের ডগায় লাগানো। এমন চশমা আগে দেখিনি এবং এভাবে চশমা পরতেও কাউকে দেখিনি। তবে সামরিক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সামরিক পোশাকে টিভিতে যখন ভাষণ দিতেন তখন এই ষ্টাইলে চশমা পরতেন।
সম্পাদকের টেবিলে পত্রিকা দুটো মেলে ধরে সবগুলো রিপিট নিউজ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কারণ কি?
তিনি বললেন, পৃন্টিং মিসটেক, ছাপাখানায় অনেক সমস্যা হয়। বেক্কল বুঝ দেয়ার মতো আরো অনেক কথা। কিন্তু আমি যে ওই সময় থেকেই পত্রিকা বিশেষজ্ঞ এবং একটু আধটু লেখালেখি করি তা সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান জানতেন না ।
বললাম, মিসটেকই যদি হবে তাহলে পৃষ্ঠা নাম্বার ও কলামগুলো পরিবর্তিত হলো কেন? একটা দুটো নিউজ হলে কথা ছিল, চল্লিশটা বড় নিউজ।
যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির পর অধৈর্য্য হয়ে বললাম, এটা ইচ্ছাকৃত এবং ইনটেলেকচুয়াল ডিসঅনেষ্টি।
এবার তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তাঁকিয়ে বললেন, একজন সম্পাদকের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে না।
বললাম, আমি শুধু সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলছি না, পত্রিকার মালিকের সঙ্গে কথা বলছি। পাঠকেরা পয়সা খরচ করে পত্রিকা কেনে বলেই আপনার পত্রিকা চলে। একই নিউজ পাঠক কেন দু’বার পড়বে?
এবার তিনি কিছুটা সুর নরম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার পিঠ চাপড়ে আদরের ভঙ্গীতে বললেন, ছোট ভাই, আমার প্রতিষ্ঠান বড়। সব দিক ম্যানেজ করতে পারি না। তাই মাঝে মধ্যে গ্যাটিস দিই অর্থাৎ একই খবর পুনরায় ছাপি।
সরল স্বীকারোক্তি বটে!
প্রসঙ্গ পাল্টে এবার বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এত বাধা কেন?
তিনি বললেন, আমার সঙ্গে তো দেখা করতে পেরেছেন, ইত্তেফাকে গেলেতো অফিসেই ঢুকতেই দেবে না।
আমি ইত্তেফাকের সিরিয়াস পাঠক। উপসম্পাদকীয় কলামগুলো, নিবেদন-ইতি-অভাজন, স্থান-কাল পাত্র- লুব্ধক, ঘরে-বাইরে-সন্ধানী, প্রিয়-অপ্রিয়-সত্যদর্শী, চতুরঙ্গ-সুহৃদ কোনোদিন বাদ দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। তবে ইত্তেফাক ভবনে কোনোদিন যাইনি।
খবর অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম টিকাটুলি ইত্তেফাক ভবনে। একজন পাঠক কেন পত্রিকা অফিসে ঢুকতে পারবে না এই মনোভাব নিয়ে। ইত্তেফাক ভবনে ঢুকতে আমাকে কেউ বাধা দেয়নি। দোতলা বা তিন তলায় খুব সম্ভবত তিন তলার বিভিন্ন রুমে উকি দিচ্ছি। এক রুমে সুদর্শন মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক গভীর মনোযোগে কি যেন লিখছেন।
সাহস করে রুমে ঢুকতেই ভদ্রলোক শান্তভাবে আমার দিকে তাঁকালেন। এই ভদ্রলোকের চোখেও চশমা। তবে এই চশমার ফ্রেমটি বড় এবং মোটা। স্কয়ার নয়, আবার রাউন্ডও নয়। হুমায়ূন আহমেদ-এর সবুজ ছায়া নাটকে মাষ্টারের ভূমিকায় সালেহ আহমেদ যে রকম চশমা পরতেন ঠিক সে রকম এই চশমাটি।
বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিয়ে বললাম, আমি ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বশীল কারো সঙ্গে দেখা করতে চাই।
সামনের চেয়ার দেখিয়ে তিনি আমাকে বসতে বললেন। তিনি সুনির্দিষ্ট নাম জানতে চাইলেন যে, কার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বললাম, আমি কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে লেখার সঙ্গে পরিচিত। যেমন লুব্ধক-আখতার-উল-আলম, তিনি তখন ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অভাজন-আবেদ খান, সত্যদর্শী-মহাদেব সাহা,সন্ধানী-হাবিবুর রহমান মিলন, সুহৃদ-রাহাত খান, তাদের মধ্যে যে কেউ একজন।
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি শান্তভাবে বললেন, আমি আবেদ খান। কিছু বলবে? কোনো অভিযোগ?
আমি তাৎক্ষণিক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধেয় কলামিষ্টকে ষ্ট্যান্ডিং ওভেশন দিলাম। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলাম। উল্লেখ্য, ‘নিবেদন-ইতি’ সাধু ভাষার ওই কলামটি আমার অন্যতম প্রিয় কলাম ছিল।
এরপর দৈনিক খবরের রিপিট নিউজগুলো দেখালাম এবং সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানের গ্যাটিস দেয়ার কথা বললাম। এরই মধ্যে ইত্তেফাকের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আখতার-উল-আলম ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক রাহাত খান এলেন। আবেদ খান আমাকে দেখিয়ে দু’জনকে ঘটনাটি বললেন।
পরে আবেদ খান আমাকে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে প্রেস কাউন্সিলে কেস করতে পারো। পাঠকের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। একই নিউজ পুনরায় প্রকাশ করে পাঠককে প্রতারিত করা হয়েছে ইত্যাদি।
বললাম, ওসব ঝামেলায় আমি যাবো না। আপনি লেখক। আপনার ‘নিবেদন-ইতি’ কলামে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখলে খুশি হবো।
আবেদ খান আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। ৬ জুন ১৯৮৮ সালের দৈনিক ইত্তেফাকের নিবেদন-ইতি কলামে মিজানুর রহমান মিজানের গ্যাটিস দেয়ার ঘটনাটি তিনি লিখেছিলেন।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ পত্রিকা সম্পাদক চশমা পরেন। দয়া করে রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা পত্রিকার নিউজে আপনারা গ্যাটিস দেবেন না প্লিজ। আপনারা দেশ ও জাতির কল্যাণে দল নিরপেক্ষভাবে সত্য প্রকাশ করুন। আপনাদের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা।
(লেখাটি ২০০৩ সালের জুন মাসে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। লিখেছিলাম ফ্লোরিডা থেকে ।এখন তো সব পত্রিকা, টিভি, অন লাইন নিউজ পোর্টাল সবাই কোনো না কোনো ভাবে গ্যাটিস দেয় বিভিন্নভাবে । কোনটা আসল খবর আর কোনটা নকল বোঝার কোনো উপায় নেই।)
Related articles
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।
HimalaySep 20, 2023