আমাদের মাথায় একটা আস্ত মিথ্যা ধারণা ঢুকে গেছে। ‘বিয়ের পরে ছেলেমেয়ে আর আগাতে পারেনা, জীবন স্থবির হয়ে যায়।’ এটি যে একটি হাস্যকর যুক্তি তা একটু ভাবলেই বুঝবেন।
আল্লামা ইকবালের নাম শুনেছেন? তিনি ছাত্রজীবনেই বিয়ে করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে জন্ম নেয়া ইকবাল বিয়ে করেছিলেন ১৮৯৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে। বিশ্বখ্যাত হয়েছেন, আল্লামা খ্যাতি পেয়েছেন, আরো অনেক পরে। কিন্তু বিয়ে তো তার জন্য বাধা হয়নি। ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজ থেকে দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এবং স্বর্ণ পদক নিয়ে এখান থেকেই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ততদিনে সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব আল্লামা ইকবাল। তিনি ১৯০৫ সাল হতে লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কনস ইন হতে তিন বৎসরের আইনের ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে। আল্লামা শুনে হয়ত ভাবছেন মৌলবী মানুষ, আর মৌলবিরা একটু আগেই বিয়ে করে। বাস্তব কথা হল, উনি মৌলবী নন। পুরোদমে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, যা উপরের তথ্য দেখেও বোঝা যায়। তবে ইসলামী জ্ঞানের গভীরতার কারণে তিনি এই উপাধি পান। দীন ও দুনিয়ার জ্ঞানে এমন সুপণ্ডিত কিন্তু এগুলো হবার বহু আগেই বিয়ে করেছিলেন।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের নাম তো নিশ্চয়ই জানেন। বাংলা পড়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা পড়েনি এমন লোক পাওয়া যাবেনা। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে তিনি নোবেল বিজয়ী। তিনি কিন্তু পড়াশোনার পরে বিয়ে করেছিলেন তা নয়। ১৮৬১ সালে জন্ম নেয়া রবী ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ভবতারিণীকে বিয়ে করেন। বাংলা সাহিত্যের বাইরে বলি, শেক্সপিয়রের গল্প তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। ঐ যে বিশ্বখ্যাত হ্যামলেটের লেখক। ইংরেজি সাহিত্য যার লেখা ব্যতিত অন্ধ। সেই শেক্সপিয়র ১৮ বছরেই বিয়ে করেছিলেন ২৬ বছরের এক নারীকে। এই বিয়েও তার কর্মে বাধা হয়ে দাড়ায়নি।

আচ্ছা অতদূরে এবং সাহিত্যে না থেকে রাজনীতিতেও একটু ঢু মারা যাক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বহু আগে ১৯৩৮ সালে বিয়ে করেন ফজিলাতুন্নেসাকে। বিয়ে তো তার কার্যক্রমে বাধা হয়নি। বরং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের সকল কঠিন মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী তাকে সাপোর্ট দিয়েছে। আসলে মানুষের বয়সের পরিবর্তনে ভিন্ন কিছু মানুষ থেকে মানসিক সাপোর্ট থাকার দরকার পড়ে। সবসময় এক শ্রেণীর মানুষের সাপোর্ট একজনের জন্য যথেষ্ট হয়না। যৌবনে একটি ছেলের জন্য একটি মেয়ের আর একটি মেয়ের জন্য একটি ছেলের সাপোর্ট খুব কার্যকরী হয়। যখন বৈধ ব্যক্তির থেকে সেই সাপোর্ট পাবার দ্বার বন্ধ থাকে তখন তারা অবৈধ ব্যক্তির থেকে সাপোর্ট পাবার দ্বার খুলতে চায়।
যাই হোক, এদের কারো জীবন যদি বিয়ের পরে থেমে না থাকে তবে আপনি একটি মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের উপর আস্থা কেন রাখতে পারেন না? আমার নিজেরই কিছু ফ্রেন্ড আছে, যারা কলেজে পা দেবার আগেই বিয়ে করেছে। তাদের বাচ্চা ছিল, সংসার ছিল। তাদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো। আপনি ভাববেন, বিয়ে না করলে এরা হয়ত আরও ভালো করতে পারত। আমি তো ভিন্ন কথাও বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবি শিক্ষার্থী মদ, গাজা, ইয়াবাসহ নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়ে একসময় ইয়ার ড্রপ দিয়ে ছাত্রত্ব হারায়। সোনার ছেলেটা হয়ে যায় তামার চেয়ে মূল্যহীন। অনেক ছেলেমেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে।
আসলে আপনি যদি পৃথিবীর সব মানুষের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তবুও কাউকে না কাউকে আপনার বিশ্বাস করতেই হবে। নইলে আপনার জীবন অচল হয়ে যাবে। আপনার মনে সন্দেহ, স্ত্রী কোন পরকীয়া করছে কিনা। আপনি যদি ভাবেন আপনার স্ত্রী খাবারে বিষ দিতে পারে, আপনি এজন্য তার রান্না খাওয়া বাদ দেন। তবে কি চলবে এই জীবন? আবার আপনার স্ত্রী আপনার সাথে নৌ বিহারে যাবেনা। কারণ যদি নিয়ে মেরে ফেলেন, এমন ঘটনা তো ঘটেই। ঘটবার মত পরিস্থিতি যদি হয়, পারবেন কি সে জীবন এড়াতে? সুতরাং বিশ্বাস আপনাকে রাখতেই হবে।
আমার সারকথা হলো, আপনার সন্তানের চাহিদাকে বুঝুন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন তাদের সকল চাওয়াকে পূরণ করতে। টাকা আর রূপের পেছনে নয় বরং ভালো একটা মানুষ বড় প্রয়োজন। যে বিপদে-আপদে ছায়া হতে পারে, এমন মানুষকে কলিজার টুকরার জন্য বাছাই করুন।
আজ প্রায় সব মানুষই তার দাম্পত্য জীবনে অসুখী। কেউ সাহস করে বন্ধন ছিন্ন করে, নতুন করে সাজাতে চায় সব। কেউবা সমাজের কারণে নীরবে কাঁদে, চোখের জলে ভাসায় বুক, আজানায় মন ছুটে যেতে চায়, নিজেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারেনা। কারণ সমাজের চোখে সে নিচু হয়ে যাবে। বাইরে বলে সে খুব সুখী। রেস্টুরেন্টে খেয়ে আর সী বীচে ঘুরে ফটো আপলোড করে তা শো করে। কিন্তু ভেতরতা পুড়ে যায়। নিরন্তন মনের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হয় তাকে। আর যারা সাহস করে বন্ধন ছিন্ন করে তারা কি সুখী হয়? হয়না। হলেও খুবই কম। আপনি টাকা দেখে বিয়ে দেবেন আপনার কলিজার টুকরাকে যদি টাকাওলা মানসিক যন্ত্রনা দেয়! যদি তার প্রাপ্য ভালোবাসার ডালি আপনার মেয়ের সামনে মেলে না ধরে? আপনার ছেলেকে যদি পরীর মতো পুত্রবধূ ভালো না বাসে আর আপনাদেরও সম্মান না করে তবে ঐ পরীর কি মূল্য? তো টাকা আর রূপই কি সব?
টাকা আর রূপই যদি সব হতো তবে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার মালিক আর চিত্র জগতের নায়িকারা কেন আত্মহত্যা করে? ভালো মনের ২ টি মন কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারে কিন্তু (সম্পদে) অভাবমুক্ত ২ টি ভিন্ন মনের মানুষ পাশাপাশি আরামে-আনন্দে থাকতে পারেনা। হয়ত পরিস্থিতির কারণে অভিনয় করে জীবন কাটায়। আমাদের পূর্বসূরি তো সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন যারা দুনিয়ার আগে আখিরাত দেখতেন। তাইতো তাদের দুনিয়ার জীবন কষ্টে গেলেও আত্মিক প্রশান্তি তাঁরা পেয়েছেন। আর আমরা আজ যাদের আইকন হিসেবে দেখছি, তারা নিজেরাও বড় অশান্তিতে আছে। আল্লাহর ভয় যদি না থাকে তবে সে অন্যের হক আদায়ে উদ্যোগী হতেও পারে, নাও পারে। মানে ৫০% চান্স। আল্লাহর ভয় থাকলে সে জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্যের হক আদায়ে মনোযোগী হব- এটাই প্রত্যাশা। (মুখলেছুর রহমান কতৃক সম্পাদিত)