বরিশালের কিছু দর্শনীয় স্থাপনা
HimalayDec 17, 2018পর্যটন, পর্যটন গাইড
হিমালয় রিপোর্টঃ ধান নদী খাল এই তিনে মিলে বরিশাল। দেশের সবচাইতে বিলাস বহুল নৌ যান গুলোও চলে এই রুটে। শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠা আজকের প্রজম্মের অনেকেরই নৌ ডুবির ভয়ে পানি পথে তেমন ভ্রমণ করা হয়ে উঠেনি। তাদের জন্য এই শীতে দক্ষিণ বঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা বরিশাল ঘুরে দেখার মোক্ষম সময়। কারণ শীতে নদী থাকে শান্ত আকাশে থাকে না ঝড়ের পূর্বাভাস কিংবা হঠাৎ কাল বৈশাখীর ঘনঘটা সুতরাং নৌ দুর্ঘটনার সুযোগ নেই বললেই চলে। সব চাইতে মজার ব্যাপার এই রুটের নৌ ভ্রমণে পরিবারের সব বয়সি সদস্যদের নিয়েই আরাম দায়ক ঘুরার আনন্দের ষোলকলা পূর্ণ করা যাবে। আমিও সেই সুযোগে নদী পথে পরিবার নিয়ে বরিশাল জেলার দর্শনীয় জায়গা গুলো থেকে ঘুরে এলাম। আজকের আধুনিক বরিশালের পূর্ব নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। কালের পরিক্রমায় সেদিনের চন্দ্রদ্বীপই আজকের বরিশাল। এই জেলায় ক্ষণে জম্ম নেয়া মনিষীরা আজো ইতিহাসের পাতায়, তাদের অবদানের জন্য উজ্জল। বরিশালের ইতিহাস – ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। বরিশালকে দেশের শষ্য ভান্ডারও বলা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা শুনলে খুব সহজেই বুঝা যায়,উনি যে বরিশালের। মুই বরিশাইল্লা পোলা, লঞ্চের পিছন ধইরা ঢাহা আইছি। একসময় প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবেও বরিশালের পরিচিতি ছিল। সেখানে যাওয়ার আরো একটি উপলক্ষ্য ছিল, আমার ভগ্নিপতি ডাক্তার আওলাদ হোসেনের বর্তমান কর্মস্থল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ব্যাটে বলে মিলে যাওয়ায় ভ্রমণে যাবার মোক্ষম সুযোগটি এবার আর হাত ছাড়া করি নাই, ঢাকার লালকুঠি ঘাট হতে তিনটার ওয়াটার বাসে চড়ে রাত ৯টায় গিয়ে নামি বরিশাল লঞ্জ ঘাটে। মাঝের কয়েক ঘন্টা বিলাস বহুল ওয়াটার বাসে কেটেছে বেশ। তিন বছরের ভাগ্নি মাহাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোন জামাই ওয়াটার বাস পৌছার আগেই তিনি ছিলেন লঞ্চ ঘাটে হাজির। ঘাটে ভিড়ার পর নানু-মামুকে পেয়ে ভাগ্নিও বেশ উৎফুল্ল। অটো’তে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সি. এম. বি ১নং পুল এলাকায় তাদের ফ্ল্যাটে পৌছে যাই, প্রথম দর্শনেই ভাল লাগল ঘাট হতে বাসা পর্যন্ত যেতে রিক্সার কোন জট না দেখে।
দুর্গাসাগর: ধর্ম সাগর, নীলসাগরের মত সাগরের সাথে নামের মিল থাকলেও মূলত এটি একটি দীঘি। বরিশাল শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলায় এটি অবস্থিত। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপ পরগণার তৎকালীন রাজা শিব নারায়ণ উক্ত এলাকার পানির সংকট নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় করে দীঘিটি খনন করেন। জানা যায়, রাজার স্ত্রী রানী দুর্গাবতী একবারে যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততদূর পর্যন্ত এই দীঘিটি খনন করা হয়। কথিত আছে রানী দুর্গাবতী দীঘি খননের উদ্দেশ্যে ৬১ কানি জমি পর্যন্ত হেঁটেছিলেন। দুর্গাসাগর দীঘির তিন দিকে তিনটি ঘাটলা রয়েছে এবং মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ। দীঘিটি স্থানীয় জনগণের কাছে দুর্গাসাগর মাধবপাশা দীঘি নামেও সুপরিচিত। নানা গাছগাছালিতে ঘেরা দুর্গাসাগর দীঘি অপূর্ব ও মনমাতানো রূপ যেকোনো মানুষকেই আকৃষ্ট করবে। এছাড়া দীঘির প্রতিটি বাঁক আপনাকে মোহিত করবে। এক হিসেব অনুযায়ী, ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমি নিয়ে দীঘির অবস্থান। ২৭ একর ৩৮ শতাংশ আয়তন নিয়ে জলাশয় এবং ১৮ একর ৪ শতাংশ জমি নিয়ে পাড় তৈরি করা হয়েছে। চারপাশে হাঁটার রাস্তা রয়েছে ১.৬ কিলোমিটার।ঘরে গিয়ে সাফসুতর হতে হতেই ডাইনিং-এ পরিবেশন করা হয় হরেক পদের খাবার। গোগ্রাসে সাবাড় করি বোনের হাতে রান্না করা যত সব ভিন্ন রকমের মজাদার খাবার, বোন আমার বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু তাবলিগী বরের বাটে পড়ে এখন সে পুরোদস্তুর রান্নার কারিগর। দুর্গাসাগর দীঘির বিভিন্ন স্থানে মাচা পাতা আছে। মাচায় বসে মাছ ধরা যায়। দীঘির মাঝে খানিক জায়গাজুড়ে রয়েছে একটি ছোট্ট দ্বীপ। বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে মাটির তৈরি হরিণ, বাঘ ইত্যাদি। চারপাশে নারকেল, মেহগনি, সুপারিসহ অন্যান্য গাছ রয়েছে। বছরের যেকোনো সময় দুর্গাসাগর দীঘি ভ্রমণে যেতে পারবেন তবে শীতকালে গেলে অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি অর্জন করতে পারবেন।
কিভাবে যাবেন: দেশের যেকোনো স্থান থেকে দুর্গাসাগর দীঘি দেখতে যেতে হলে জলপথে বা স্থলপথে বরিশাল শহরে যেতে হবে। বরিশাল থেকে যেতে হবে বানাড়িপাড়া নেছারাবাদে। এছাড়া বরিশাল থেকে সিএনজি, অটোরিকশা ভাড়া করে দুর্গাসাগর দীঘির সামনে পর্যন্ত যাওয়া যায়। বরিশাল থেকে বাসে চড়েও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন: দুর্গাসাগরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে সন্ধ্যায় চলে আসবেন বরিশাল শহরে। শহরে কম খরচে ভাল মানের বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে।
প্রায় দেড়’শ বছর আগে ইংরেজী ১৮৬১ সালে বর্তমান বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। নির্মাণের আলাদা বৈশিষ্টের কারণে এই মসজিটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের মে মাসে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। সংস্কার শেষে মসজিদটি পর্যটকসহ সবার প্রশংসা লাভ করেছে।
মসজিদটির গোড়ার কথাঃ পঞ্চদশ সালের গোড়ার কথা এতদ অঞ্চল ছিল মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমনে পর্যুদস্ত। আর এসব দস্যুদের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ। অতঃপর এদের দমনের উদ্দেশে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবেদার শায়েস্তা খানকে পাঠান। শায়েস্তা খান তার পুত্র উমেদ খান ও বিশাল রনতরী সৈন্য গোলাবারুদ নিয়ে জলদস্যু প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুরে কেল্লা তৈরী করা হল। স্থানীয়ভাবে যা সংগ্রাম কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। এই অভিযানে মো. হানিফ নেতৃত্ব দিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মগ-পর্তুগীজ-হার্ম্মাদরা বিতাড়িত হলেন। কিন্তু পারস্য বংশোদূত হানিফ খান এদেশে ভালোবেশে থেকে গেলেন। মো. হানিফের এক কন্যা সন্তান ছিল। মো. হানিফের ভ্রাতুষ্পুত্র, জামাতা এবং উত্তরাধিকারী শেখ মো. হাফিজ পরবর্তিকালে সংগ্রাম কেল্লা থেকে সামান্য পশ্চিমে উলানিয়া অঞ্চলে এসে বসবাস করেন। মো. হাফিজের পুত্র শেখ মোঃ সদরুদ্দিনের আমলেই মূলত উলানিয়া জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ৩ পুত্র ছিল। এরা হলেন- নয়া রাজা চৌধুরী, কালা রাজা চৌধুরী ও হাসান রাজা চৌধুরী। তাদের সময়েই বসত বাড়িটিকে উঁচু প্রাচীর ঘেড়া দুর্গের মত করে নির্মাণ করা হয়। এরপর বাড়ির প্রধান ফটকের পাশেই নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ। এটিই মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জামে মসজিদ নামে পরিচিত। ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠার পর মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার করা হলেও মূল অবয়ব এখনও অক্ষুন্ন রয়েছে। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ঠ এই মসজিদটি অনেকটা তাজমহল আকৃতির। মসজিদের সামনে বাধানো চওরা, পুকুর রয়েছে। মূল গৃহের আগে লোহার ৬ খামের ওপর প্রতিষ্ঠিত জাফরির কাজ রয়েছে। এখানে বীমের ছাদ রয়েছে। মসজিদের তিনটি দরজা। মসজিদের ভিতরে একসাথে শতাধিক মুসল্লি নামাজ পড়তে পারে। মসজিদের আর একটি বৈশিষ্ট রয়েছে, যা তাকে অন্য মসজিদের থেকে আলাদা করেছে। সেটি হলো মসজিদ গাত্রে শিলালিপি। এই মসজিদ গাত্রের পুরোনো শিলালিপীটি এখন আর নেই। তবে একই রকম শিলালিপী উৎকীর্ণ রয়েছে। মসজিদের বাহিরের গাত্রে চিনে মাটির টুকরা দিয়ে গড়া রয়েছে। মসজিদটি মূলত মোগলরীতিতে তৈরী। ভেতর ও বাহিরের গাত্রে জ্যামিতিক লতাপাতা ও ফলের নকশা রয়েছে। মসজিদে মূল নামাজ ঘরে ৩টি প্রবেশ পথ রয়েছে। ৩টি দরজার মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং এটির দুই পার্শ্বের দুই দেয়ালে নকশার নীচে উৎকীর্ণ শিলালিপি ছিল। ডানদিকের দেয়ালে উৎকীর্ণ কোরাআন শরীফের আয়াত ক্ষতিগ্রস্থ হলেও অধিকাংশ লেখা টিকে আছে। বা’দিকের দেয়ালে উৎকীর্র্ণ ছিল মসজিদ প্রতিষ্ঠা বিষয়ক বক্তব্য। এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগেই ফটোগ্রাফি করে রাখা হয়েছিল। অতঃপর এই ফটোগ্রাফি ব্যবহার করেই নতুন শিলালিপি খোদাই করে মসজিদের গাত্রে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
শিলালিপিতে ১০টি লাইন থাকলেও সবগুলো অক্ষুন্ন নেই। যেগুলো রয়েছে তার থেকে অর্থ করলে দাড়ায়- ১. প্রভু আল্লাহর ওপর ভরসা করো। ২. সর্পসংকুল চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণ পূর্বে প্রান্তে। ৩. শোকে পরিশুদ্ধ মানুষ। ৪. নামাজের জন্য রাজ্যে মসজিদ নির্মাণ করে। ৫. নয়া রাজা, কালা রাজা, হাসন রাজার বসতিতে। ৬. বারশ’ আটষট্টি সনে। ৭ৃৃৃ। ৮. নামাজ পড়া শুরু করল। ৯. মসজিদে। ১০..। ১৯৯৩ সালে প্রত্নতত্ব বিভাগ মসজিদটিকে সংরক্ষণযোগ্য ঘোষণা করেন। জমিদারীর পক্ষে আপনজন, কিছু সংস্কার করে। ২০০৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার হারুন অর রশিদ মসজিদ সংস্কারে ভুমিকা রাখেন। অতপর কুয়েত ভিত্তিক মসজিদে সাহায্য দানকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ার মো. এস কীওয়ান মসজিদটি সংস্কারের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে মসজিদের ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। সংস্কার শেষে মসজিদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সৌন্দয্য বহুগুনে বর্ধিত হয়। বর্তমানে মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক আসেন। মসজিদটি মেঘনা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। সরকার নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১১০ কোটি টাকা ব্যায়ে নদী ভাঙন রোধে কাজ করেছে। কিন্তু এতে কোন উপকার হয়নি। বরং নদী ভাঙন অব্যহত থাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদটি।
যাতায়াত: ঢাকার সদরঘাট হতে প্রতিদিন রাতে বেশ কয়েকটা সাধারণ মানের সহ বিলাস বহুল লঞ্চ ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশ্যে, এছাড়া সকালে ও দুপুরে লালকুঠি ঘাট হতে গ্রীণ লাইন ওয়াটার বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ডেকে ২০০/= টাকা হতে ফ্যামেলি কেবিন ৫,০০০-৬,৫০০/= টাকা এবং ওয়াটার বাসে ৮০০ ও ১,০০০/= টাকা। এছাড়া গাবতলী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হতে সড়ক পথেও বরিশাল যাওয়া যাবে। এসি ও নন এসি দু-ধরনেরই পরিবহন রয়েছে। ভাড়া ৪০০ টাকা হতে ৮৫০ টাকা। তবে সায়েদাবাদ কিংবা গুলিস্তান হতে খুব কম সময়ে সড়ক পথে বরিশাল যাওয়া যায়।
থাকা-খাওয়াঃ-ছোট্ট শহর বরিশাল ভ্রমণ করতে চাইলে রাতের লঞ্চে গিয়ে পরের দিন সারা দিন ঘুরে আবার রাতের লঞ্চেই ফিরতে পারেন আর রাত কাটাতে চাইলে শহরের সদর রোড ও পার্ক বেন্স রোডে তিন তারকা মানের সহ মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে এবং খাওয়ার জন্যও পাবেন বেশ কিছু রেষ্টুরেন্ট।