এম এম রহমাতুল্লাহঃ বালুর নরম বিছানা, সারি সারি ঝাউবন, সামনে বিশাল সমুদ্র, আবার রয়েছে পাহাড় ঘেরা হিমছড়ি ও ইনানী বিচ। কক্সবাজার গেলে সকালে-বিকেলে সমুদ্রতীরে বেড়াতে মন চাইবে। নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকতের নাম কক্সবাজার। অপরূপ সুন্দর বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যারা সপরিবারে বেড়াতে চান তাদের জন্যই এই প্রতিবেদন। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মাতার বাড়ি, শাহপরী, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজারকে করেছে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মাতা মুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়অ ও নাফ নদী। পর্যটন, বনজসম্পদ, মৎস্য, শুটকিমাছ, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকাসমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজারের অবস্থান তাই ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে সবার উপরে।
কক্সবাজার সম্পর্কিত কয়েকটি সাধারণ তথ্য
নামকরণঃ কক্সবাজারের আদি নাম পালংকী। কথিত আছে, ১৭৯৯ সালে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামের একজন এখানে এসে একটি বাজার স্থাপন করেন। আর তার নাম অনুসারে কক্স সাহেবের বাজার এবং পরে কক্সবাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কক্সবাজার নিয়ে এ লেখাটি আশা করি সকল ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অনেক কাজে লাগবে।
সীমানাঃ চট্টগ্রামে অবস্থিত এ জেলার মোট আয়তন ২৪৯১.৮৬ বর্গ কিলোমিটার। কক্সবাজারের উত্তরে চট্টগ্রাম, পূর্বে-বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও মিয়ানমার, পশ্চিম ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
নদীঃ মোট ৫টি নদী রয়েছে এ জেলাতে। এগুলো হলো- মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কোহালিয়া ও নাফনদী। দ্বীপঃ আমরা শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপে গেলেও এখানে আকর্ষণীয় ৫টি দ্বীপ রয়েছে। এগুলো হল- মহেশখালী, কুতুবদিয়া।
সমুদ্রে নামার আগে সতর্কতা ও অন্যান্য তথ্য: সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটার সময় জেনে নিন। এ সম্পর্কিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড ও পতাকা রয়েছে বিচের বিভিন্ন স্থানে। জোয়ারের সময় সমুদ্রে গোসলে নামা নিরাপদ। এ সময় তাই জোয়ারের সময় নির্দেশিত থাকে, পাশাপাশি সবুজ পতাকা ওড়ানো হয়।
ভাটার সময়ে সমুদ্রে স্নান বিপজ্জনক ভাটার টানে মুহূর্তেই হারিয়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই এ সময় বিচ এলাকায় ভাটার সময় লেখাসহ লাল পতাকা ওড়ানো থাকলে সমুদ্রে নামা থেকে বিরত থাকুন। কোনোভাবেই দূরে যাবেন না। প্রয়োজেন পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের সহায়তা নিন। ওদের জানিয়ে বিচে নামুন।
বিচ ফটোগ্রাফি: কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে শ দুয়েক বিচ ফটোগ্রাফার পর্যটকদের ছবি তুলে থাকে। প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এসব ছবি প্রিন্ট করে নেগেটিভসহ পর্যটকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা রয়েছে। লাল পোশাক পরা এসব বিচ ফটোগ্রাফারদের প্রত্যেকের রয়েছে একটি করে আইডি কার্ড। বেশ কয়েকটি স্টুডিও এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সরকারি রেট অনুযায়ী ফোরআর সাইজের ছবি ৩০ টাকা । এ সম্পর্কিত সাইনবোর্ড মেইন বিচে দেখতে পাওয়া যায়। এসব বিচ ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে ছবি তোলার আগে আইডি কার্ড দেখে নেওয়া ভালো।
স্পিডবোট: বিচে বেশ কয়েকটি স্পিডবোট চলে। মেইন বিচ থেকে এগুলো চলাচল করে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত। ভাড়া এক রাউন্ড ঋতু ভেদে ১০০-২০০ টাকা। এছাড়া খোলা স্পিডবোটের সাহায্যে চলে লাইফ বোট, জনপ্রতি ভাড়া ২৫০ টাকা।
বিচ বাইক: তিন চাকার বেশ কয়েকটি বিচে চলার উপযোগী বাইক কক্সবাজার সাগর সৈকতে চলাচল করে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে এসব বাইক রাউন্ড প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে পর্যটকদের প্রদান করতে হয়।
হিমছড়ি ও ইনানী বিচ ভ্রমণঃ কক্সবাজারের ১২ থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে রয়েছে দুটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। একটি হলো হিমছড়ি এবং অন্যটি হলো ইনানী। কক্সবাজার সমুদ্র থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে অন্যতম আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত ইনানী সমুদ্র সৈকত। আর এই সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার পথে মাত্র ১২ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে আরেক দর্শনীয় পর্যটন স্থান হিমছড়ি। কলাতলী থেকে জিপে চড়ে যেতে পারেন এ জায়গা দুটিতে। খুব সকালে গেলে জায়গা দুটি ঘুরে আবার দুপুরের মধ্যেই ফিরতে পারবেন কক্সবাজার শহরে। কক্সবাজার থেকে জিপে যেতে পারবেন এখানে। রিজার্ভ নিলে খরচ পড়বে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর লোকাল জিপে গেলে এ জায়গা দুটি ঘুরে আসতে জনপ্রতি খরচ হবে দুই আড়াইশ টাকা।
কক্সবাজার গেলে সমুদ্রের পাশাপাশি সময় করে অবশ্যই এগুলো দেখে আসবেন। যারা কক্সবাজার আগে অনেকবার গিয়েছেন কিন্তু সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি, তাদের জন্য এ তথ্যগুলো আফসোস বাড়িয়ে দিবে নিশ্চিত। আফসোস না করে নতুন করে আবার ভ্রমনের প্রস্তুতি নিন, আর চোখ খুলে দেখুন বাংলাদেশের সৌন্দর্য।
ডুলাহাজরা সাফারী পার্ক: চিটাগাং এর ফিরতি পথে দেখে এলাম ২,২২৪ একর এর জমির উপর তৈরি ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক। কক্সবাজার থেকে দেড় ঘণ্টার পথে চকোরিয়া উপজেলায় অবস্থিত (চিটাগং থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ) অতিমাত্রায় সুন্দর একটি জায়গা। এটি মূলত বিপন্ন প্রাণীদের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবেই তৈরি করা হই। ১৯৯৯ সালে এটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন হরিণ প্রজনন করা হয় এখানে। ভিতরে প্রবেশ এর পর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম,এমন সময় চোখ আটকে গেলো একটি হরিণ দেখে।কি সুন্দর!মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম,ভয় তো পেলোই না বরং আরো কিছুক্ষণ আমার সাথেই ঘুরলো। এটি যে প্রাণিদের অভয়ারণ্য বুঝতে দেরি হলো না।এখানে ভিতরে খাঁচার মতো করে কিছু ঘর বানানো,যেখানে বন্য প্রাণীরা বিশ্রাম নেয়। আর এই খাঁচার পিছনে রয়েছে গেট,যেটি দিয়ে এরা পিছনের বিশাল প্রান্তরে বিচরণ করে। দূরে কিছু পাহাড়ি হাতি দেখতে পেলাম। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে অবজার্ভেশন টাওয়ার এবং মিনিবাস রাইড। মিনিবাস এ করে পুরো এরিয়া ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন প্রাণির দেখা মিলে;যেমনঃ বাঘ,সিংহ,ভালুক,সাম্বা এবং চিত্রা হরিণ,গয়াল,ময়ূর,হাতি,কুমিরসহ আরো প্রাণি। এই পার্ক এ ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে আনা প্রাণিদেরও অভয়ারণ্য। এছাড়া এখানকার আরেকটি আকর্ষণ ভ্রমণকারিদের জন্যে ইনফরম্যাশন কেন্দ্রসহ ন্যাচারাল হিস্টোরি জাদুঘর। বিভিন্ন প্রাণীর কৃত্তিম মূর্তিও রয়েছে এখানে। ভ্রমণপিয়াসুদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এর মাঝে রেখে বন্য প্রাণিদের সান্নিধ্যে নিয়ে আসার উৎকৃষ্ট জায়গা এটি।
আজগবি মসজিদঃ আজগবি মসজিদটি শাহ সুজার আমলে তৈরি অর্থাৎ ১৬০০ – ১৭০০ খৃস্টাব্দে নির্মিত। স্থানীয়ভাবে এটি চৌধুরী পাড়া মসজিদ হিসেবেও পরিচিত। কক্সবাজার পৌরসভার বিজিবি ক্যাম্পের উত্তরদিকে অবস্থিত। কক্সবাজার পৌরসভার গেইট থেকে রিকশা কিংবা টমটম এ গেলে ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা।
প্যাগোড়া (জাদী): কক্সবাজারে রয়েছে অনেক প্যাগোড়া। পুরানো নিদর্শন হিসেবে এগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। রাখাইন সম্প্রদায় কর্তৃক কক্সবাজার সদর, রামু ও টেকনাফের পাহাড় বা উচুঁ টিলায় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এগুলো নির্মিত হয়। ১৭৯০ সালের দিকে বার্মিজরা আরাকান বিজয়ের পর এগুলো নির্মাণ করা হয়।
বৌদ্ধ ক্যাং: কক্সবাজারে ৭টিরও বেশি বৌদ্ধ ক্যাং রয়েছে। আগ্গা মেধা ক্যাং ও মাহাসিংদোগীক্যাং সবচেয়ে বড়। এসব জায়গাগুলোতে স্থাপিত বৌদ্ধ মূর্তিগুলো দেখার মত এবং ছবি ফ্রেমে বন্দী করে রাখারমত আকর্ষণীয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা ও বিষু উৎসব এসব জায়গাতে উদযাপন করা হয়। তাই এসময়গুলোতেই এখানে আসলে বেশি মজা পাবেন।
রামকোট তীর্থধাম: ৯০১ বাংলা সনে স্থাপিত এ তীর্থধামটি রামকোট বনাশ্রমের পার্শ্বের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। কথিত আছে রাম-সীতা বনবাসকালে এই রামকোটে অবস্থান করেছিলেন। তীর্থধামে মন্দিরের পাশাপাশি আলাদা একটি বৌদ্ধ বিহারে ধ্যানমগ্ন ছোট একটি বৌদ্ধমূর্তিও রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, দু’টি ধর্ম পাশাপাশি শান্তিতে সহাবস্থানের প্রমাণ স্বরূপ সম্রাট অশোকের সময়ে এই মূর্তি স্থাপিত হয়।
ছেংখাইব ক্যাং: কক্সবাজারে রামুর শ্রীকুলস্থ বাঁকখালী নদীর তীরে ছেংখাইব ক্যাং (বৌদ্ধ বিহার) অবস্থিত। এখানে অনেক শ্বেত পাথরের মূর্তি এবং নানা রকম নকশাখচিত আসন এবং বিভিন্ন পুরানো নিদর্শন রয়েছে। এ রামু থানাতে ২৩টি বৌদ্ধ বিহারে শতাধিক মূল্যবান বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
কানা রাজার সুড়ঙ্গ: শুধু হিন্দু কিংবা বৌদ্ধদের তীর্থস্থান না। এগুলো ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক পুরানো নিদর্শণ। উখিয়া থানার জালিয়া পালং ইউনিয়নে পাটুয়ার টেক সৈকতের কাছে নিদানিয়া পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে সুড়ঙ্গ বা গর্ত, যাকে কানা রাজার সুড়ঙ্গ বলা হয়। কথিত আছে, জনৈক মগ সম্প্রদায়ের এক চোখ অন্ধ এক রাজার শাসন আমলে আত্মরক্ষার জন্যেএই সুড়ঙ্গটি নির্মাণ করা হয়
মাথিনের কূপ: মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী মাথিনের কুপ। টেকনাফথানা প্রাঙ্গণে এ কূপের অবস্থান। এটিও একবার দেখে আসতে পারেন, সময় থাকলে। ১৯৯৪ সালে বাশের তৈরি এ কূপটি সংস্কার করা হয়। এ কূপের কাহিনী নিয়ে কিছুদিন আগে স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে
মা অষ্টভূজা: মহেশখালী আদিনাথ শিব মন্দিরের পার্শ্বে অষ্টভূজা নামে অপর একটি বিগ্রের মূর্তি রয়েছে। কক্সবাজার কস্তুরা ঘাট হতে নৌযানে ৪৫-৫৫ মিনিট আর স্পিডবোটে ১৫-১৮ মিনিট সময় লাগে। মহেশখালীর গোরকঘাটা জেটি হতে রিকশা যোগে আদিনাথ মন্দির যাওয়া যায়।
হিমছড়ি কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হিমছড়ি। কক্সবাজার থেকে সেখানে ৩ ভাবে যাওয়া যায়। খোলা জীপ, রিকশা কিংবা ব্যাটারী চালিত রিকশাতে করে সেখানে যাওয়া যাবে। খোলা জীপে গেলে জনপ্রতি ভাড়া ৫০-৭০ টাকা পড়বে। রিজার্ভ নিলে এটি পড়বে ১২০০ -১৫০০টাকা।রিকশা করে যেতে হলে ভাড়া লাগবে ১৫০-২৫০ টাকা। আর ব্যাটারি চালিত রিকশায় গেলে আসা যাওয়ার ভাড়া পড়বে ৪০০-৬০০টাকা। এখানে যাওয়ার পথে উপভোগ করতে পারবেন সৈকত লাগোয়া আকাশ ছোঁয়া পাহাড় ।
লাবণী পয়েন্টঃ কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী পয়েন্ট কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় আছে ছোট বড় অনেক দোকান যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।
যাতায়াত ও ভাড়া : যারা ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে চান তারা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার অথবা সরাসরি বাসে কক্সবাজারে যেতে পারেন। ঢাকার ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল সহ বেশ কয়েকটি স্থানে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এসি ও নন এসি, ডিলাক্স ও সাধারণ এসব সরাসরি বাস পরিবহনের ভাড়া পড়বে ৮০০-২৫০০ টাকা পর্যন্ত। সোহাগ, গ্রীন লাইন, সেন্টমার্টিন, সিল্ক লাইন, প্রেসিডেন্সী, ইউনিক, হানিফ, শ্যামলী, ঈগল ছাড়াও অন্যান্য পরিবহনের বাস চলাচল করে। এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কক্সবাজারে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ট্রেন বা বাস ছেড়ে যায়। তবে টিকেট বুকিং আগেভাগেই করে রাখা ভালো। স্বল্প সময়ে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য বিমানেও যেতে পারেন কক্সবাজার। একা হলে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরদের সাহায্যে গ্রুপ প্যাকেজেও কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন যেতে পারেন।
কক্সবাজারের আবাসিক ব্যবস্থা: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও দর্শনীয় বিচ কক্সবাজারে রয়েছে আন্তর্জাতিকমানের বেশ কয়েকটি হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। এছাড়া সরকারি ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ছোট বড় বিভিন্ন মানের অনেক রিসোর্ট, হোটেল ও বোর্ডিং হাউস। সর্বনিম্ন ৫০০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫,০০০ টাকায় কক্সবাজারে যাতযাপন করা যায়। হোটেল সীগাল, সায়মন বীচ, সী পার্ল, টিউলিপ, মারমেইড হোটেল ওসান প্যারাডাইস, হোটেল ওসান প্যালেস, হোটেল শৈবাল, হোটেল লাবণী, উইন্ডি ট্রেস, উপল, সি ক্রাউনের ভাড়া কক্ষ ভেদে ১০০০-১৫০০০ টাকা পর্যন্ত। জিয়া গেস্ট হলসহ অন্যান্য হোটেল রেস্টহাউসের ভাড়া প্রায়ই নির্ধারিত। তবে কক্সবাজার ভ্রমণের পূর্বে ফোনে যোগাযোগ করে বুকিংমানিং পাঠিয়ে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ভালো। সরাসরি গিয়েও কথা বলে রুম ভাড়া নেওয়া যায়।
খাওয়া দাওয়া ও রেস্টুরেন্ট: প্রায় প্রতিটি আবাসিক হোটেল বা হোটেলের সন্নিকটে রেস্টুরেন্ট বা খাবার হোটেল রয়েছে। কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ থাকে সাগরের বিভিন্ন মাছের মেন্যুর প্রতি। বিশেষ করে চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাইট্যা, ছুরি মাছসহ মজাদার শুটকি মাছের ভর্তার প্রতিই পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি থাকে। খাবারের মেন্যু অনুযায়ী একেক রেস্টুরেন্টে একেক ধরনের মূল্য তালিকা দেখা যায়। তবে বর্তমানে সরকার নির্ধারিত কিছু কিছু তালিকা ভোজন রসিকদের আশ্বস্ত করেছে। মোটামুটি ২০০-১০০০ টাকার মধ্যে সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী মজাদার খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। তবে খাবার গ্রহণের পূর্বে খাবারের নাম, মূল্য এবং তৈরির সময় সম্পর্কে জেনে নিন। প্রয়োজনে খাদ্যের তালিকা ও মূল্য টুকে রাখুন। তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে বিল প্রদান করতে পারেন।
সেন্টমার্টিন ও ছেড়াদ্বীপ: সেন্টমার্টিন একটি ছোট দ্বীপ যা বাংলাদেশের সীমানার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকনের ও ভ্রমণের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এটি বঙ্গোপসাগরের উওর-পূর্ব অংশে এবং টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আরবের কিছু নাবিক ২৫০ বৎসর পূর্বে এটি আবিস্কার করে। তারা এটিকে “জাজিরা” নামকরণ করেন। বৃটিশ শাসনের সময়কালে এটিকে পুনরায় “সেন্টমার্টিন” দ্বীপ নামে নামকরণ করা হয়। দ্বীপটির স্থানীয় নাম নারিকেল জিনজিরা। এটিই বাংলাদেশের একমাএ প্রবাল দ্বীপ। এর আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। এর জনসংখ্যা ১৭০০০ জন। সেন্টমার্টিনের ব্যাপ্তিতে ছেঁড়াদ্বিপ নামে একটি সংযোযিত অংশ রয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে এখানে পৌঁছাতে প্রায় ১২ ঘন্টা সময় লাগে। এ দ্বীপের বাসিন্দারা প্রাথমিকভাবে মাছ ধরাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখানকার লোকদের প্রধানতম শস্য হল ধান এবং নারিকেল। এখানে প্রচুর পরিমাণে শেওলা পাওয়া যায়। এগুলিকে শুকিয়ে সংগ্রহ করে মায়ানমারে পাঠানো হয়। অক্টোবর এবং এপ্রিল মাসে পার্শ্ববর্তী এলাকার জেলেরা দ্বীপের অস্থায়ী মার্কেটগুলোতে তাদের ধরা মাছগুলোকে বিক্রি করার উদ্দেশ্য নিয়ে সমবেত হয়। দ্বীপের মধ্য ও দক্ষিণের এলাকা মূলত কৃষিজমির অন্তর্গত। এখানে অধিকাংশ খাবার বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্য-ভূখন্ড থেকে রপ্তানি করা হয়। যোগাযোগ, আশ্রয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সরবরাহ না থাকায় এবং বাংলাদেশের মূল-ভূখন্ড থেকে বেশ দূরে অবস্থানের দরুণ বর্ষাকালে এখানকার জনগনের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। এই দ্বীপে ভ্রমনের একমাএ উপায় হল নৌপথ। ১৯৯৯ সালের হারিকেনের পর থেকে এ দ্বীপে বিদ্যুতের সমাপ্তি ঘটে। বড় বড় হোটেলগুলোতে জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে। দ্বীপটি সূর্য, সমুদ্র এবং পাম গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত। সকাল বেলায় সূর্য উদয় এবং সন্ধায় সূর্যাস্তের অপরুপ দৃশ্য দ্বীপের লোকালয়ে প্রাণ ফিরিয়ে আনে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য এখানে ৫ টি শিপিং লাইন্স (শহিদ শের নিয়াবাদ, এল সি টি কুতুবদিয়া, ঈগল, কেয়ারী ক্রুজ, ডাইন এবং কেয়ারী সিনবাদ) চালু করা হয়েছে। ভ্রমণকারীরা চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে তাদের ট্রিপ বুক করতে পারেন। এ দ্বীপের সাথে জড়িয়ে দ্বীপের একটি সংযোযিত অংশ রয়েছে যার নাম ছেঁড়াদ্বিপ। ছেঁড়াদ্বিপে কোন লোকজন বসবাস করে না। তাই ভ্রমনকারীদের খুব সকালে এখানে যাএা করতে হয় যাতে করে সন্ধা হবার পূর্বেই তার হোটেলে ফিরে আসতে পারে। গত কয়েক বছরের মধ্যে সেন্টমার্টিনের পরিদর্শক জনসংখ্যা নাটকীয় ভাবে বেড়ে গেছে। সেই সুবাদে এটা এখানকার জনগনের জন্য লাভজনক প্রমানিত হচ্ছে। এখানকার সামুদ্রিক প্রবাল ও কচ্ছপের সংরক্ষণে ব্যপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। দ্বীপটিতে অবৈধ্যভাবে প্রবাল প্রাচীর দর্শকদের কাছে বিক্রি, মোটর চালিত নৌকা এবং মাছধরা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পায়ে হেটে এ দ্বীপটিকে একদিনে অতিক্রম করা সম্বব। কেননা এর আয়তন মাত্র ৮বর্গ কিলোমিটার (উচ্চ জোয়ারের সময় ২ বর্গ মাইল)। দ্বীপটি তার প্রবাল প্রাচীরের জন্য টিকে আছে। এটি ক্ষয় হতে থাকলে দ্বিপটি পানিতে ডুবে যাবার সম্ভাবনা আছে। দুঃখজনক ভাবে সেন্টমাটিন গত ৭ বছরের মধ্যে তার মোট প্রবালের ২৫% হারিয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় ৮৫০০ লোক মাছ ধরার পেশায় নিয়জিত। সেন্টমার্টিনে আপনি সবচেয়ে ভাল জলবায়ু এবং আবহাওয়া পাবেন নভেম্বর ও ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এটিই এখানকার প্রধান পর্যটন ঋতু। মার্চ ও জুলাই মাসের পর্যটকদের অবশ্যই আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কেননা ঘূর্ণিঝড় এই সময়ে এখানে বারবার আঘাত করে। ১৯৯১ সালের ঘূণিঝড়ে এই দ্বীপটি সম্পুর্ণরূপে বিদ্ধস্ত হয়েছিল, কিন্তু পুনরায় উদ্ধার হয়েছে এবং ২০০৪ সালের সুনামির পরও এটি অক্ষত আছে। কক্সবাজার থেকে লোকাল বাস বা জীপে করে টেকনাফ গিয়ে সেখান থেকে সচরাচর চলাচলকারী জাহাজ সি-ট্রাক বা ট্রলারেও সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। টেকনাফ যেতে সময় লাগে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা এবং সেখান থেকে সমুদ্র পথে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। ছেড়া দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত নয়নাভিরাম একটি দ্বীপ। সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলারে ৪০ মিনিটে এবং ভাটার সময় পায়ে হেঁটেও ছেড়া দ্বীপ যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা।