হিমালয় রিপোর্টঃ সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হয়ে আছে বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যানগুলো। যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত জাতীয় উদ্যান কেবল ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, তবুও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আরও বহু উদ্যানকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। গাজীপুর জেলার সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় এ উদ্যানের বিস্তৃত। জয়দেবপুর চৌরাস্তা ছাড়িয়ে ময়নসিংহের দিকে কিছু দূর যেতে হাতের ডানে উদ্যানের বেশ কয়েকটি প্রবেশপথ আছে।
বেশ কয়েকটি প্রবেশপথ থাকলেও হাতের ডানের একটি প্রবেশপথ সবারই নজর কাড়ে। টেরাকোটায় মোড়া বর্ণিল ফটকের দুই পাশে দুই দণ্ডায়মান হাতি— এটিই ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের প্রধান ফটক।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান মূলত ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমি। গাছে গাছে ঢাকা এই উদ্যানের প্রতিটি জায়গাই নজর কাড়া। সাড়ি সাড়ি বৃক্ষের মাঝে পায়ে চলা পথ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্য আছে আসন কিংবা ছাউনি। বনের মাঝে কোথাও কোথাও চোখে পড়বে ধানের ক্ষেত। কোথাও আবার পুকুর কিংবা লেক।
এছাড়া ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতরে আছে ১৯টি বিশ্রামাগার ও কটেজ। এগুলোর নামও বেশ মজার। চম্পা, জেসমিন, অর্কিড, রজনীগন্ধা, শাপলা, মালঞ্চ, গোলাপ, মাধবী, বকুল, জুঁই, চামেলী, বেলি, আনন্দ-১, আনন্দ-২, আনন্দ -৩, শ্রান্তি ও কেয়া।
এছাড়া বনের ভেতরে আছে ৩১টি বনভোজন কেন্দ্র। এগুলো হল:
সোনালু, পলাশ, কাঞ্চন, মহুয়া, শিমুল-১, শিমুল-২, শিউলি-১, শিউলী-২, নিরিবিলি-১, নিরিবিলি-২, নিরিবিলি-৩, নিরিবিলি-৪, বনশ্রী-১, বনশ্রী-২, বনশ্রী-৩, বনশ্রী-৪, বনরূপা-১, বনরূপা-২, বনরূপা-৩, কদম, অবকাশ-১, অবকাশ-২, অবকাশ-৩, অবকাশ-৪, অবকাশ-৫, অবকাশ-৬, অবকাশ-৭, অবকাশ-৮, অবকাশ-৯, অবকাশ-১০ ও আনন্দ।
নামের ভিন্নতার সঙ্গে এগুলোর পরিবেশও ভিন্ন আমেজের। পিকনিক স্পট কিংবা কটেজ ব্যবহার করতে হলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় (০২-৯৮৯৯৪৯৭) থেকে আগাম বুকিং দিতে হবে।
একসময় ভাওয়াল উদ্যানে পাওয়া যেত ব্ল্যাক প্যান্থার, চিতা বাঘ, ময়ূর, হাতি। এসব এখন ইতিহাস। ক্রমাগত বন উজাড়ের ফলে দিনে দিনে এর পরিধি কমে আসায় বন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে নানান বন্যপ্রাণী। তবে বাংলাদেশ সরকার এই বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয় উদ্যানের আদলে ৫০২২ হেক্টর জমিতে ১৯৭৩-৭৪ সালে এই উদ্যান সরকারীভাবে গড়ে তোলা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮২ সালে।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মূল উদ্ভিদ হল শাল। প্রায় ২২০ প্রজাতির গাছপালা আছে এই বনে। এর মধ্যে ৪৩ প্রজাতির বিভিন্ন রকম গাছ, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, তিন প্রজাতির পাম, ২৭ প্রজাতির ঘাস, ২৪ প্রজাতির লতা, ১০৪ প্রজাতির ঔষধি গাছ। জীব বৈচিত্র্যেও কমতি নেই এই বনে। প্রায় ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, নয় প্রজাতির সরীসৃপ, পাঁচ প্রজাতির পাখি ও পাঁচ প্রজাতির উভচর প্রাণীও রয়েছে এই বনে।
কীভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী যে কোনো বাসে চড়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ফটকের সামনেই নামা যায়। এছাড়া ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস চলে এই পথে। ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
নিজস্ব বাহনে গেলে জয়দেবপুর চৌরাস্তা ছাড়িয়ে ময়মনসিংহের দিকে কিছু দূর চলতে হাতের ডানে পড়বে এর প্রধান প্রবেশপথ।
খরচপাতিঃ ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা। গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে নির্দিষ্ট হারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। দোতলা বাস ৪শ’ টাকা, বাস ২শ’ টাকা, মাইক্রোবাস ১শ’ টাকা, প্রাইভেট কার ৬০ টাকা, অটো-রিকশা ২০ টাকা।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে বাসা তৈরিতে ব্যস্ত কালো মাথা বেনে বৌ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন। এছাড়া বনের ভেতরের ওয়াচ টাওয়ার কিংবা শিশুপার্ক ব্যবহারে জনপ্রতি লাগবে দুই টাকা।
প্রয়োজনীয় তথ্যঃ ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে। ভ্রমণের সময়ে উদ্যানের ভেতরে মাইক, কিংবা উচ্চ শব্দ তৈরি করা কোনো যন্ত্র বাজানো নিষেধ। এছাড়া বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো আচরণ করাও নিষেধ।
বনের ভেতরে পাখি শিকার কিংবা লেকে মাছ ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। বনের ভেতরে কিছু এলাকা বেশ নির্জন। এসব যায়গায় যাওয়া বিপজ্জনক।