এম এম এমদাদুল হক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশগুলির মধ্যে একটি। প্রতিবছর দেশটিতে বিপুল পরিমান পর্যটক আসে দেশটির বিভিন্ন দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থানগুলো ভ্রমন করতে। নিউইয়র্ক ও শিকাগোর সুউচ্চ অট্টালিকা থেকে শুরু করে আলাস্কার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইয়োলোস্টোন কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ার, ফ্লোরিডা এবং হাওয়াইের সুদৃশ্য সৈকত – সবই আমেরিকান এবং আমেরিকায় আগত টুরিস্টদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। আর আমেরিকার এতো এতো আকর্ষণীয় স্থান থেকে বাছাই করে সবচেয়ে সেরা কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান নিয়ে আমাদের এ সংখ্যার আয়োজন। দেখে নেয়া যাক, আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলো কইয়েকটি:
১. গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন: আমেরিকার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (Grand Canyon)। আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যেের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন পৃথিবীর ২০০ কোটি বছরের এক নীরব সাক্ষী। এর অধিকাংশ এলাকা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই অবস্থিত। এই গিরিখাতটি দৈর্ঘ্যে ২৭৭ মাইল এবং প্রস্থে সর্বোচ্চ ১৮ মাইল এবং গভীরতায় প্রায় ১৮০০ মিটার। অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে এনে দিয়েছে আমেরিকায় আগত পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের খ্যাতি। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী ছুটে আসেন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বাহারি রংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হলো সূর্যোদয় দেখা।
২. ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যান: আমেরিকান টুরিস্টদের কাছে অন্যতম হল ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক (Yellowstone National Park)। এটি বিশ্বের বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক। পার্কের ভিতরে রয়েছে পর্বতমালা, সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, উপ আ্যলপাইন অরণ্য, গিরিখাত, নদী ও হ্রদ। এটি ১৮৭২ সালের ১লা মার্চ রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস এস. গ্র্যান্টের সাক্ষরানুক্রমে মার্কিন কংগ্রেস একটি আইন পাস করে স্থাপিত হয়েছিলো। পার্কটি মূলত ওয়াইওমিং রাজ্যে অবস্থিত হলেও মন্টানা ও আইডাহো রাজ্যেও এর কিছু অংশ রয়েছে৷ জীববৈচিত্র্য ও জিওথার্মাল বৈশিষ্ট্যের জন্য পার্কটি খুবই বিখ্যাত। পার্কটিতে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীরও দেখা মিলে; যার মধ্যে রয়েছে ইয়েলোস্টোন পার্ক বাইসন, কালো ভাল্লুক, নেকড়ে, প্রোঙ্গহর্ন অ্যান্টিলোপ (এক ধরণের হরিণ), বড় শিংওয়ালা ভেড়া, মেঠো কাঠবিড়ালি, পালকহীন ঈগল, লাল শিয়াল, ছাই বর্ণের ঘুঘু ইত্যাদি।
৩. ম্যানহাটন: আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যানহাটন (Manhattan)। ম্যানহাটন আমেরিকার বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির ৫ টি বরো বা কাউন্টির মধ্যে ক্ষুদ্রতম। ম্যানহাটনই মূলত নিউইয়র্ক শহরের প্রাণ। নিউইয়র্ক সিটির কথা চিন্তা করলেই আমাদের মনের মধ্যে ভেসে উঠে ম্যানহাটনের গগনচুম্বী সব দালান বা স্কাইস্ক্রাপারের চিত্র। আকাশ ছোয়া এসব দালানের চিত্র আমরা হাজার বার এরও বেশি দেখেছি টিভির পর্দায়। এখানের গগনচুম্বী দালানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এম্পায়ার স্টেট, ক্রিস্লার এবং সিটিকর্প সেন্টার। আর ১০১ তলা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার যুগলের অবস্থানও ছিল এই ম্যানহাটন দ্বীপেই।
৪. নায়াগ্রা জলপ্রপাত: আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানের ৪র্থ স্থানে রয়েছে প্রকৃতির অপার বিস্ময় – নায়াগ্রা জলপ্রপাত (Niagara Falls)। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত এটি।১৬৭ ফুট উঁচু এই জলপ্রপাত থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৬৪ হাজার ৭৫০ ঘনফুট পানি নদীতে আছড়ে পড়ে। জলপ্রপাতটি আমেরিকার নিউইয়র্ক এবং কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সীমানার ওপর অবস্থিত। ভ্রমণ পিপাসু সকল প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি একটি রোমাঞ্চকর স্থান। তবে আমেরিকাতে জলপ্রপাতটি পিছন থেকে দেখতে হলেও কানাডাতে সরাসরি সামনে থেকেই দেখা যায় ফলে সম্পূর্ণ জলপ্রপাত ভালোমত দেখা যায়। এখানে মুগ্ধ পর্যটকদের খুব কাছেই জলপ্রপাতের জলরাশিতেই রংধনু এসে ধরা দেয়। আমেরিকাতে প্রতি বছরে ১৪ মিলিয়নেরও বেশি পর্যটক আসে প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে।
৫. লাস ভেগাস স্ট্রিপ: লাস ভেগাস স্ট্রিপ (Las Vegas Strip) বিশ্বের গ্যাম্বলিং রাজধানী হিসেবে খ্যাত, লাস ভেগাস আমেরিকার দক্ষিণ নেভাদা মরুভূমিতে অবস্থিত। লাস ভেগাস শহরের যে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বড় বড় হোটেল, জুয়া খেলার আখড়া বা ক্যাসিনো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে জায়গাটুকুকে বলা হয় লাস ভেগাস স্ট্রিপ। লাস ভেগাসের ৫ তারকা বা ৭ তারকা হোটেলগুলো নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন থিমকে ঘিরে। যেমন – কোনটা প্যারিস, কোনটা আলাদীন, কোনটা ট্রেজার আইল্যান্ড, কোনটা সিজার সম্রাট, গ্রীস, আফ্রিকা, মিশরের ফারাও রাজাদের কেন্দ্র করে নির্মিত। তবে, শুধু হোটেল বা ক্যাসিনো নয়, এই শহরের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সুপার মার্কেট, গ্যাস স্টেশন, সুপার মার্কেট, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সব জায়গাতেই সাজানো থাকে জুয়া খেলার স্লট মেশিন।
৬. গোল্ডেন গেট ব্রিজঃ সানফ্রান্সিসকো ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গোল্ডেন গেট ব্রিজকে বোঝানো হয়। সারা দুনিয়ায় যা সোনালি দুয়ার নামে পরিচিত। ১৯১৬ সালে ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যস্ততায় এ সেতুটির প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ৫ জানুয়ারি। প্রায় বাইশ বছর ধরে এর নির্মাণ কাজ চলে। শেষ হয় ১৯৩৭ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট উদ্বোধন করেন সেতুটি। একই বছর ২৭ মে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ২৭ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার, যার দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৭ কিলোমিটার আর প্রস্থ ২৭ দশমিক ৪০ মিটার (৯০ ফুট)। লেন আছে ছয়টি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এ সেতু দিয়ে প্রতিদিন ১ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। আঠারো শতকের পরবর্তী সময়েও গোল্ডেন গেট পার হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ফেরি বা নিজস্ব নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা। তারপর থেকে সানফ্রান্সিসকোর সঙ্গে মেরিন কান্ট্রির যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এই আশ্চর্য ব্রিজটা ব্যবহার শুরু হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিভিন্ন জরিপের ফল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে আত্মহত্যার স্থান হিসেবে এক নম্বর স্থানটি দখল করে আছে সানফ্রান্সিসকোর ঝুলন্ত এ সেতুটি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মতে, আধুনিক বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো গোল্ডেন গেট ব্রিজ। এ ব্রিজটি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করে এখানে।
৭. হোয়াইট হাউসঃ প্রায় সবার জানা যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক বাসভবনের নাম হোয়াইট হাউস। কিন্তু জানেন কি, এই প্রাসাদের নাম শুরুতে হোয়াইট হাউস ছিল না। এমনকি শুরুতে এর রঙও ছিল ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন কখনোই হোয়াইট হাউসে থাকার সুযোগ পাননি। অথচ ১৭৯১ সালে তিনিই হোয়াইট হাউসের মূল নকশা অনুমোদন করেন। ১৭৯২ সালের অক্টোবরে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৭৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের মেয়াদ শেষ হয়। তিনি মারা যান ১৭৯৯ সালে। ১৮০০ সালে হোয়াইট হাউসের নির্মাণ কাজ মোটামুটি শেষ পর্যায়ে থাকার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস সপরিবারে এতে বসবাস শুরু করেন। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা হোয়াইট হাউসে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনে ভবনের অভ্যন্তরের অংশ ও ছাদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এর পুনর্নির্মাণ আরম্ভ হয়। ১৯০১ সালের আগ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের কোনো দাপ্তরিক নাম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। সাধারণত এক্সিকিউটিভ ম্যানশন এবং প্রেসিডেন্ট প্যালেস নামে ডাকা হতো। ১৯০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউস নামকরণ করেন। প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান হোয়াইট হাউসের নাম দিয়েছিলেন ‘ঝলমলে বন্দিশালা’। আরেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এ ভবনকে আট তারকা হোটেলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। হোয়াইট হাউসের প্রধান বাসিন্দা মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবার। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তারা এখানে বিনামূল্যে খাবার পান না। তাদের খাবারের বিল মাস শেষে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি টুথপেস্ট কেনা, কাপড় ইস্ত্রি করা ইত্যাদির খরচও নিজেদের বহন করতে হয়। নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে ১৯১৭ সালের জানুয়ারিতে একদল নারী হোয়াইট হাউসের গেটের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা টানা দুই বছর সেখানে অবস্থান করে। অবশেষে ১৯১৯ সালের ৪ জুন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নারীদের ভোটাধিকার দেয়। হোয়াইট হাউস নিয়ে কিছু ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একবার হোয়াইট হাউসের লিংকন বেডরুমে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের নগ্ন ভূত দেখতে পেয়েছিলেন। পরদিন তিনি দ্বিতীয়বার ওই রুমে থাকতে অস্বীকার করেন। হোয়াইট হাউসের কর্মীদের ‘বদৌলতে’ এ গল্পের আরও অনেক শাখা-উপশাখা শুনতে পাওয়া যায়। হোয়াইট হাউস রঙ করতে ৫৭০ গ্যালন সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। হোয়াইট হাউসে তিন হাজারেরও বেশি লোক পূর্ণকালীন চাকরি করেন। হোয়াইট হাউস নির্মাণে সেসময় ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ৩২ হাজার ৩৭২ ডলার। আর বর্তমানে এ ভবনের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশী মূদ্রায় তিন হাজার কোটি টাকা)।