উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

বিজ্ঞাপন কি? সময়ের সঙ্গে কৌশলে ভিন্নতা

পত্রিকা পড়ছেন, টিভি দেখছেন, বা ইন্টারনেটে কোনো ওয়েবসাইট ঘাঁটছেন- মূল আধেয় বা কনটেন্টের সঙ্গে যে জিনিসটা ভাতের সঙ্গে তরকারির মতো থাকবেই, তা হলো বিজ্ঞাপন।

শুধু গণমাধ্যমেই নয়; রাস্তায় হাঁটতে চলতেও ব্যানার-বিলবোর্ডসহ নানা আকারের বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে থাকি। রোজ এত বেশি বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে যে, টিভি চ্যানেলে নাটক-সিনেমা বা সংবাদ বুলেটিনের মাঝে ঘন ঘন বিজ্ঞাপন না দেখলে বা পত্রিকা-ওয়েবসাইটে কম বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে আমরা অবাকই হয়ে যাই।

কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের উৎপত্তি আসলে কীভাবে? অতীতে বিজ্ঞাপন কেমন ছিল? কীভাবে তা বর্তমান রূপ পেয়েছে? এর ভবিষ্যৎই বা কী?

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন (Advertising) হচ্ছে একটি মার্কেটিং বা বিপণন কৌশল, যার মাধ্যমে যে কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনের তথ্যগুলোই হয় এমন, যাতে গ্রাহক আকৃষ্ট হতে পারেন।

বিজ্ঞাপনের লক্ষ্যই হলো এমন ব্যক্তিদের কাছে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য পৌঁছানো, যার ফলে সম্ভাব্য গ্রাহক শ্রেণি তৈরি হয়। বিজ্ঞাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য সেই পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জানিয়ে গ্রাহকের চাহিদাকে বাড়িয়ে দেয়া যেন আগে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, বিজ্ঞাপনটির মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি সেটি কেনার প্রয়োজন বোধ করেন।

সোজা ভাষায় বললে: বিজ্ঞাপন হচ্ছে ব্যবসায়িক এবং বিপণনের উদ্দেশে কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য তার সম্ভাব্য ভোক্তার কাছে পৌঁছানো।

আবির্ভাব ও বিবর্তন
বিজ্ঞাপনের ইতিহাসের সূত্র বাঁধা অতিপ্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে। বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞাপন কোন দেশে তৈরি হয়েছিল, এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। তবে ধারণা করা হয় এর উৎপত্তি মিশরে।

প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাসে তৈরি কাগজে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির বার্তা লিখে দেয়ালে লাগানোর পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাচীন পম্পেই নগরী ও আরব সভ্যতার ধ্বংসস্তুপেও বাণিজ্যিক বার্তা এবং রাজনৈতিক প্রচারবার্তা লেখা লিপি পাওয়া গেছে।

‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ অর্থাৎ ‘হারিয়েছে’ ও ‘পাওয়া গেছে’ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রাচীন গ্রিস ও রোমে অহরহ দেখা যেত।

দেয়াল বা পাথরে আঁকার মধ্য দিয়েও প্রাচীন যুগে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বা রাজনৈতিক প্রচারণার কাজ করা হতো, যা এখনও এশিয়া, আফ্রিকা এবং সাউথ আমেরিকায় দেখা যায়। প্রস্তরলিপি ও প্রস্তরচিত্রের এই ঐতিহ্যের প্রমাণ খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে ইন্ডিয়ান রক আর্ট পেইন্টিংয়ের মধ্যে দেখা গেছে।

এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-প্রমাণ অনুসারে, প্রাচীন চীনের সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনগুলো ছিল মৌখিক। একাদশ থেকে সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ের চীনা গান-কবিতা নিয়ে লেখা ‘ক্লাসিক অব পোয়েট্রি’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ওই সময়টায় বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে ক্যান্ডি বিক্রি করা হতো।

প্রথমদিকে মূলত ক্যালিগ্রাফিক সাইনবোর্ড এবং কাগজে কালি দিয়ে লেখার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কাজ সারা হতো। তবে পুরাতত্ত্ববিদরা চীনের সং সাম্রাজ্যের (৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলের একটি তামা ও ব্রোঞ্জের পাত পেয়েছেন। সেটি একটি বিজ্ঞাপনের প্রিন্টিং প্লেট। প্লেটটি দিয়ে চারকোনা কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো।

প্লেটটির এক অংশে লেখা ‘জিনান লিউয়ের সূক্ষ্ম সূঁচ বিপণী’। অন্য অংশে লেখা ‘আমরা উন্নত মানের ইস্পাতের রড কিনি এবং সূক্ষ্ম সুঁই তৈরি করে থাকি, যেন তা ঘরে যখন তখন ব্যবহার করা যায়’। প্লেটটির ওপরের দিকে একটি খরগোশের লোগোও রয়েছে।

চীনের সেই প্রিন্টিং প্লেট

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনের মুদ্রণ মাধ্যম।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে শহর-নগর বড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানকার সাধারণ জনগণ ছিল নিরক্ষর। তাই লিখিত বিজ্ঞাপনের বদলে সেখানে শুরু হলো ছবি বা প্রতীকের প্রচলন। যেমন, মুচি, দর্জি বা কামারের দোকানের পরিচিতি দিতে শব্দগুলো লেখার বদলে সাইনবোর্ডে জুতো, জামা, টুপি ও ঘোড়ার নালের ছবি রাখা হতো।

আবার শহরের মাঝখানে মুদি সরঞ্জাম বিক্রির সময় দোকানদাররা আলাদা লোকই (Street criers) রাখত, যারা চিৎকার আর হাঁকডাক করে পণ্যের গুণাগুণ সবাইকে জানিয়ে দিত। এর প্রথম নথিবদ্ধ নমুনা সংকলন পাওয়া গেছে ত্রয়োদশ শতকে গুইলম দ্য লা ভিলেনুভে রচিত ‘লেস ক্রিয়েরিয়েস দ্য প্যারি’ (Street Cries of Paris) কবিতায়।

ট্রেডমার্ক
প্রায় ৪ হাজার বছর আগেই ট্রেডমার্ক বা সিলের ব্যবহার ছিল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ওই সময়ে উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের সঙ্গে পাথরের একটি সরল নকশার সিল লাগিয়ে দিতেন। সময়ের সাথে সাথে সেটি কাদামাটি বা পোড়ামাটির সিলে পরিণত হয়েছে, যেখানে ছাপার মাধ্যমে ছবি যোগ করা হয়ে থাকে।

ভারতে ১৩শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন ধরনের সিলের নমুনা পাওয়া গেছে, যেখানে প্রস্তুতকারীর শনাক্তকারী চিহ্ন যোগ করা হতো।

মধ্যযুগ থেকে উন্নত মানের পণ্য চিহ্নিত করার জন্য সরকারিভাবে বিশেষ সিল বা চিহ্নের ব্যবহার প্রচলন শুরু হয় (যেমন বাংলাদেশ বিএসটিআই’র লোগো)।

টাউন ক্রাইয়ার
এদের কথা ওপরেই বলা হয়েছে। প্রথম দিকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা বা প্রয়োজনীয় সংবাদ চিৎকার করে নিরক্ষর জনগণকে জানানোর জন্য কিছু মানুষকে রাখা হতো। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসায়ীরাও এই লোকদের ভাড়া করে নিজেদের পণ্যের প্রচার শুরু করে। অনেকে নিজেই চিৎকার করে নিজের পণ্যের গুণাগুণ প্রচার করে গাড়িতে করে সেগুলো বিক্রি করতে থাকে। এখান থেকেই ‘হকার’ ধারণাটির উৎপত্তি।

সাইনবোর্ড
পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বে সাইনবোর্ডের প্রচলন হয়েছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। একের সঙ্গে অন্যের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন মিশরীয়, রোমান এবং গ্রিকরা দোকানের বাইরে সাইনবোর্ড ঝুলানো কাজটি শুরু করে ঝুলিয়ে রাখত। এছাড়াও হাটবারসহ বিভিন্ন বড় আয়োজন সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য এ ধরনের সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হতো।


লন্ডনের একটি পুরনো পাবের সামনে ঝুলানো সাইন

চীনেও প্রাচীনকালে উন্নত মানের সাইনবোর্ড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মধ্যযুগীয় ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের অধিকাংশ এলাকায় সরাইখানার সামনে সাইনবোর্ড বা সাইনেজ টাঙানো বাধ্যতামূলক ছিল। মধ্যযুগ জুড়ে বাণিজ্যিক কাজে সাইনবোর্ড জাতীয় বিজ্ঞাপনের ব্যবহার ব্যাপক প্রসার পায়।

জাপানে ইদো বা টকুগাওয়া যুগে ১৮০৬ সালে প্রকাশিত একটি ফ্লাইয়ার জাতীয় বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। সেখানে ‘কিনসেইতান’ নামক ঐতিহ্যবাহী একটি ওষুধের গুণাগুণ বর্ণনা করে তা কিনতে বলা হয়েছে।


জাপানের ‘কিনসেইতান’ ওষুধের ফ্লাইয়ার

আধুনিক বিজ্ঞাপন শুরু
আধুনিক বিজ্ঞাপন তার রূপ পেতে শুরু করে ১৬ ও ১৭ শতকে পত্রিকা-ম্যাগাজিনের উন্নয়নের সাথে সাথে। ভেনিসেই প্রথম ১৬ শতকের প্রথমদিকে সাপ্তাহিক গেজেট প্রকাশ হওয়া শুরু হয়। সেখান থেকে সাপ্তাহিক প্রকাশনার ধারণা ছড়িয়ে পড়ে ইতালি জার্মানি এবং হল্যান্ডে।

ব্রিটেনে প্রথম সাপ্তাহিক প্রকাশনা ১৬২০’র দশকে চালু হয়। আর প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি কুর‌্যান্ট’ ১৭০২ থেকে ১৭৩৫ সাল পর্যন্ত ছাপা হতো। মুদ্রণ ও সরবরাহের খরচ বহনের জন্য প্রকাশনার প্রায় গোড়া থেকেই পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন ছাপানো শুরু হয়।


প্রথম দিকের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলো ছিল বই এবং ঘরোয়া ওষুধের। কিন্তু ১৬৫০’র দশকে নানাবিধ পণ্যের বিজ্ঞাপন লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায়।

মুদ্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ব্যবসায়ীরা হ্যান্ডবিল এবং ট্রেড কার্ড ছাপানো শুরু করেন। যেমন ১৬৭০’র দশকে লন্ডনে জনাথন হোল্ডার নামের এক খুচরা ব্যবসায়ী তার পণ্যের তালিকা ও মূল্য সংযোজন করে হ্যান্ডবিল তৈরি করে প্রত্যেক ক্রেতাকে বিতরণ করতে থাকেন। ওই সময়ে হোল্ডারের এই পরিকল্পনাকে তার ব্যবসার জন্য ‘বিপদজনক একটি চেষ্টা’ এবং ‘অহেতুক খরচ’ বলে মনে করা হতো।


১৬৭৪ সালে ছাপানো এই ট্রেড কার্ডটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ট্রেড কার্ডের অন্যতম মনে করা হয়

একেবারে প্রথম দিকের ট্রেড কার্ডগুলো মোটেও কার্ড ছিল না। আদতে সেগুলো ছিল সাধারণ কাগজে মুদ্রিত বক্তব্য, তাও আবার কোন ছবি ছাড়া। ১৮ শতকের দিকে অবশেষে কার্ড জাতীয় মোটা কাগজে ছাপা শুরু হতে থাকে ট্রেড কার্ড, যেখানে ব্যবসায়ীর নাম ঠিকানাসহ উল্লেখ থাকত। বিবর্তনের ধারায় সেগুলোই বিজনেস কার্ড বা ভিজিটিং কার্ডের রূপ নিয়েছে।


বিজ্ঞাপনের উৎপত্তির মূল লক্ষ্যই ছিল কোনো পণ্য বা সেবা বা ধারণার বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। কালের বিবর্তনে এই মূল লক্ষ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে উদ্দেশ্যের মাঝে বৈচিত্র্য এসেছে। বিজ্ঞাপনের কৌশলে এসেছে ভিন্নতা।

আর এসব পরিবর্তিত উদ্দেশ্য-কৌশলকে পথ করে দিতে এসেছে বিজ্ঞাপন সংস্থার মতো নানা ব্যবস্থা। পাশাপাশি চাহিদা ও মাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপনের প্রকৃতিও বিবর্তিত হয়েছে।

উদ্দেশ্য
১৮৩৬ সালের জুনে প্যারিসের পত্রিকা ‘লা প্রেসে’র সম্পাদক এমিল দ্য জেরার্দিন প্রথম তার পত্রিকার দাম কমানো, পাঠক সংখ্যা বাড়ানো এবং মুনাফা বৃদ্ধির জন্য অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন নেয়া শুরু করেন। তার এই ফর্মুলা শিগগিরই অন্যান্য পত্রিকা অনুসরণ করতে শুরু করে।

প্রথম দিকের এসব মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগই ছিল বই ও পত্রিকার প্রচারের পাশাপাশি ঘরোয়া নানা ধরনের ওষুধ সংক্রান্ত। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞাপিত পণ্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে।


এমিল দ্য জেরার্দিন

দিনের পর দিন একই বিক্রেতার পণ্যের বিজ্ঞাপন পত্রিকা ছাপানোর মধ্য দিয়ে সেগুলো পুরো দেশেই পরিচিতি পেতে থাকে। এভাবেই তৈরি হয়েছে এক একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড নেম।

তবে সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ভুয়া বিজ্ঞাপনের সংখ্যা। ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ১৮৫০ এবং ১৮৬০’র দশকে বাড়তে থাকা সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লক্ষ্য করে নতুন নতুন ধরনের বিভিন্ন পণ্যের ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হতে থাকে।

কৌশল
১৯ শতকে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন জগতে রাজত্ব ছিল কোপ ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং টোব্যাকো কোম্পানির হাতে। ধূমপান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বাভাবিক একটা বিষয় হলেও ব্র্যান্ড নেমের প্রসার, নানাবিধ বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে বিপণন কৌশলের ভিন্নতার কারণে ধূমপানের জগতেও পরিবর্তন নিয়ে আসে ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানিটি।


আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয় লন্ডনের টমাস যে ব্যারেটকে। পিয়ার্স সোপ কোম্পানির জন্য মনোহরী ছবি ও অভিনব স্লোগান ব্যবহার করে তিনি এমন বিজ্ঞাপন তৈরি করলেন যা পণ্যটির প্রচারে ছিল সত্যিই কার্যকর। তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্লোগান ‘Good morning. Have you used Pears’ soap?’ প্রচারের শুরু থেকে পুরো ২০ শতক জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।

ব্যারেটের বিজ্ঞাপনের উল্লেখযোগ্য একটি কৌশল ছিল পিয়ার্স ব্র্যান্ডটিকে উচ্চ সংস্কৃতি ও উন্নত মানের সঙ্গে জুড়ে দেয়া। যেমন, একটি বিজ্ঞাপনে তিনি জন এভারেটের বিখ্যাত ‘বাবলস’ চিত্রকর্মের সামনে পিয়ার্স সাবানের ছবি যোগ করে বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন।


এরপর টানা কয়েকটি বিজ্ঞাপন তিনি বানিয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন গোছানো মধ্যবিত্ত শিশুদের ছবি দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পিয়ার্সকে ঘরোয়া আরামের পাশাপাশি অভিজাত সমাজের আকাঙ্ক্ষার ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সফল হয়েছিলেন।

নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ব্যারেট সফল বিজ্ঞাপনের এমন বেশ কিছু কৌশল শিখিয়ে গেছেন যা এখনো বিজ্ঞাপন নির্মাতারা অনুসরণ করছেন। বিজ্ঞাপন ও ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির ওপর বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

একই সঙ্গে তিনি বলেছেন: ‘রুচি পাল্টায়, ফ্যাশন পাল্টায়, এবং বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই পাল্টাতে হবে। এমনটা নয় যে প্রতিবারই নতুন আইডিয়া পুরনো আইডিয়ার চেয়ে ভালো হবে। কিন্তু তা অবশ্যই পুরনোটার চেয়ে ভিন্ন এবং তা বর্তমান রুচির সঙ্গে মিলবে।’


সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিনব বিজ্ঞাপনের আইডিয়া

২০ শতকে পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের জন্য উন্মুক্ত হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসার ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল বিজ্ঞাপন। নারীরাই যেহেতু বাসার বেশি কেনাকাটার কাজ করেন, সেহেতু তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নারী মডেলের প্রয়োজন বিজ্ঞাপনদাতারা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে থাকেন।

পাশাপাশি এই শতক থেকেই বিজ্ঞাপনে যৌনতা ও নগ্নতার ব্যবহার শুরু হয়। ১৯১১ সালে উডবারি সোপ কোম্পানি প্রথম তাদের সাবান বিক্রির জন্য যৌনতার ধারণা ব্যবহার করেছিল। এই কোম্পানিই ১৯৩৬ সালে ‘দ্য সান বাথ’ বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম নগ্ন বিজ্ঞাপনের প্রচলন করে।


ব্রাজিল, কানাডা, চীন, জার্মানি, সাউথ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২০০৮ সালের এক তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞাপনগুলো তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। সেখানে জার্মানি ও থাইল্যান্ডের বিজ্ঞাপনে নারীদেহ বেশি দেখানো হয়। তবে পুরুষের নগ্নতায় তেমন কোনো বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি।

২০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞাপনে প্রথম মনোবিজ্ঞানের সচেতন ব্যবহার শুরু করেন তৎকালীন প্রখ্যাত আমেরিকান মনোবিদ ওয়াল্টার ডি স্কট এবং জন বি ওয়াটসন। স্কট বলেন, মানুষকে যুক্তিবাদী প্রাণী বলা হলেও এটাও সত্যি যে তাকে ও তার যুক্তিকে প্রভাবিত করা সম্ভব। অন্যের নির্দেশ ও পরামর্শে মানুষ প্রভাবিত হয়।


আসল টমেটো থেকে তৈরি বোঝাতেই এই কৌশল

এই দুই মনোবিদ আরও বলেন, মানুষের মৌলিক আবেগ, যেমন ভালোবাসা, ঘৃণা ও ভয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে।

এ ধারণা থেকে তারা নির্দেশমূলক বার্তা দিয়ে বিজ্ঞাপনের আধেয় তৈরি শুরু করেন, যা দারুণভাবে কাজে দিয়েছিল। এখনো মানবীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে, যা বিপণনের প্রসারের পাশাপাশি নানা সামাজিক বার্তা ছড়াতেও অত্যন্ত কার্যকর।

এই মনোবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কোমল পানীয়, ফাস্টফুড, এমনকি সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যের বিজ্ঞাপনেও স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা যোগ করা শুরু হয়। এখন এই কৌশল ফেসওয়াশ থেকে শুরু করে অধিকাংশ ব্যবহার্য পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হচ্ছে।


অ্যাড এজেন্সি
১৮৪০’র দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘বিজ্ঞাপনের এজেন্সি’ ধারণাটির জন্ম হয়। ভলনি বি পামার ১৮৪২ সালে ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি খোলেন। তিনি পত্রিকার কাছ থেকে কম দামে বিজ্ঞাপনের ভালো ভালো স্পেস কিনে কিছু বেশি দামে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করতেন। কিন্তু মূল বিজ্ঞাপনটি বানাতে হতো বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিকেই। সুতরাং তাকে মূলত বিজ্ঞাপনের দালাল বলা যায়।

অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির বর্তমান ধারণার প্রচলন হয় ১৯ শতকে নিউইয়র্কে এন ডব্লিউ আইয়ার অ্যান্ড সান এজেন্সি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এজেন্সিটি বিজ্ঞাপনদাতা যেমন চান তেমনভাবে পরিকল্পনা করে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করে প্রকাশের পুরো ব্যবস্থা করে দিত। ডি বিয়ার্স, এটিঅ্যান্ডটি এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্যও স্মরণীয় কিছু স্লোগান তৈরি করেছিল এন ডব্লিউ আইয়ার অ্যান্ড সান।


অ্যাড এজেন্সির বিজ্ঞাপন

১৯ শতকের পুরোটা সময়ই অ্যাড এজেন্সির ধারণাটি ব্যাপক প্রসার লাভ করে ধীরে ধীরে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই সময় থেকেই পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপনের জন্য স্পেস বাড়তে থাকে খুব দ্রুত। ১৮৯৩ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞাপনের বাজারে ৫০ হাজার ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছিল।

স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞাপন মূলত লন্ডন ও প্যারিসের মতো সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অধীনে ছিল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পণ্যের বিজ্ঞাপনই অধীনস্থ দেশগুলোর ধাঁচে বা সেখানকার সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করে আলাদা করে তৈরি করা হতো। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাবার পর আগের বিজ্ঞাপনের ধরনগুলো অনুসরণ করে বেশ কিছু দেশি পণ্যেরও বিজ্ঞাপন তৈরি হতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে এমন অসংখ্য বিজ্ঞাপনের নমুনা আমরা দেখতে পাই।


মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো এখনো দেশভেদে একই ধরনের বিজ্ঞাপন স্থানীয় তারকাদের নিয়ে নির্মাণ করে থাকে।

জে ওয়াল্টার থমসন প্রথম আমেরিকান এজেন্সি যা লন্ডনে ১৮৯৯ সালে অফিস খোলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে।


বর্তমানে মাত্র চারটি বিজ্ঞাপন এজেন্সি গোষ্ঠী বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করছে: ইন্টারপাবলিক, ওমনিকম, পাবলিসিস ও ডব্লিউপিপি। এদেরকে একত্রে ‘বিগ ফোর’ বলা হয়।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *