উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

অনৈতিক বিজ্ঞাপন

ইকতেদার আহমেদ: আমাদের দেশসহ পৃথিবীর সব দেশে প্রক্রিয়াজাত ভোগ্যপণ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের উৎপাদকেরা তাদের পণ্যের সাথে খরিদ্দারের পরিচয় ঘটানো এবং পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচারের আবশ্যকতা অনুভব করেন। যেকোনো পণ্যের একাধিক উৎপাদক থাকলে প্রতিযোগী বাজারে পণ্যের বিপণন ও অবস্থান সুসংহত করতে হলে বিজ্ঞাপন প্রচার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদকেরা খরিদ্দারদের মধ্যে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য তাদের ব্যবসায়িক মুনাফার একটি অংশ বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যয় করে থাকেন। অনেক দেশে বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যয়িত অর্থের ক্ষেত্রে কর রেয়াত পাওয়া পায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়।

উৎপাদকেরা বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যম বেছে নেন। আমাদের দেশে টেলিভিশনের আগমনের আগে বেশির ভাগ উৎপাদক রেডিও, দৈনিক খবরের কাগজ, মাসিক, পাক্ষিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা, পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড ও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের প্রয়াস পেতেন। এসব বিজ্ঞাপনে সুদূর অতীত থেকে বাক্যের ব্যবহার অথবা স্থিরচিত্র দ্বারা পণ্যের ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়ে আসছে। টেলিভিশনের ব্যবহার সহজলভ্য হয়ে এলে টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের আবেদন অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের চেয়ে একজন ক্রেতার আগ্রহকে অধিকতর প্রভাবিত করতে পারে, এ বিবেচনায় উৎপাদকেরা বর্তমানে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে টেলিভিশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন।

সাধারণত দেয়ালে লিখন ও ব্যানারের বিজ্ঞাপন বাক্যের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অপর দিকে পত্রিকা, সাময়িকী, বিলবোর্ড ও পোস্টারের বিজ্ঞাপন বাক্য ও স্থিরচিত্র- উভয়ের সংমিশ্রণে হয়ে থাকে। রেডিওতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিজ্ঞাপনে বাক্যের ভাষা ও সুর শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে পণ্যকে যেন জনপ্রিয় করে তুলতে পারে, এ বিষয়টি মাথায় রেখে ছন্দময় বাক্য ও শ্রুতিমধুর সুরের মিশ্রণে সুরেলা কণ্ঠের স্বনামধন্য গায়ক বা গায়িকা দ্বারা বিজ্ঞাপনটি প্রস্তুত করা হয়। টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপন একই সাথে দর্শকের সামনে ছন্দময় ও সুরেলা বাক্য এবং চলমান চিত্রের মাধ্যমে উপস্থিত হওয়ায় বিজ্ঞাপন নির্মাতারা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিজ্ঞাপন প্রস্তুত করতে সচেষ্ট থাকেন।

এ কথাটি অনস্বীকার্য, বর্তমানে টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপন একজন খরিদ্দারের মধ্যে পণ্য ক্রয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যতটুকু প্রভাব ফেলে, অন্য কোনো মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপন সে তুলনায় বলতে গেলে সীমাবদ্ধতার বলয়ে আবদ্ধ।

একজন ব্যবসায়ী মুনাফার উদ্দেশ্যেই ব্যবসা করেন। তার উৎপাদিত বিক্রয়যোগ্য পণ্য খরিদ্দারের কাছে যত বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, তার পণ্যের বিপণন ও চাহিদা সে হারে বাড়তে থাকবে। প্রতিযোগী বাজারে বিপণন ও চাহিদা যেন কোনোভাবে সমগোত্রীয় পণ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকে লক্ষ রেখে একজন ব্যবসায়ীকে যে মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের আবেদন সর্বাধিক, সে মাধ্যমটিকে শীর্ষে স্থান দিয়ে একই সাথে অন্যান্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে দেখা যায়।

ব্যবসায়ীকে পণ্যের মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ক্রেতা ও ভোক্তার আস্থা অর্জন করতে হয়। স্বভাবতই পণ্যের সর্বোত্তম মান নিশ্চিতকরণের স্বার্থে একজন ভালো ব্যবসায়ীর জন্য যেসব উপাদান সমন্বয়ে পণ্যটি প্রস্তুত করা হয়, সেসব উপাদানের বিশুদ্ধতা নিরূপণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু পণ্যের বিশুদ্ধতা নিরূপণ না করে যেসব উপাদান দ্বারা পণ্যটি প্রস্তুত হওয়ার কথা, তাতে সেসব উপাদানের লেশমাত্র উপস্থিতি না থাকলে প্রতারণামূলকভাবে কী করে একজন বিজ্ঞাপনদাতা দাবি করেন, তার পণ্যটি প্রক্রিয়াজাত ‘প্রাকৃতিক উপাদান’ দিয়ে তৈরি?

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশে বেশ কিছু উৎপাদক দীর্ঘ দিন ধরে ঘনীভূত দুধ বাজারজাত করে আসছেন। তারা যে মূল্যে পণ্যটি বাজারজাত করে আসছেন, তাদের সাথে একটি বহুজাতিক কোম্পানিও পণ্যটি বাজারজাত করছিল। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির প্রস্তুতকৃত পণ্যটির বাজারমূল্য স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের প্রস্তুতকৃত পণ্যটির চেয়ে পাঁচ-ছয় টাকা অধিক ছিল। অনুসন্ধানে দেখা গেল, স্থানীয় প্রস্তুতকারকেরা ঘনীভূত দুধ নামে কৌটার মোড়কে গরুর ছবি দিয়ে যেভাবে পণ্যটি বাজারজাত করে আসছিলেন, তাতে গরুর দুধের লেশমাত্র উপস্থিত ছিল না। এ ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারণা নিঃসন্দেহে একজাতীয় প্রতারণা। এ প্রবণতাকে যদি উৎসাহিত করা হয়, তাতে খরিদ্দার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু প্রতারক ও অনৈতিক প্রস্তুতকারকদের অবৈধ লাভ দিন দিন হবে স্ফীত।

দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের দেশে একটি বহুজাতিক কোম্পানি ‘দুধের চেয়ে সমৃদ্ধ’ দাবি করে একটি গুঁড়া খাদ্যসামগ্রী বাজারজাত করে আসছে। সম্প্রতি টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে সামগ্রীটির নাম ধরে বলা হচ্ছে দুধে এটি মেশাও এবং দুধের শক্তি বাড়াও। এ বিজ্ঞাপনটি কতটুকু অনৈতিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে আমরা যেসব পানীয় পেয়ে থাকি, তার মধ্যে গরুর দুধ অন্যতম প্রধান। পৃথিবীর যেকোনো উপাদেয় খাবার তৈরিতে সরাসরি দুধ বা দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত সামগ্রী ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়।

গরুর দুধের মধ্যে আল্লাহ পাক এমন সব মৌলিক উপকরণের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন, যে কারণে এটি বয়স নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য একটি আদর্শ খাদ্য। তবে প্রাকৃতিকভাবে আহরিত গরুর দুধ খুব বেশি ঘন হলে অনেকসময় এটিকে পাতলা করার জন্য পানি মেশানোর আবশ্যকতা দেখা দেয়। আবার কখনো কখনো দুধের শক্তি কমানোর জন্য দুধ থেকে ননি তোলা হয়। এ ননি দিয়ে মাখন ও ঘি প্রস্তুত করা হয়। যে দুধ থেকে ৫০ শতাংশ ননি তুলে ফেলা হয়, তাকে বলা হয় হাফক্রিম মিল্ক আর ৫০ শতাংশ ননি তুলে যদি গুঁড়া দুধ প্রস্তুত করা হয় তখন তাকে বলা হয় হাফক্রিম মিল্ক পাউডার। এমন অনেক গুঁড়া দুধ রয়েছে, যে দুধ থেকে শতভাগ ননিই তুলে ফেলা হয়। এ দুধটিকে বলা হয় ননফ্যাট মিল্ক পাউডার। তা ছাড়া, টকদই প্রস্তুত করার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শতভাগ ননি তুলে ফেলা হয়।

বিশ্বব্যাপী যখন দুধের ননি তুলে দুধের শক্তি কমিয়ে বিভিন্ন বয়সী লোকদের জন্য দুধকে উপযোগী খাবার হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে; তখন বিজ্ঞাপনের বক্তব্য মতে, সামগ্রীটি মিশিয়ে দুধের শক্তি বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে কি? নিঃসন্দেহে এটি একটি অনৈতিক বিজ্ঞাপন। একটি বহুজাতিক কোম্পানি নিছক বিপণন বৃদ্ধির জন্য অনৈতিক বিজ্ঞাপন অবলম্বনে খরিদ্দারদের অপপ্রচার দ্বারা বিভ্রান্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত করা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তারাসহ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী যদি বিষয়টিকে উপেক্ষা করে চলেন, তাহলে অনৈতিকতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।

বহুজাতিক কোম্পানিটির গুঁড়া খাদ্য দিয়ে এক কাপ পানীয় বানিয়ে পান করলে যে পরিমাণ খাদ্যগুণ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অধিক খাদ্যগুণ আমরা পেতে পারি, এক কাপ ভাতের মাড়কে লবণ, গোলমরিচের গুঁড়া, ডিমের সাদা অংশ, টেস্টিং সল্ট ও সস দিয়ে স্যুপ বানিয়ে উপাদেয় খাবার হিসেবে পান করলে। অথচ আজ বিজ্ঞাপনের বদৌলতে বহুজাতিক কোম্পানিটির গুঁড়া খাদ্যটি ‘সব গুণাগুণসমৃদ্ধ খাদ্য’ এবং ‘দুধের চেয়েও শক্তিশালী’, আর প্রচার না থাকায় এবং আমাদের সচেতনতার অভাবে ভাতের মাড় নেহাত ফেলনা। যারা একবার বর্ণিত উপায়ে ভাতের মাড়কে স্যুপ হিসেবে খেয়েছেন, তাদের অভিমত- এ স্যুপের স্বাদ কোনো অংশে পাঁচতারকা হোটেলে পরিবেশিত ক্রিম স্যুপের চেয়ে কম নয়। উল্লেখ্য, অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি দুধের ননি মিশিয়ে ক্রিম স্যুপ সুস্বাদু করা হয়। তাই ভাতের মাড়ে দুধের ননী মিশিয়ে সুস্বাদু করতে বাধা কোথায়?

যেকোনো ব্যবসা পরিচালনায় নৈতিকতা মেনে চলা সততার পরিচায়ক। নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে খরিদ্দারকে অপপ্রচার দ্বারা আশ্বস্ত করার প্রয়াস আইনের দৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ। এ ধরনের অমার্জনীয় অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া হলে অনৈতিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসার প্রসার ঘটবে।

এমনই অনৈতিকতা দেখা গেছে গৃহ নির্মাণসামগ্রী, সিমেন্টের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। কোনো একসময় আমাদের বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট আমদানি করতে হতো। তখন বাজারে সিমেন্ট অপ্রতিযোগী ছিল বিধায় বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন খুব একটা ছিল না। বর্তমানে আমরা সিমেন্টে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নই, বরং বেশ কিছু সিমেন্ট রফতানিও করছি। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো যুগসন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছানোর কারণে বর্তমানে ব্যাপক হারে স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। তাই সিমেন্টের ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ডজন তিনেক কোম্পানি সিমেন্ট প্রস্তুত ও বিপণনের সাথে জড়িত বিধায় ব্যবসাটি এখন দেশে অত্যন্ত প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে একটি সিমেন্ট কোম্পানি নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা তথা পণ্যের বিপণন বাড়ানোর জন্য টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা শুরু করেছে, তাদের প্রস্তুতকৃত সিমেন্টের দাম একটু বেশি হলেও বাজারের ‘সেরা সিমেন্ট’। তাই অন্যান্য সিমেন্ট না কিনে খরিদ্দারদের তাদের প্রস্তুতকৃত সিমেন্ট কেনা উচিত। এটিও একটি অনৈতিক বিজ্ঞাপন। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা, নির্মাতা, প্রচারকারী সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সচেষ্ট হলে অনৈতিকতার অনেকাংশে লাঘব ঘটবে।

আমাদের দেশে বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি ‘তাজা ফলের রস’ দাবি করে আম, কমলা প্রভৃতির রস বাজারজাত করছে। একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে, তাদের ফলের রস এতই খাঁটি যে, এটি পান করলে ‘নৈতিকতা এত প্রবল হবে, একটি শিশুর জন্য ছোটখাটো মিথ্যা বলাও অনৈতিক হবে।’ কিন্তু কোম্পানিটি শতভাগ ফলের রসের পরিবর্তে অন্যান্য কৃত্রিম সামগ্রী ব্যবহার করে ফলের গন্ধ ও স্বাদ অটুট রাখার ক্ষেত্রে যে সচেষ্ট, এটি কি অনৈতিক নয়? অনুরূপভাবে, খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতকারী অপর একটি প্রতিষ্ঠানের বাজারজাত ফলের রস এক দিকে যেমন শতভাগ ফলের রস নয়, অপর দিকে এগুলোতে মানুষের প্রাণসংহারকারী ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে কী হবে? কারণ তারা নিরুদ্বেগ। তারা টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে তাদের উৎপাদিত ফলের রস প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণরূপে ফল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে, এমন দাবি করলেও বাস্তব চিত্র একদম ভিন্ন।

পাশের রাষ্ট্রের একটি প্রসাধনসামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, যা আমাদের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয় তাতে দেখানো হচ্ছে- ওই কোম্পানির ক্রিম মুখে ব্যবহার করলে গালের ওপর জেগে ওঠা ছোট টিউমার আকৃতির গোটাটি নিমেষেই চলে যাবে। টেলিভিশনে এর যে আকৃতি দেখানো হয়েছে, এ ধরনের আকৃতির গোটা অস্ত্রোপচার ছাড়া অপসারণ সম্ভব নয়। বিজ্ঞাপনটি দ্বারাও খরিদ্দার প্রতারিত হচ্ছেন। অথচ নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিজ্ঞাপনটির প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে।

আমাদের টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের অনেকগুলোই অনৈতিকতার দোষে দুষ্ট। এ অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে খরিদ্দারের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সবার কর্তব্য। আর এ কর্তব্য পালনে আমাদের যেকোনো ধরনের ব্যর্থতা শুধু খরিদ্দার বা ক্রেতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং গোটা সমাজকে কলুষিত করে অন্যায়ের ছদ্মাবরণে অনৈতিকতাকে উৎসাহিত করে জাতির বিবেকের ভিত্তিমূলে আঘাত হানবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *