উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আজ উপেক্ষিত(!)

আতিকুল ইসলাম: ঢাকার জমিদার নবাব আবদুল গনী (১৮১৩-১৮৯৬) তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্ল্যাহ (১৮০৪-১৯০১) কে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব দেন ১৮৮৬সালে। আহসানউল্ল্যাহ ১৮৭০ সালে জমি দান করলে ১৮৭১ সালে সেই জমিতে হাজী মুহাম্মদ মহসীন ফান্ডের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মাদ্রাসা। ঢাকার নবাব জমি দান না করলে ঢাকা মাদ্রাসা সেদিন প্রতিষ্ঠিত হত না। নবাব আবদুল গনীর ইন্তেকালের পর নিয়ম মতে জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্ল্যাহ ১৮৮৬ সালে নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। পিতার মতো তিনিও জনহিতকর কাজে বিপুল অর্থ দান করেছেন। ১৯০১ সালে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে নবাব আহসানউল্ল্যাহ ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম বিজলী বাতির ব্যবস্থা করেন। জনহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী নবাব আহছানউল্ল্যাহ ১৯০১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। এরপর নবাবের জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণকারী খাজা সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি পিতার মতই ছিলেই দানশীল ও শিক্ষানুরাগী। নবাব হবার পরই তিনি নিজের দান করা জমিতে নগদ এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা ব্যয় করে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল। এটিই ছিল তৎকালীন পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের প্রথম কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষ স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে আহসানউল্ল্যাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল নামকরণ করে। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সরকার স্কুলটিকে উন্নীত করে আহসানউল্ল্যাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে। ১৯৬২ সালে মুসলিম লীগ সরকার শাসনামলে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উনøীত করে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বা পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীন বাংলাদেশে নামকরণ পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বা বুয়েট। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে প্রদেশের নামে না করলে হয়ত বুয়েট আজো আহছানউল্ল্যাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামেই পরিচিত থাকতো। ১৯০২ সালে নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে তারই অর্থে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি পর্যায়ক্রমে উন্নীত ও সম্প্রসারিত হয়ে আজকের বুয়েটে পরিণত হয়েছে। উৎস তালাশ করলে নবাব সলিমুল্লাহই বুয়েটের আদি প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষ কয়েকজন হিন্দু নেতাসহ ভাইস রয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করে যে স্মারক লিপি প্রদান করেন তাতে বলা হয় “ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে আভ্যন্তরীনভাবে বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য”। এমন কয়েক ডজন স্মারকলিপি দেয়া হয়। এগুলোতে বলা হয়েছিল, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে বাঙালী জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে, তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বেড়ে যাবে”। কোন স্মারক লিপিতে বলা হয়েছে, “পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অধিকাংশই কৃষক, এই সকল চাষা-ভূষাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন নেই”। অসাম্প্রদায়িক  ও মানবহিতৈষী খেতাবে ভূষিত এই সকল বর্ণবাদী হিন্দু নেতাদের প্রবল বিরোধিতার পরও প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সাম্প্রদায়িক নামে অভিযুক্ত নবাব সলিমুল্লাহ নিজের প্রায় তিনশত বিঘা জমি দান করেন। ১৯০১ সালে নবাব হবার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলায় ছাত্রাবাস নির্মাণসহ জনহিতকর বিভিন্ন কাজে এবং দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকাতরে অর্থ দান করে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে জমি দান করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নগদ অর্থ তিনি দান করতে পারেননি। এই অক্ষমতা ছিল দান করতে অভ্যস্ত নবাবের জন্য গভীর মর্মবেদনার। ১৯১৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি শুক্রবার রাত ২.৩০মিনিটে কলিকাতার ৫৩ নং চৌরঙ্গী রোডস্থ নিজ বাসভবনে বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক ঢাকার জমিদার নবাব সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার অকাল মৃত্যু আজো রহস্যাবৃত। কলিকাতা ও ঢাকায় একাধিক জানাজা শেষে ঢাকার বেগমবাজারস্থ নবাবদের কবরস্থানে ১৭ই জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। হিন্দু নেতা ও সমাজ পতিদের বিরোধিতার পরও নবাব সলিমুল্লাহর ব্রেন চাইল্ড নামে খ্যাত শের-এ-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমিদারীর অংশ বিক্রি করে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর দান করা আটত্রিশ হাজার টাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত করে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ যার উদ্যোগে ও দান করা জমির উপর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত সেই নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী আজ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পালিত হয় না। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানেও সম্ভবত নবাব সলিমুল্লাহ উপেক্ষিতই থাকবেন আর বন্দনা করা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা কারীদের।

নতুন প্রদেশের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবীগুলো তুলে ধরার জন্য বাংলার মুসলমানদের নেতা নবাব সলিমুল্লাহ গঠন করেন মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন। এটাই ছিল বাঙালী মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কলিকাতা কেন্দ্রিক একজন জমিদার। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বাঙালী সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী যখন বঙ্গভঙ্গ রহিত করণ আন্দোলনে যুক্ত হলেন তখন তা হিন্দুদের সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলে নতুন প্রদেশের পক্ষে সর্ব ভারতীয় মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নবাব সলিমুল্লাহ তার চিন্তা-ভাবনা ও কর্ম তৎপরতাকে প্রদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নবাবের পরিকল্পনার একটি অংশ পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশসহ ভারতে মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে সুসংগঠিত হওয়া আর অপর অংশটি হলো হিন্দুত্ব বাদী কংগ্রেসকে মোকাবেলার জন্য  সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা তলে ভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা। এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে নবাব সলিমুল্লাহ সমিতির সেক্রেটারী নবাব মুহসিন-উল-মূলককে ‘অল-ইণ্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের’ বিশতম বার্ষিক অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার অনুরোধ করেন। বাংলায় এই কনফারেন্সের ১৩তম অধিবেশন হয়েছিল ১৮৯৯ সালে কলিকাতায় বিচারপতি স্যার সৈয়দ আমির আলীর সভাপতিত্বে।

নবাব মুহসীন-উল-মূলক সম্মতি জানালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও তরুণ আইনজীবী এ.কে ফজলুল হকের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকার শাহবাগের পারিবারিক বাগান বাড়ী ইশরাত মঞ্জিলে (বর্তমান মধুর ক্যান্টিন) ১৯০৬ সালের ২৭-২৮-২৯ ডিসেম্বর আয়োজন করেন অল ইণ্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের  বিশতম অধিবেশন। এতে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি শরফুদ্দিন। সর্বভারত থেকে প্রায় ১৫০০ বিশিষ্ট মুসলিম প্রতিনিধি ও ৫০০ মেহমান নিয়ে মোট ২০০০ছিল উপস্থিতি। এই মহাসম্মেলনে ব্যয় হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। মেজবান হিসাবে নবাব সলিমুল্লাহ একাই এই ব্যয় বহন করেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় কোন আবাসিক হোটেল ছিল না। ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিশিষ্ট, বনেদী ও সম্মানিত মেহমানদের থাকার আরামদায়ক ব্যবস্থা নবাব সলিমুল্লাহ সেদিন কিভাবে করেছেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।

সম্মেলনে এতো অধিক সংখ্যক বিশিষ্টজন উপস্থিত হওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। শিক্ষা সম্মেলন শেষে সলিমুল্লাহর অনুরোধে নেতৃবৃন্দ ৩০শে ডিসেম্বর এক বিশেষ অধিবেশনে হাজির হন। নবাব ভিখার-উল-মূলক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম  লীগ গঠনের প্রস্তাব করলে দিল্লীর হাকিম আজমল খান তা সমর্থন করেন। ফলে ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের হিন্দুত্ব বাদকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলার জন্য মুসলিম জাতিসত্তার আদর্শ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সাংগঠনিক রাজনৈতিক দল। ঢাকায় শিক্ষা সম্মেলন ও মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে প্রাদেশিক গণ্ডি পেরিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের নেতার পদে নিজেকে উন্নীত করেন। ফলে বিরোধী শিবিরে তিনি পরিণত হন বিরোধিতার লক্ষ্যবস্তুতে।

কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাংলায় গড়ে উঠা আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার কাছে নতি স্বীকার করে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীর দরবার হলে বঙ্গভঙ্গ রহিত করার ঘোষণা দেন। ফলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়। অখণ্ড বাংলার রাজধানী হয় পূর্বের মত কলিকাতা। আর বঙ্গভঙ্গ রহিত করণের বিনিময়ে বাংলার হিন্দু বাবুরা ভারতের রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরে সম্মতি দেয়।

বঙ্গভঙ্গ রহিত হবার পর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের এবং নবাব সলিমুল্লাহর মনে সৃষ্ট ব্রিটিশদের প্রতি প্রকাশ্য ক্ষোভ এবং হিন্দুদের সম্পর্কে অবিশ্বাস প্রশমিত করতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন নবাব সলিমুল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে। ঐ দিনই একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল নিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাত করে মুসলমানদের বিভিন্ন দাবীর সাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীটি পুনরায় উল্লেখ করেন। ক্ষুব্ধ নবাবকে শান্ত করতেই দুদিন পর ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এই ঘোষণার পরপরই বঙ্গভঙ্গ রহিত করার সদ্য সাফল্যে উজ্জীবিত হিন্দু নেতারা অনুরূপ আন্দোলন ও প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারী ঘোষণাকে বাতিল করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জী। কলিকাতা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশালের হিন্দু নেতারা একাধিক প্রতিবাদ সভা করেন। কলিকাতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষ কয়েকজন হিন্দু নেতাসহ ভাইস রয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করে যে স্মারক লিপি প্রদান করেন তাতে বলা হয় “ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে আভ্যন্তরীনভাবে বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য”। এমন কয়েক ডজন স্মারকলিপি দেয়া হয়। এগুলোতে বলা হয়েছিল, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে বাঙালী জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে, তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বেড়ে যাবে”। কোন স্মারক লিপিতে বলা হয়েছে, “পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অধিকাংশই কৃষক, এই সকল চাষা-ভূষাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন নেই”। অসাম্প্রদায়িক  ও মানবহিতৈষী খেতাবে ভূষিত এই সকল বর্ণবাদী হিন্দু নেতাদের প্রবল বিরোধিতার পরও প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সাম্প্রদায়িক নামে অভিযুক্ত নবাব সলিমুল্লাহ নিজের প্রায় তিনশত বিঘা জমি দান করেন।

১৯০১ সালে নবাব হবার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলায় ছাত্রাবাস নির্মাণসহ জনহিতকর বিভিন্ন কাজে এবং দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকাতরে অর্থ দান করে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে জমি দান করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নগদ অর্থ তিনি দান করতে পারেননি। এই অক্ষমতা ছিল দান করতে অভ্যস্ত নবাবের জন্য গভীর মর্মবেদনার। ১৯১৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি শুক্রবার রাত ২.৩০মিনিটে কলিকাতার ৫৩ নং চৌরঙ্গী রোডস্থ নিজ বাসভবনে বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক ঢাকার জমিদার নবাব সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার অকাল মৃত্যু আজো রহস্যাবৃত। কলিকাতা ও ঢাকায় একাধিক জানাজা শেষে ঢাকার বেগমবাজারস্থ নবাবদের কবরস্থানে ১৭ই জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।

হিন্দু নেতা ও সমাজ পতিদের বিরোধিতার পরও নবাব সলিমুল্লাহর ব্রেন চাইল্ড নামে খ্যাত শের-এ-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমিদারীর অংশ বিক্রি করে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর দান করা আটত্রিশ হাজার টাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত করে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ যার উদ্যোগে ও দান করা জমির উপর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত সেই নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী আজ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পালিত হয় না। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানেও সম্ভবত নবাব সলিমুল্লাহ উপেক্ষিতই থাকবেন আর বন্দনা করা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা কারীদের।

লেখক পরিচিতি: স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *