উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

৪ বন্ধুর গল্প: তকদিকের ওপর কারও কোনো হাত নেই

ইরানি গল্প ও রূপকথা: এক রাস্তায় চার জনের দেখা হলো। প্রথম জন রাজপুত্র, কথায় বার্তায় আচার আচরণে তার সেই রাজকীয় মানসিকতা স্পষ্ট। দ্বিতীয়জন ছিল সম্পদশালী ব্যবসায়ীর পুত্র, সে ছিল বেশ সচেতন এবং প্রখর মেধাবী। তৃতীয় জন ছিল লম্বা এবং দেখতে বেশ সুন্দর, যে কেউই তাকে দেখে আকৃষ্ট হতো। চতুর্থ জন ছিল কৃষকের ছেলে, সে ছিল বেশ শক্তিশালী এবং সুঠামদেহি। নিয়তি তাদেরকে নিয়ে এসেছে এক মোহনায়। চারজনই রাস্তায় এসে পরিচিত হলো একে অপরের সাথে। সে সময় দুর্ভিক্ষ চলছিল চারদিকে। গায়ের জামা ছাড়া আর কিছুই তাদের সাথে ছিল না। তারা হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে আয় রোজগার করা যায় সে ব্যাপারে কথা বলছিল। রাজপুত্রের মাথার চুল উড়ছিল বাতাসে। সে তার নয়া বন্ধুদের বললো: তকদিকের ওপর কারও কোনো হাত নেই।
ব্যবসায়ীর ছেলে বললো: জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাই হলো সবচেয়ে বড় কথা। জ্ঞান বুদ্ধির স্থান সবকিছুর উপরে। দুঃসময়ে বা বিপদে আপদে চিন্তাশক্তি এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই কেবল মুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
সুদর্শন যুবক বললো: কিন্তু আমার মনে হয় সৌন্দর্য হলো মানুষের সহযোগী। সমস্যায় পড়লে ওই সৌন্দর্যকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
কৃষকের ছেলে বললো: তোমাদের সবার কথা একদিকে আর চেষ্টা প্রচেষ্টা বা কর্মতৎপরতা একদিকে। মানুষের বিশেষ করে পুরুষের পরিচয়ই হলো কাজের মধ্যে। যে কাজ করবে, নিজের বাহুবলকে কাজে লাগিয়ে রুটি রুজির ব্যবস্থা করবে তার উন্নতি হবে।
এভাবে কথা বলতে বলতে চার বন্ধু রাস্তায় হাঁটছিল। যেতে যেতে দূরে একটা শহর দেখা গেল। শহর দেখে সবাই খুশি হয়ে গেল। মনে হলো যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। কিছুক্ষণ পরেই তারা শহরে পৌঁছে গেল। পৌঁছেই তারা একটু থামলো এবং খানিকটা ক্লান্তি দূর করে নিলো। এরপর ভাবলো কী করে ক্ষুধা মেটানো যায়। কারও কাছেই টাকা-পয়সা ছিল না। পরনের পোশাক ছাড়া সম্পদ বলতে আর কিছুই ছিল না তাদের কাছে। রাজপুত্র কৃষকের ছেলেকে বললো: তোমার কথাটা এখন প্রমাণ করো তো! তুমি বলেছিলে সব কিছুই নির্ভর করে কর্মতৎপরতার ওপর। তুমি এখন শহরে যাও, বাহুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পয়সাপাতি সংগ্রহ করে আনো, অন্তত কাল পর্যন্ত যাতে চলে।
কৃষকের ছেলে বললো: ‘ঠিক আছে’। মেনে নিলো সে এবং সেদিনের জন্য হালাল রুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। সে জানতো ওই শহরে এতো দ্রুত কাজ পাওয়া যাবে না। সেজন্য সে সিদ্ধান্ত নিলো শহরের বাইরে যাবে এবং কিছু জ্বালানি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করবে। ওই জ্বালানি বিক্রির টাকা দিয়ে সবার জন্য খাবার দাবারের আয়োজন করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে দ্রুত চলে গেল কাজে। দুই বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করলো এবং কাঁধে তুলে নিয়ে সোজা চলে গেল শহরের দিকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বাজারে গিয়ে লাকড়িগুলো অতি দ্রুত বিক্রি করে ফেললো সে। লাকড়ি বিক্রি করে এক দেরহাম পেল এবং তা দিয়ে খাবারের আয়োজন করে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
বন্ধুরা তো অপেক্ষা করছিল কখোন আসবে সে। বন্ধুদের কাছে ফেরার পর শহরের ঢোকার দরোজায় সে লিখে রাখল: ‘একদিনের শ্রমের মূল্য এক দেরহাম’। ওই রাতে সবাই পেট পুরে খেয়ে ভালোভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরের দিন সকালে ঠিকঠাকমতো ঘুম ভাঙল সবার। আজ সুদর্শন যুবকের পালা। সুদর্শন যুবককে শহরে যেতে হবে এবং সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে প্রমাণ করতে হবে মানুষের সৌন্দর্যটাই হলো আসল ব্যাপার। কৃষক বন্ধু তো তাকে বলেই ফেললো: তুমি যে বলো মানুষের রূপ, সৌন্দর্য- এগুলো অনেক সাহায্য করে। এখন তুমি কি তোমার সুদর্শন রূপের সাহায্য নিয়ে আমাদের জন্য আজ ঠিকঠাকমতো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে?
সুদর্শন যুবক কোনো জবাব না দিয়ে শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো। শহরে গিয়ে এ গলি ও গলি ঘুরঘুর করলো। কিন্তু ঘোরাঘুরি করে তো আর রুটি রুজি করা যায় না। এখন সে ভাবলো ‘তার কথাটা বলা ঠিক হয় নি’। ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে পড়লো সে। কিন্তু এখন তো এসব ভেবে লাভ নেই। এখন কী করা যায়, টাকা কীভাবে সংগ্রহ করা যায় এসবই ভাবছিল সুদর্শন যুবক। ওদিকে বন্ধুরা তো সবাই অপেক্ষায় আছে খাবারের জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে একটা গাছের নীচে বসে পড়লো সে। ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল তার।
কিছুক্ষণ পর এক ধনী মহিলা ওই গাছের নীচে দিয়ে যাচ্ছিল। সে অবাক হয়ে দেখলো সুদর্শন যুবক কী চমৎকারভাবে ঘুমোচ্ছে। মহিলা ধরেই নিয়েছিল ওই যুবক এই শহরে নতুন এসেছে। কেননা এর আগে তাকে আর কখনো দেখে নি সে। যুবকের জন্য তার অন্তর পুড়ে গেল। যুবকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মহিলা তার চাকরকে বললো: ‘একে বাসায় নিয়ে গেলে ভালো হয় না! হয়তো টাকা পয়সাও তার সাথে নেই, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুম এসে গেছে’। মহিলার কথা শুনে চাকর যুবকের কাছে গেল। তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললো: ঘুমাচ্ছো কেন, ওঠো ওঠো! তোমার কপাল খুলে গেছে। আমার মনিব তোমাকে তাঁর বাসায় দাওয়াত করেছে। চলো! খাওয়া দাওয়া করবে এবং বিশ্রাম নেবে।সুদর্শন যুবক বললো খানিক চিন্তা করলো। তার মনে হচ্ছিল সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু চাকর যখন আবারও ডাকলো তখন উঠে দাঁড়ালো এবং চাকরকে অনুসরণ করলো। চাকর আবারও বললো: তোমার কপাল খুলে গেছে হে! যুবক এ কথা শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। ধনী মহিলার বাসায় গিয়ে যুবক ভালোভাবে খেলো, বিশ্রাম নিলো। দুপুরে ফেরার সময় ওই মহিলা তাকে ৫০ দেরহামও হাতে বুঝিয়ে দিল। ওই টাকা দিয়ে বন্ধুদের জন্য ভালোভাবে খাবারের আয়োজন করলো এবং শহরের দরোজায় লিখে রাখলো: সৌন্দর্যের এক দিনের মূল্য ৫০ দেরহাম। বন্ধুরা ঠিকঠাকমতো খাওয়া দাওয়া করলো এবং তার অনেক প্রশংসা করলো।

তৃতীয় দিনের শুরু। আজ ব্যবসায়ী পুত্রের পালা। তাকে আজ শহরে যেতে হবে। বন্ধুরা তাকে বললো: আজ আমরা তোমার বুদ্ধিমত্তা এবং মেধার অতিথি। তুমি তো বলেছিলে জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং মেধার সমান কিছুই নেই। এখন তোমার কথা প্রমাণ করার সময় এসেছে। তোমার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জন্য ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন করতে হবে।বণিকপুত্র বললো কোনো জবাব না দিয়ে সোজা রওনা হলো শহরের দিকে। সমুদ্রের তীর ধরে যেভাবে মানুষ হেঁটে বেড়ায়, সেভাবে হাঁটছিল সে। যে দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপলো কীভাবে তা আঞ্জাম দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলো সে।ভাবতে ভাবতে তার নজরে পড়লো দূরে একটা নৌকা সমুদ্রের তীরে নোঙর করা। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো সুন্দর সুন্দর এবং দামি সব পণ্যে নৌকা ভর্তি। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলো শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ী একত্রিত হয়ে কী যেন ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। কাছে গিয়ে শুনতে পেলো তারা চাচ্ছে নৌকার মালামাল সস্তায় কিনতে। তারা সমঝোতায় পৌঁছেছে যে সবাই পণ্যের মূল্য কম বলবে যাতে পণ্যের মালিক বাধ্য হয়ে তাদের কম দামেই মালগুলো দিয়ে দেয়। সিদ্ধান্তের পর তারা একসাথে গেল বিক্রেতার কাছে। মালের দাম বললো কম। বিক্রেতা অত কমদামে বিক্রি করতো রাজি হলো না। তারা একত্রে বললো: ‘আমরা এই দামই দেবো। যদি বিক্রি করো, দাও, নৈলে আমরা যাচ্ছি। তবে ঘণ্টাখানেক পর আবারও আসবো। ততক্ষণে নিশ্চয়ই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবে’। এই বলে ব্যবসায়ীরা চলে গেল।ব্যবসায়ীরা চলে যাবার পর পণ্যের মালিকের কাছে এলো বণিকপুত্র বুদ্ধিমান যুবক। সে তো সব ঘটনা দেখেছিল। তাই সে ব্যবসায়ীকে বললো: ওরা যে দাম বলেছে, আমি তারচেয়ে বেশি অর্থাৎ এক লাখ দেরহাম দেবো তোমাকে। তবে শর্ত হলো আমি বিকেলে তোমার টাকাটা দেবো। পণ্যের মালিক রাজি হয়ে গেল। মালগুলো তাকে দিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেক পর ষড়যন্ত্রকারী ব্যবসায়ীরা ফিরে এলো এ আশায় যে মালিক বাধ্য হবে তাদের কাছে সস্তায় বিক্রি করতে। কিন্তু এসে তো তারা হতবাক। মালিক বললো যে সব মাল বিক্রি হয়ে গেছে। এ কথা শুনে তারা হন্যে হয়ে ক্রেতাকে খুঁজতে শুরু করলো। যুবক তখন নিজের পরিচয় দিলো এবং বললো: মালগুলো দুই লাখ দেরহামে বিক্রি করবো। যদি তোমরা কিনতে না চাও তাহলে অন্য শহরে নিয়ে বিক্রি করবো।

ব্যবসায়ীরা যখন দেখলো মালগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে, বাধ্য হয়ে তারা দুই লাখ টাকায় কিনলো। যুবককে টাকাও বুঝিয়ে দিলো। যুবক পণ্যের মালিককে এক লাখ দেরহাম বুঝিয়ে দিয়ে লাভের এক লাখ দেরহাম নিয়ে বন্ধুদের জন্য খাবার দাবার কিনে দ্রুত বাসায় ফিরে গেল। শহরের দরোজায় লিখলো: ‘বুদ্ধিমত্তা ও মেধার এক দিনের মূল্য এক লাখ দেরহাম’। সবাই তার খুব প্রশংসা করলো এবং সেই দিনটি তারা বেশ আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে কাটালো।

চতুর্থ দিনের সূর্য সবার চোখে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেল চার বন্ধুর। এবার রাজপুত্রের পালা। তাকে আজ বাইরে গিয়ে বন্ধুদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধুরা তাকে বললো: তুমি তো বলেছিলে তকদির বা ভাগ্যই হলো সবকিছুর উপরে। তো আজ তুমি শহরে যাও এবং নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করো। শাহজাদা বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো। নিয়তির কি লীলা! ঠিক সেদিন সকালেই ওই শহরের বাদশাহ মারা গেল। জনগণ এবং সেনারা বাদশাহর লাশ দাফন করার জন্য নির্দিষ্ট কবরস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলো। রাজপুত্র উদ্দেশ্যহীনভাবে ওই কাতারে শামিল হয়ে গেল। সবাই কান্নাকাটি করছিল আর সে অপলকভাবে তাদের দিকে তাকাচ্ছিল কেননা বাদশাহর মৃত্যুতে তার কান্না করার কোনো মানে ছিল না। সে বরং ভাবছিল কীভাবে বন্ধুদের জন্য খাবারের আয়োজন করা যায়। সেনাপ্রধান যখন দেখলো রাজপুত্রের মাঝে কান্নাকাটি করা কিংবা কোনোরকম ভেঙে পড়ার চিহ্নমাত্র নেই তখন সে বিরক্তই হলো এবং রাজপুত্রকে অনুসরণ করতে লাগলো। তার কাছে গিয়ে বললো: ‘এই যুবক! কে তুমি? কেন তুমি এই শোকের দিনে কান্না করছো না কিংবা আমাদের বাদশাকে সম্মান দেখাচ্ছো না। তুমি নিশ্চয়ই কোনো গোয়েন্দা’। এই বলে ক’জন সেনাকে আদেশ দিলো যুবককে ধরে হাত বেঁধে কারাগারে নিয়ে আটকে রাখতে।তাই করা হলো। পরদিন শহরের গণ্যমান্যজনেরা সমবেত হলেন নতুন বাদশা নির্বাচন করার জন্য। শাহের তো কোনো পুত্রসন্তান ছিল না যে বাদশার স্থলাভিষিক্ত হবে। সেজন্যই এই সমাবেশ। কিন্তু যার নামই প্রস্তাব করা হলো তার ব্যাপারে কোনো না কোনো অভিযোগ উঠলো। এভাবে একটা শোরগোল সৃষ্টি হলো। বাদশা নির্বাচন হলো না। উল্টো বরং প্রাসাদ জুড়ে ব্যাপক হৈ চৈ দেখা গেল। যেই সেনাপ্রধান গেল রাতে এক যুবককে গ্রেফতার করেছিল সে রুমে ঢুকলো। মুরব্বিদের অনুমতি নিয়ে সে বললো: এই বিষয়টা যত শান্তভাবে এবং গোপনে আঞ্জাম দেওয়া যাবে ততই নিরাপদ। কেননা গতরাতেই আমি শাহের দাফন অনুষ্ঠান থেকে এক গুপ্তচরকে আটক করেছি। এখন সে প্রাসাদের কারাগারে আছে। তোমরা যেভাবে চীৎকার চেঁচামেচি করছো তার কানে তো সব চলে যাবে! মুরব্বিদের একজন আশ্চর্য হয়ে বললো: গোয়েন্দা? তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে আসো এখানে।

সৈন্যরা তাড়াতাড়ি করে যুবক শাহজাদাকে নিয়ে এলো এবং রুমের দরোজা বন্ধ করে দিলো। শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুরব্বি তাকে জিজ্ঞেস করলো: কোত্থেকে এসেছো হে, গোয়েন্দাগিরি করছো কেন? শাহজাদা বললো: গোয়েন্দা! কে গোয়েন্দা! আমি শাহজাদা! রাজপুত্র! আমার শহর তোমাদের শহরের পাশেই। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার ভাই আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। তাই আমি আমার জীবন রক্ষার স্বার্থে পালিয়ে এসেছি। আসার পথে আরও তিনজনের সাথে পরিচয় হয়। তাদের সাথেই তোমাদের এই শহরে এসেছি আমি। তারা এখন আমার অপেক্ষায় আছে। তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করার কথা ছিল আমার। গণ্যমান্যদের মাঝে কয়েকজন ব্যবসায়ীও ছিল। তারা শাহজাদাকে দেখে চিনতে পারলো এবং বললো: ও সত্য বলছে। আমরা বেশ কয়েকবার তাকে তার বাবার পাশে দেখেছি।

একথা শোনার পর মুরব্বিদের মাঝে একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। নিজেদের ভেতর পরামর্শ করার কিছুক্ষণ পর তারা বললো: ‘এই যুবকই আমাদের বাদশার স্থলাভিষিক্ত হবার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। আল্লাহ যেন এই যুবককে আমাদের বাদশা হবার জন্যই এই শহরে পাঠিয়েছেন’।

নিজেদের ভেতরে মতানৈক্য বা অভিযোগ অনুযোগ থাকলেও এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করলো না। এভাবেই অত্যন্ত সহজে যুবক রাজপুত্র বাদশাহ নির্বাচিত হয়ে গেল। ঐ দেশের নিয়ম ছিল যে-ই বাদশাহ নির্বাচিত হতো তাকে প্রথম দিন সাদা হাতীর পিঠে চড়িয়ে পুরো শহর ঘুরানো হতো যাতে মানুষজন তাদের নবনির্বাচিত বাদশাকে চিনতে পারে। তো যুবক বাদশাহ যখন হাতীর পিঠে চড়ে ঘুরতে ঘুরতে শহরের দরোজায় পৌঁছলো, দেখলো তার বন্ধুদের কেউ সেখানে নেই। বাদশা তাই একজনকে আদেশ দিলো ওই দরোজায় লিখে রাখতে: ‘জ্ঞান-বুদ্ধি, চেষ্টা-প্রচেষ্টা এবং সৌন্দর্য তখনই ফল বয়ে আনে আল্লাহর ইচ্ছা অর্থাৎ তাঁর অনুগ্রহ যখন তার সাথে থাকে। আমি যে একদিনেই বাদশাহ হয়ে গেলাম তা-ই আমার এ বক্তব্যের পক্ষে বাস্তব প্রমাণ’। হাতীর পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষে যুবক বাদশাহ ফিরে গেল প্রাসাদে। নিজের শাহী আসনে বসলো এবং প্রথমেই সেনাদের পাঠালো বন্ধুদেরকে তার প্রাসাদে নিয়ে আসতে। তার বন্ধুরা সৈন্য সামন্ত দেখে ভয়ই পেয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলো না তারা। আতঙ্কিত অবস্থায় তারা প্রাসাদে এলো। প্রাসাদে ঢুকতেই তাদের চোখ তো চড়কগাছ! তাদেরই বন্ধু প্রাসাদের সিংহাসনে বসে আছে। শাহ বন্ধুদের খোঁজ খবর নিয়ে পুরো ঘটনা তাদের কাছে খুলে বললো। বন্ধুরা পুরো কাহিনী শুনে ভীষণ খুশি হলো এবং তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালো।

এভাবে আলাপ আলোচনা শেষে তরুণ বাদশা তার বুদ্ধিমান বন্ধু ব্যবসায়ীর ছেলেকে মন্ত্রী বানালো। সুদর্শন যুবক বন্ধুকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিলো যাতে অন্য কোনো অঞ্চলে গিয়ে কাজকর্ম করতে পারে। আর কৃষকের ছেলে সুঠামদেহী যুবককে তার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিলো। তরুণ বাদশাহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে চেয়েছিল এবং ভাবলো যে এখনই সে কথা বলার উপযুক্ত সময়। কেননা বন্ধুবান্ধব এবং গণ্যমান্য সবাই উপস্থিত আছে। তাই সবার দিকে তাকিয়ে বললেন: প্রিয় বন্ধুরা! এই শহর এবং এই পৃথিবীতে এমনকি এই মজলিসে অনেকেই আছেন আমার চেয়েও বুদ্ধিমান, মেধাবী, সাহসী, সুদর্শন, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ইত্যাদি। আমার শক্তিমত্তা, আমার সৌন্দর্য ইত্যাদি কোনোটার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস ছিল না।

কিন্তু যখন আমার ভাই আমাকে বঞ্চিত করে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেল, সম্পদ, প্রাসাদ, ক্ষমতা ইত্যাদি, তখন থেকে আমি জীবনের আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। এভাবে যে আরেকটি দেশের বাদশা হবো কল্পনাও করি নি কখনো। আমি তো আমার ভাইয়ের ভয়ে প্রাসাদ ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতো পাহাড়ে জঙ্গলে কাটিয়েছি। কিন্তু আল্লাহ আমার তকদিরে রেখেছেন যে তিনি আমাকে এই শহরে আনবেন এবং এই প্রাসাদে বসাবেন, বাদশা বানাবেন। এই যে বিরাট সম্মান এবং মর্যাদার অধিকারী হলাম আমি, আল্লাহ যদি না চাইতেন তাহলে কোনোদিনই আমার জ্ঞান-বুদ্ধি,সৌন্দর্য আর চেষ্টা প্রচেষ্টার মাধ্যমে এতো অল্প সময়ের মধ্যে এই সম্মানের অধিকারী হতে পারতাম না। হ্যাঁ, যদি আমি হতে চাইতাম হয়তো যুগরে পর যুগ কেটে যেত, জীবনটাই হয়ত এর পেছনে লেগে যেত। সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছুই সম্ভব নয়। সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তিনি যদি না চান তাহলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী লোকটির পক্ষেও কোনো একটি পর্যায়ে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।

এটুকু বলে তরুণ বাদশাহ থামলেন। সমবেত সভাসদের মাঝ থেকে এক বৃদ্ধ লোক উঠিয়ে দাঁড়িয়ে বললো: দীর্ঘজীবী হও তরুণ বাদশাহ। তুমি যা বলেছো অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর মেধার স্বাক্ষর রয়েছে তাতে। সত্যিই বলেছো, আল্লাহর ইচ্ছা না থাকলে তুমি কোনোভাবেই এই বাদশাহির আসনে বসতে পারতে না। একটা কাহিনী মনে পড়ে গেল, অনুমতি দিলে বলতে চাচ্ছি।

সবার মাঝ থেকে বৃদ্ধ লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বললো: বহু বছর আগে যখন আমি তরুণ ছিলাম, তখন এক মহান ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। তারুণ্যের সময়টা কেমন যেন বাতাসের মতো পেরিয়ে গেল আর আমি আস্তে আস্তে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে এই পৃথিবীটা নশ্বর এবং একেবারেই মূল্যহীন। একরাতে আমি খুব চিন্তা করলাম এবং নিজেকে নিজে সতর্ক করলাম এই বলে যে: ‘তুমি এমন এক পৃথিবীর প্রেমে পড়েছো, এমন পার্থিব জগত চিন্তায় পড়েছো যে জগত থেকে হাজার হাজার বাদশাহ চলে গেছে। সুতরাং সময় থাকতে সচেতন হও, সময় খুবই কম, জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত’। সিদ্ধান্ত নিয়েই বাদশার খেদমত ছেড়ে দিয়ে ইবাদাতে মশগুল হলাম।

একদিন বাজারে ঘুরাফেরা করছিলাম। এক শিকারিকে দেখলাম তার খাঁচায় দুটি পাখি। সেগুলো বিক্রি করার জন্য ক্রেতা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার মন চাচ্ছিলো পাখি দুটোকে মুক্ত করে দিতে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম পাখি দুটোর দাম কতো? শিকারি বললো: ‘দুই দেরহাম’। আমার কাছে অবশ্য দুই দেরহামের বেশি ছিলো না। মনে মনে ভাবছিলাম দুটো দেরহামই যদি শিকারিকে দিয়ে দেই তাহলে তো কিছুই থাকবে না পকেটে। কী করা যায়, ভাবছিলাম। দোদুল্যমান হয়ে পড়লাম। একবার ভাবছি পাখি কেনার চিন্তা বাদ দেই। আবার ভাবি দুই দেরহামই তো, কিনেই ফেলি পাখি দুটোকে। আল্লাহ তো অনেক বড়ো, অনেক দয়ালু। রুজির মালিক তো তিনিই। পাখি দুটোর জন্য মনটা পুড়ছিল। ওই পোড়া মনটাকে সমুদ্র বিশালতায় ছেড়ে দিলাম। কিনেই ফেললাম পাখি দুটোকে।

খাঁচার দরোজাটা খুলতে চাইলাম পাখিদের মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। আবার মনে ভয় হচ্ছিল কেউ পাখিগুলোকে আবার বন্দি করে না বসে। তাই চলে গেলাম শহরের বাইরে। সবুজ শ্যামল এক প্রান্তরে গিয়ে তাদের ছেড়ে দিলাম। পাখি দুটো মুক্তি পেয়ে মনের আনন্দে ডালে বসে উড়ে উড়ে গান গাচ্ছিলো। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পাখিরা বললো: আমাদের জন্য অনেক বড় কাজ করেছো তুমি। ভেবো না কেবল দুই দেরহাম দিয়ে আমাদের কিনেছো। বরং তুমি দুটি পাখিকে মুক্তি দিয়েছো! স্বাধীন জীবন দিয়েছো। আমরা যদি তোমার পায়ে হাজারটা গুপ্তধনও রাখি তবু তোমার উপকারের কৃতজ্ঞতা আদায় করা হবে না। এই মুহূর্তে আমি ওই গাছের নীচে একটা গুপ্তধন দেখতে পাচ্ছি। মাটি খুঁড়ে ওই গুপ্তধন তুমি নিয়ে নাও!

পাখিদের কথা শুনে আমি তো থ’ বনে গেলাম। জিজ্ঞেস তোমরা গুপ্তধন দেখতে পাও, তাহলে শিকারির পাতা ফাঁদ কেন দেখতে পেলে না, কেন তার জালে আটকা পড়লে! পাখিদের একটি বললো: ‘আল্লাহর ইচ্ছে ছিল এরকম। তিনি মহান। তিনি আমাদের ফাঁদে ফেলে এই গুপ্তধন দেখালেন। এসবই তাঁর কৌশল, সবই তাঁর ইনসাফ’। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়লাম। বিশাল এক গুপ্তধন ভাণ্ডার পেলাম। পার্থিব জগতের সম্পদের আর কোনো প্রয়োজন রইলো না। কিন্তু এসব সম্পদ দিয়ে নিজেকে আবারও দূষিত করতে চাইলাম না। যেখানে ওই ভাণ্ডারটি ছিল সেখানেই পুঁতে রাখলাম। বাদশাহ অনুমতি দিলে ওই ভাণ্ডারটি নিয়ে আসতে পারি’। তরুণ বাদশা বললেন: ‘না, ওই গুপ্তধন তোমারই প্রাপ্য। তুমি এ কাজ করে বহু কল্যাণের বীজ বুনেছো। তুমি যদি গুপ্তধন ভাণ্ডার সত্যিই না চাও, তাহলে নিয়ে আসো, গরিব মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দাও’। এভাবেই রাস্তায় পরিচিত হওয়া চার বন্ধুর কাহিনী শেষ হয়। তরুণ বাদশার কথা শুনে সবাই মেনে নেয় যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে অর্থাৎ তকদিরের বাইরে কোনো কিছু হতে পারে না। চার বন্ধুই তার প্রমাণ। তাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। অথচ এখন তারা সবাই ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাদের ভাগ্য খুলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নেয় যে আল্লাহর চাওয়াই সবচেয়ে বড়ো চাওয়া। প্রত্যেকেরই কপাল বা ভাগ্য তাঁরই হাতে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *