উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ

আবু এন এম ওয়াহিদ: জীবনস্মৃতির আয়নার দিকে তাকালে বড়জোর উনিশ শ’ পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যন্ত যেতে পারি। এর আগের ঘটনাবলি আমার মগজের হার্ডডিস্কে সেভ করা হয়নি, অর্থাৎ তখনো অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মৃতির খাতায় স্থায়ীভাবে লিখে রাখার মতো বয়স হয়নি আমার। বাংলাদেশে আমাদের ছোটবেলার বেড়ে ওঠার দিনগুলো আর আজকের দিনের মধ্যে বিস্তর ফারাক! পাঁচ-ছয় দশকের ব্যবধান। বিগত অর্ধশতাব্দীতে দেশ ও দেশের মানুষ, তাদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি, আয়-উপার্জন, জীবন-জীবিকা, ইত্যাদি সবই বদলে গেছে। বদলে গেছে বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন ঢঙে। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের বাইরে থাকি। তাই বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিদিনকার ক্রমাগত পরিবর্তন অনুভব করার সুযোগ পাই না। মাঝে মধ্যে যখন দেশে যাই, অনেক ব্যাপারে বড় বড় পরিবর্তন সহজেই চোখে ধরা পড়ে। বাংলাদেশেরই কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম, তাই আমাদের ছোটবেলার ঈদ-আনন্দও হতো গ্রামবাংলার সেই সময়কার আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে। ঈমানদারদের জন্য অসীম রহমত ও ফজিলতের রোজার মাস। এটা শেষ হলেই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে, বয়ে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দের সওগাত। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে দু-এক দিনের জন্য হলেও নির্মল আনন্দে মেতে ওঠেন। আজকাল বাংলাদেশের নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো ও শিশুরা কিভাবে ঈদ উদযাপন করেন তা ঠিক জানি না। তবে আমাদের কালে আমরা কিভাবে ঈদের খুশিতে ফেটে পড়তাম তা আজো মনে হলে সুখ পাই; পাই অপরিসীম আনন্দ। স্মৃতির পাতা থেকে আমাদের ছোটবেলার ঈদের কিছু কথা, কিছু ভাবনা, অনুভূতি ও উপলব্ধি এ লেখার মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

শৈশবে শেষ রোজার দিন সবার সাথে জামাতে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতাম। নামাজের পরে মসজিদ থেকে বেরিয়েই পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে খুঁজতে থাকতাম ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদ। এক চিলতে চিকন চাঁদ- যেন এই দেখি, এই নেই! নজরে পড়ত, আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে যেত। ফের খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদেরকে দেখাতাম। কেউ দেখতে পেত, কেউ পেত না। খুশিতে নাচতে নাচতে এক দৌড়ে চলে আসতাম বাড়িতে। ঘরে এসে মাকে বলতাম- জানো মা, আজ সবার আগে আমিই চাঁদ দেখেছি। কাল ঈদ। মা হেসে হেসে বলতেন, ‘তাই নাকি? তুই যে চাঁদ দেখেছিস, এর সাক্ষী রেখেছিস কাউকে? চাঁদ দেখে থাকলে কাল থেকে নয়, খুশির ঈদ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে।’ রমজান মাসের শেষ তারিখ চাঁদ দেখার সাথে সাথেই যে ঈদ শুরু হয়ে যায় এবং এর আগে শাবান মাসের শেষ দিন সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ ওঠার সাথে সাথে যে রোজার মাসের সূচনা হয়, সেটা বুঝেছি অনেক পরে, বড় হয়ে। সৃষ্টির শুরুতে অন্ধকারের গভীরেই আলোর জন্ম, আর তাই আরবি পঞ্জিকায় স্বাভাবিকভাবে দিনের আগে রাত আসে।

এ রচনা নিয়ে বন্ধু মাহবুবের সাথে কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি কথা মনে পড়ল। এ জন্য মাহবুব ‘আরেকটি’ ধন্যবাদ পেতেই পারে। ‘আরেকটি’ বলার কারণ, এমন ধন্যবাদ আমার কাছে মাহবুবের সব সময়ই পাওনা থাকে। আমাদের ঈদের প্রস্তুতি ঈদের বেশ আগেই শুরু হয়ে যেত। যতদূর মনে পড়ে, এ তোড়জোড় আরম্ভ হতো রোজার শেষ দিকে হাতে মেহেদি লাগানো দিয়ে। আমরা যখন গ্রামের বাড়িতে বড় হচ্ছিলাম তখন আমাদের কোনো বোন বা চাচাতো বোনও ছিল না। তারা যখন দুনিয়ার আলো দেখেছে তখন আমরা পড়ালেখার উদ্দেশে বাড়িছাড়া। মেহেদি জিনিসটি সাজগোজের বিষয় এবং মেয়েলি ব্যাপার। এতে তাদেরই উৎসাহ বেশি থাকার কথা। মাঝে মধ্যে ওই সময় যখন বড় ফুফু নাইয়র আসতেন তখন ফুফাতো বোনদের নিয়ে ‘মেন্দি উৎসব’ খুব জমত। ফুফু এবং কাজের মেয়েলোকরা আদর যত্ন করে আমাদের হাতে মেহেদি পরিয়ে দিতেন। আমি একটু অস্থির ছিলাম, কতক্ষণ পরপর আঙুল দিয়ে মেহেদি পাতার পেস্ট সরিয়ে দেখতাম হাত লাল হচ্ছে কি না। এতে হাতের মেন্দি লেপটে যেত। মেন্দির লাল কারুকার্য স্পষ্ট হয়ে হাতে ফুটে উঠত না। তাই হাত ধোয়ার পরে অন্যদের সাথে যখন মিলিয়ে দেখতাম তখন মন খারাপ হতো। আমাদের বাড়িতে মেন্দি লাগানো যে শুধু মেয়েদের বা ছোটদের ব্যাপার ছিল তা নয়। আব্বা ও চাচাদেরকেও দেখতাম, বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলের মাথায় এবং ওই হাতের তালুতে পূর্ণচন্দ্র আকারে মেহেদি পরতেন। আমাদের দুই হাতের তালুতে বেশ বিস্তৃত কারুকাজসহ মেহেদি লাগানো হতো। কখনো কখনো আমরা দুই হাতের তালুতে চ্যাপ্টা করে মেন্দির পেস্ট লাগিয়ে নিতাম। সে কাজ আমরা নিজেরাই করতে পারতাম এবং একে বলতাম ‘জোড়-মেন্দি’।

ফিরে আসি ঈদের দিনের কথায়। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রান্নাঘরে নানা জাতের পিঠা ও মিঠাই বানানো শুরু হয়ে যেত। আমরা ঘুমোনোর আগেই কিছু খেয়ে নিতাম। তারপর বিছানায় যেতাম ঠিকই, কিন্তু ঈদের খুশিতে আর উত্তেজনায় চোখে ঘুম আসতে চাইত না। ফজরের আজানের আগেই উঠে যেতাম। একান্নবর্তী পরিবার, আমরা সমবয়সী ভাইয়েরা, পাশের বাড়ি এবং গ্রামের অন্য ছেলেদের সাথে গোসল করতে বাড়ির সামনে পুকুরে চলে যেতাম। ‘নূর নবী মক্কার পানি, ঈদের গোসল করলাম আমি,’ এই দোয়া পড়তে পড়তে ভালো করে গোসল সেরে জামাকাপড় পরে নিতাম। কাপড়গুলো আগেই ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দিতাম অন্তত তিন-চার দিন। তখন বাড়িতে লোহার ইস্ত্রি এসেছি কি না মনে নেই, এলেও ওটা ছুঁয়ে দেখা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে ছিল।

পরিষ্কার জামাকাপড় পরে যখন ঘরে ফিরে আসতাম, তখনো চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটি কথা বলে রাখি, ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরার কথা জানতাম, তবে আমাদের ভাগ্যে তা জুটত না। কদাচিৎ নতুন কাপড় পেলেও এমন ঈদের কথা আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু এতে মোটেও মন খারাপ হতো না। কারণ বলতে গেলে বাড়ির এবং গ্রামের সব ছেলেমেয়েদের অবস্থাই ছিল তথৈবচ। ঈদ গোসলের ওই অভিনব দোয়াটি কে শিখিয়েছিলেন, তা মনে নেই। এর মানে কী? এটা আদৌ কোনো সহি দোয়া কি না, প্রভৃতি প্রশ্ন তখন কারো মনে জাগেনি, তবে এটা যে একটা পবিত্র দোয়া এ ব্যাপারে আমাদের কারো বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি ছিল না। আজ একা একা যখন সেসব ঘটনার স্মৃতি তর্পণ করি তখন মনে মনে হাসি। যা হোক, সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত সবাই জটলা বেঁধে বিছানায় বসে গল্পগুজব করতাম; হাসিঠাট্টায় মেতে থাকতাম।

পূর্ব আকাশে আলো ফোটার সাথে সাথে ছেলেরা সব দলবেঁধে বাড়ির মুরব্বিদের, কদমবুসি করতাম। বাবা, চাচা, মা, চাচীদের পর সব শেষে যেতাম দাদীর ঘরে। দাদী বসে থাকতেন পিঠা ও মিষ্টিদ্রব্যের ভাণ্ড নিয়ে। সালাম করার পর দাদী আদর করে সবার হাতে তুলে দিতেন মিষ্টি জাতীয় খাবার। গ্রামের সববাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। মুরব্বিদের কদমবুসি করতাম আর বখরা পেতাম ঘরে বানানো নানা ধরনের পিঠা। দু-এক ঘর খাওয়ার পরেই পেট ভরে যেত। শেষের দিকে সাধলেও আর খাবার হাতে নিতাম না। সালাম করে খুশি মনেই খালি হাতে চলে আসতাম। ঈদের দিন কদাচিৎ কেউ একটা দুটো সিকি আধুলি হাতে তুলে দিলে মনে হতো, যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছি!

গ্রাম ঘোরা হলে বাড়িতে ফিরে আসতাম। এসে দেখতাম, বাড়ির সামনে কাছারি ঘরের উঠানে লাইন ধরে ফকির-মিসকিনরা দাঁড়িয়ে আছেন ফিতরা নেয়ার জন্য। তারা একে একে এগিয়ে আসছেন, আর আব্বা বারান্দায় একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে কাউকে সিকি, কাউকে আধুলি, আবার কারো হাতে টাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ফকির-মিসকিনরা চলে গেলে আব্বার আশপাশে ঘুর ঘুর করতাম। ভাবতাম, একটা সিকি-আধুলি আমাকেও দিতে পারে, বাবা যে ফিতরার পয়সা আমাকে দিতে পারেন না, সেটা তখন জানলে তার ওপর আমার রাগ-অভিমান হতো না।

তারপর সবার সাথে নামাজের জন্য ঈদগাহে যেতাম। নামাজ শেষে ঈদগাহের আশপাশে দেখতে পেতাম সাদা টুপি মাথায় শুধু মানুষ আর মানুষ- কুরবানির ঈদ হলে একদল লোক দেখতে পেতাম ঘোরাঘুরি করছে। তাদের গায়ে ময়লা নোংরা ছেঁড়া কাপড়, মাথায় গামছা বাঁধা, এক হাতে বাঁশের লাঠি (কাঁধে করে চামড়া বয়ে নেয়ার জন্য) আরেক হাতে বস্তায় ছুরি-ছোরা প্রভৃতি। আর প্রায় সব ঈদেই থাকত আরেক দল, তারা ফেরিওয়ালা। বেলুন, হাওয়াই মিঠাই, বাঁশের বাঁশি, লেবেনচুষ প্রভৃতি বিক্রি করত। নিজের পকেটে পয়সা থাকলে কিছু কিনতাম, না থাকলে মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পয়সার জন্য মানুষের ভিড়ে আব্বাকে খোঁজার সাহস ছিল না। ওই দুই দলের লোকদের ঈদের ময়দানে বেমানান লাগলেও, অনেক পরে বুঝেছি, তারাও ঈদ-আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা: ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে ‘তিজারত’কে একীভূত করে দিয়ে ইসলামকে আরো বাস্তবসম্মত ও জীবনঘনিষ্ঠ করে গড়ে তুলেছেন।

রোজার ঈদ হলে নামাজের পরে বাড়িতে বকরি জবাই হতো আর কুরবানির ঈদ হলে সাথে একটা গরুও থাকত। বাড়ির বাইরের ঘরের সামনে এক দিকে চলত গোশত কাটাকাটি। আরেক দিকে চলত ঈদগাহ কমিটির বিরাট মিটিং। আমাদের ঈদগাহের ব্যবস্থাপনা ছিল আশপাশের পাঁচ গ্রামের পাঁচ পঞ্চায়েতের যৌথ ব্যবস্থা। আব্বা ছিলেন এর মোতাওয়াল্লি। তাই মিটিং বসত আমাদের বাড়িতে। ঈদগাহে যে চাঁদা তোলা হতো, তা আমাদের বাড়ির মিটিংয়ে গোনাগুনি হতো। এরপর পুরো টাকাই ঈদগাহের ইমাম ও সহকারী ইমামের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হতো। কতক্ষণ গোশ্ত কাটাকাটি দেখতাম, আবার কতক্ষণ মিটিং শুনতাম। ঈদের মিটিং বড় বলে পিঠা-সন্দেশ খাওয়ানো সম্ভব হতো না, কিন্তু পান-সুপারি আর গুড়গুড়ি হুঁকোর এস্তেমাল চলত বেহিসাবে। হুঁকো, তামাক, আর পান-সুপারির চল কি এখনো গ্রাম বাংলায় আছে?

রান্নাবান্নার জন্য স্বাভাবিকভাবেই দুপুরে খেতে দেরি হতো। তবে মজা করে ইচ্ছেমতো পেট ভরে গোশত দিয়ে খাওয়াটা খুব উপভোগ করতাম। এমন উপাদেয় ও পর্যাপ্ত খাবার বছরে মাত্র দু’বারই কপালে জুটত। বিকেল বেলা পাশের গ্রামে ফুফুর বাড়ি গেলে, পেতাম সেমাই এবং মাঝে মধ্যে ‘আখনি পোলাও’ (বিরিয়ানির সিলেটি সংস্করণ)। হৈ-হুল্লোড় করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম ঘরে।

আমাদের বাড়িতে কুরবানির ঈদের দুটো বিশেষত্ব ছিল। প্রথমটি হলো, যাদের নামে পশু কুরবানি করা হতো, তারা কুরবানির গোশ্ত রান্না হওয়ার আগে অন্য কিছু খেতেন না। এটা নবী করিম সা:-এর সুন্নত, তাই। দ্বিতীয়টি হলো, আমার দাদী গরম করে করে কুরবানির গোশত প্রায় এক মাস ধরে সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন। সে যুগে রেফ্রিজারেশনের কথা গ্রাম দেশে কল্পনারও বাইরে ছিল। দাদী ওই গোশ্ত দিয়ে একেক দিন একেক পরিবার করে আমাদের গ্রামের সবাইকে দুপুর বেলা ভাত খাওয়াতেন এবং এ জিয়াফত সিরিজ চলত প্রায় তিন-চার সপ্তাহ ধরে।

কী রোজা, কী কুরবানির ঈদ, এশার নামাজের পর আমাদের বাড়িতে শুরু হতো ওই দিনের সর্বশেষ ও আসল উৎসব! গ্রামের সবাই যার যার ঘরে ঈদের জন্য যা রান্না হতো তার একটি বড় অংশ নিয়ে আসতেন আমাদের কাছারি ঘরের সামনের উঠানে। কেউ নিয়ে আসতেন পোলাও, গরুর গোশত, কেউ রাঁধতেন খিচুড়ি, কেউবা আনতেন সাদা ভাত আর সাথে খাসি অথবা মুরগির গোশত। ছোট-বড়, ছেলেমেয়ে, জওয়ান-বুড়ো সবার মিলনমেলা বসত আমাদের বাড়ির আঙিনায়। হারিকেন জ্বালিয়ে আলো-আঁধারির মাঝে আমরা সবাই একসাথে ভাগ করে খাবারগুলো খেতাম। কোনো কোনো সময় অন্ধকারের মধ্যে পাতে যে পোকামাকড় পড়ত না, তাও নয়। আর পড়লেই বা কী? এত কিছু দেখে ও বেছে খাওয়ার কি সময় ছিল আমাদের? খাওয়া শেষ হলে পুকুরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসতাম। আজকাল ছোটবেলার সেই আনন্দ কোথাও খুঁজে পাই না!

সারা দিন হইচই করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তবু শুতে যেতে চাইতাম না। মনে হতো, ঘুমোতে গেলেই তো আনন্দ হাতছাড়া হয়ে যাবে। অবশেষে আব্বার বকাবকিতে বিছানায় যেতে হতো। অবসন্ন শরীর নিয়ে বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লান্তিতে আরামের লম্বা ঘুম দিতাম। মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যে আগামী ঈদের স্বপ্ন দেখতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠলে দিন গুনতে শুরু করতাম, কবে আসবে আবার ঈদ! প্রবাসজীবনে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আজো ঈদ করি, আনন্দ পাই, আজো দিন গুনি আবার কবে আসবে রোজা, কবে আসবে ঈদ, খুশির ঈদ! তবে সেদিনের সাথে এর একটা পার্থক্য আছে। আজকের প্রত্যাশার সাথে একটা বিষয় নিশ্চিত জানি, জীবনে যত ঈদই আসুক, ছোটবেলার সেই ঈদ আর আসবে না। সেই আনন্দও আর ফিরে পাব না। শৈশবের সাথে চিরদিনের মতো হারিয়েছি তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ফিরে পাবো না সেই সময়, ফিরে পাবো না সেই ঈদ, ফিরে পাবো না সেই হাসি-খুশি আর কোলাহল!

বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হয়, যে দিন ছেলেবেলার মধুর স্মৃতিকথা বিসর্জন দিতে হবে, সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নয়! কেন, বলছি শুনুন। এক পাঠক বন্ধু এ লেখার আগের সংস্করণ পড়ে আমাকে যা লিখেছেন তার সারসংক্ষেপ হলো- ‘জনাব, আপনি যে বাংলাদেশে বড় হয়েছেন, সে বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। এখন বাংলাদেশের মানুষ আর গরিব নয়। এখানে এখন অনেক লোক আছেন যারা প্রতিদিনই ঈদ করে থাকেন’। আমিও জানি, এখন দেশে অনেক মানুষ আছেন যারা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী নিয়ে ঈদ করতে চান না। তারা ঈদ এলে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যান কক্সবাজার, কুয়াকাটা; আর যারা আরো ধনী তারা চলে যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর; এমন কি ইউরোপ-আমেরিকাতেও গিয়ে তারা ঈদ উদ্যাপন করে থাকেন। সবশেষে, আপনাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, যেদিন বাংলাদেশের সব মানুষ সব দিনই ঈদ করবে, সেদিন কি আমার ছেলেবেলার সেই ঈদ, সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে, নাকি ‘উন্নয়নের হাওয়ায়’ হারিয়ে যাবে? বুঝতে পারছি, আবেগে চোখ দুটো ভিজে আসছে!

লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াস;
Email: [email protected]




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *